দশ কোটি। আজ থেকে বারো বছর আগে, ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে এটাই মোটামুটি ছিল সমাজমাধ্যমের জনপ্রিয় মঞ্চ, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এখন, এই ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০০ কোটি। সেটাও প্রতি মাসে! এই বৃদ্ধি বিস্ফোরণের মতোই। গত বারো বছরে সমাজমাধ্যমের ব্যাপ্তি ও বিকাশের এই বিস্ফোরণ প্রভাব ফেলেছে নানা ক্ষেত্রে। তার মধ্যে যেমন রয়েছে সমাজ ও রাজনীতি, তেমনই রয়েছে ব্যক্তিমানুষের চিন্তা, চেতনা, মনোভাবও। বারো বছর পার করে ঘটে যাওয়া একটি ‘ইভেন্ট’-এর দিকে নজর করলেই তার কিছুটা ধরা পড়বে।
সেই ঘটমান বর্তমান, তথা ‘ইভেন্ট’ হল কুম্ভমেলা। বারো বছর পর উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে আবার পূর্ণকুম্ভ আয়োজিত হল। জানুয়ারিতে শুরু হয়ে দেড় মাসের এই কর্মকাণ্ড শেষ হওয়ার আগেই কুম্ভে পুণ্যস্নান করেছেন ৫০ কোটির বেশি মানুষ। ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনই এই হিসেব দিয়েছে। সেই উত্তরপ্রদেশ সরকারের পুলিশ-প্রশাসনই জানিয়েছে, মাঘী-পূর্ণিমার স্নানের জন্য কুম্ভে পৌঁছনোর প্রায় ৩০০ কিমি আগে থেকে শুরু হয়ে যায় যানজট। ৪৮ ঘণ্টা ধরে রাস্তায় আটকে থাকার অভিজ্ঞতাও সামনে এসেছে। কুম্ভমেলা শুরু হওয়ার পর থেকেই এমন নানা ছবি, ভিডিয়ো সামনে আসতে থাকে সমাজমাধ্যমের সৌজন্যে। তার পরেও কিন্তু প্রতিটি শাহি স্নানের তারিখের আগে কার্যত একই ছবি দেখা গেল। এই প্রসঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ এই বারো বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সমাজমাধ্যম নামক বাস্তুতন্ত্রের ভূমিকা।
মহার্ঘ ও অভিজাত আইফোনের থেকে বরাবরই অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনের সংখ্যা অনেক বেশি। বিশ্ব জুড়েই। বারো বছর আগে যখন পূর্ণকুম্ভ শুরু হচ্ছে ইলাহাবাদে, তার ঠিক আগের বছর, ২০১২-য় সবে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের জন্য অ্যাপ তৈরি করেছে ইনস্টাগ্রাম। তখনও এমন হাতে হাতে স্মার্টফোন চোখে পড়ত না। সেই ইলাহাবাদের নাম বদলে পরে হবে প্রয়াগরাজ। অখিলেশ যাদবের সরকার বদলে আসবে যোগী আদিত্যনাথের সরকার। তারও কয়েক বছর পরে, ২০২০ সালে আসবে ইনস্টাগ্রাম রিল। কয়েক সেকেন্ডের অসংখ্য ছোট ছোট ভিডিয়ো, যার কোনও শেষ নেই।
এমন অসংখ্য ভিডিয়োতেই এখন কুম্ভ যাত্রার পথের এমন অজস্র ভোগান্তির ছবি দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ট্রেনের সংরক্ষিত কামরায় তিলধারণের জায়গা নেই। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ থাকায় উঠতে না পেরে রাগে ট্রেনের জানলা, দরজার কাচ ভাঙছেন পুণ্যার্থীরা। ২০ ঘণ্টা থেকে ৪০ ঘণ্টার বেশি রাস্তায় গাড়িতে আটকে থাকা যাত্রীদের ক্ষোভের ভিডিয়ো সামনে আসছে। যাঁরা আটকে রয়েছেন, তাঁরা বাকিদের ফিরে যেতেও বলছেন। অনেকে যে ফিরে আসছেন, সে কথাও জানাচ্ছেন। দেখা গিয়েছে মৌনী অমাবস্যার দিনে পদপিষ্ট হয়ে মৃতদের পরিজনদের কান্নার ভিডিয়োও। তবে এমন নেতিবাচক কোনও দৃশ্যই যে কুম্ভে আসার উৎসাহ কমিয়েছে, তা বলা যাবে না। নয়াদিল্লি স্টেশনে পদপিষ্টের ঘটনার পরেও একই রকম প্রায় প্রাণঘাতী ভিড়ের পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে একাধিক স্টেশনে।
এই আকর্ষণ কি পুরোটাই ধর্মের? পুণ্যের টানে? ইনস্টাগ্রাম রিল আমাদের যে সব দৃশ্য দেখাচ্ছে তাতে সেই প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়ে যায়। বারো বছর আগের কুম্ভমেলায় গিয়ে দেখেছি মোবাইল ভিডিয়োর রমরমা কার্যত নেই বললেই চলে। ছবি তোলা ছিল, তবে তা মূলত পেশাদার ও কিছু পর্যটকের। মোবাইল ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন তখনও যে কাউকে ‘সংবাদদাতা’ বানিয়ে দেয়নি। এই বদলটা এ বারের হিড়িক থেকে স্পষ্ট।
ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োতেই দেখা গিয়েছে ট্রেনের এসি কামরার বাথরুম ভিতর থেকে বন্ধ করে কুম্ভে চলেছেন কয়েক জন তরুণী। সেখান থেকেই তাঁরা ‘রিল’ করে সে কথা জানাচ্ছেন। ভয়ঙ্কর ভিড় মুছে দিচ্ছে অসংরক্ষিত কামরা, সংরক্ষিত কামরার ভেদাভেদ। সেই ঠাসা ভিড় থেকেই যাত্রার ধারাভাষ্য শোনা যাচ্ছে ভিডিয়োতে। রিলের দৌলতে ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে আইআইটি বাবা, অ্যাম্বাসাডর বাবাদের কথা। সকলেই চাইছেন নিজের অভিজ্ঞতার ‘ব্রাউনি পয়েন্ট’টা সবাইকে দেখাতে।
এই দেখনদারির পিছনে অর্থনীতিও রয়েছে। রিল জনপ্রিয় হলে সেখান থেকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় হতে পারে। আবার নামগোত্রহীন থেকে জনপ্রিয়তার স্রোতে সমাজমাধ্যমে প্রভাবশালী হয়ে যাওয়ার হাতছানিও তো রয়েছে। সেই সঙ্গেই রয়েছে আরও এক উৎকণ্ঠা, যা বেড়ে উঠেছে সমাজমাধ্যম যুগে। তা হল ফোমো বা ফিয়ার অব মিসিং আউট। আমার কিছু অপ্রাপ্তি থাকছে না তো?— এই আশঙ্কা। এই উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা থেকেই শুধু কুম্ভ কেন, যে কোনও জনপ্রিয় ঘটনায় ভিড় করেন অনেকে। গত কয়েক মাসে দেশে বহু জাতীয়-আন্তর্জাতিক সঙ্গীত তারকা কনসার্ট করেছেন। তা নিয়ে ব্যাপক উন্মাদনাও দেখা গিয়েছে। সেই প্রসঙ্গেই গায়ক আরমান মালিকের উপলব্ধি, এই ধরনের অনুষ্ঠান নিয়ে প্রচার এমন তুঙ্গে তোলা হয় যে, অনেকে এই ‘ফোমো’ থেকেই এ সবে যান। কোনও ব্যক্তিগত ইচ্ছে, আবেগ কাজ করে না।
আর রাষ্ট্রযন্ত্রও এই আবেগে হাওয়া দিয়ে চলে। পূর্ণকুম্ভের রাজ্য, উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারই গত বছর ডিজিটাল মিডিয়া নীতি তৈরি করেছে। সেখানে ঘোষণা করা হয়েছে, সমাজমাধ্যমের যে ‘প্রভাবশালী’রা সরকারের ‘ভাল’ কাজের প্রচার করবেন, তাঁদের সরকার মাসে আট লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে পারে। তা ছাড়া সরকারি তরফে কুম্ভের প্রচারের ঝড় তো ছিলই। মৌনী অমাবস্যায় কুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনার পরে বিরোধীরা অনেকে এই ব্যাপক প্রচারকেও দায়ী করেন। তাঁদের দাবি, লাগামছাড়া প্রচারের জেরে হওয়া ভিড়কে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার জন্যই বিপত্তি ঘটে। আসলে সেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভবই নয়। কারণ সমাজমাধ্যম, আর তার সৌজন্যে আসা দেখনদারির উদগ্র আবেগে সেই বাঁধটা ভেঙে গিয়েছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)