পহেলগাঁও কাণ্ডের ছ’দিনের মাথায় আফগানিস্তানের তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে কাবুলে গিয়ে বৈঠক করেছেন ভারতীয় কূটনীতিক। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, পাকিস্তানকে ‘টু ফ্রন্ট ওয়ার’-এ নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:২১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার বদলা নিতে ফের পাকিস্তানে ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক? না কি আবার প্রত্যাঘাত শানাবে ভারতীয় বায়ুসেনা? এই সমস্ত প্রশ্নের আবহে প্রকাশ্যে এসেছে আরও একটি জল্পনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সাঁড়াশি আক্রমণে ইসলামাবাদের টুঁটি চেপে ধরতে ‘টু ফ্রন্ট ওয়ার’-এর পরিকল্পনা করছে নয়াদিল্লি। সেই লক্ষ্যে আফগানিস্তানকে পাশে পেতে চাইছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
০২১৯
২৭ এপ্রিল, রবিবার হিন্দুকুশের কোলের দেশটির তালিবান সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের বিশেষ প্রতিনিধি তথা যুগ্ম সচিব আনন্দ প্রকাশ। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। উল্লেখ্য, পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার ছ’দিনের মাথায় তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করলেন বিদেশ মন্ত্রকের এই শীর্ষকর্তা, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
০৩১৯
বিদেশ মন্ত্রকের বিশেষ প্রতিনিধি আনন্দ প্রকাশ বর্তমানে আফগানিস্তান, ইরান এবং পাকিস্তান ডেস্কের ডিরেক্টর জেনারেলের দায়িত্বভার সামলাচ্ছেন। তালিবানের বিদেশমন্ত্রী মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠকের পর অবশ্য প্রকাশ্যে কোনও বিবৃতি দেননি তিনি। কেন্দ্রের তরফে বৈঠকের কথা স্বীকার করে জানানো হয়েছে, আমু দরিয়ার পারে পরিকাঠামোগত বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে সদর্থক আলোচনা হয়েছে।
০৪১৯
২০২১ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য তালিবান নেতৃত্ব আফগানিস্তানের কুর্সি দখলের পর সেখানে আগে থেকে চলে আসা বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয় নয়াদিল্লি। মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠকে সেগুলি পুনরায় চালু করার ব্যাপারে আনন্দ প্রকাশ জোর দিয়েছেন বলে সূত্র মারফত জানা গিয়েছে। অন্য দিকে, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী এবং অসুস্থদের ভিসা প্রদানের সংখ্যা বৃদ্ধির অনুরোধ করেন তালিবান মন্ত্রী।
০৫১৯
বৈঠক নিয়ে দেওয়া বিবৃতিতে আফগানিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছেন তাঁরা। আর এই জায়গাতেই দানা বেঁধেছে সন্দেহ। পাকিস্তানের সঙ্গে ‘ডুরান্ড লাইন’কে কেন্দ্র করে আফগানিস্তানের বিবাদ রয়েছে। একে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বলে মানতে নারাজ কাবুল। এর জেরে ইসলামাবাদের সঙ্গে সংঘাত লেগেই রয়েছে কাবুলের। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সুযোগই কাজে লাগাতে চাইছে নয়াদিল্লি।
০৬১৯
গত কয়েক বছর ধরেই আফগানিস্তান সীমান্ত লাগোয়া খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে সক্রিয় রয়েছে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তারা। পাশতুনভাষী খাইবার-পাখতুনখোয়াকে নিয়ে স্বাধীন পাশতুনিস্তান তৈরির স্বপ্ন রয়েছে তাদের। অন্য দিকে, কাশ্মীর ইস্যুতেও পাক ফৌজের পুরোপুরি উল্টো অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছে টিটিপিকে।
০৭১৯
ইসলামাবাদের শাহবাজ় শরিফ সরকারের অভিযোগ, টিটিপিকে আশ্রয়, হাতিয়ার এবং মদত দিচ্ছে আফগানিস্তানের তালিবান। কারণ, ‘ডুরান্ড লাইন’-এর আন্তর্জাতিক সীমান্ত বদল করতে চায় তারা। যদিও পাকিস্তানের এই কথা মানতে নারাজ কাবুলের শাসকেরা। উল্টে পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিকে ‘সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর’ বলে বার বার উল্লেখ করে এসেছে তারা।
০৮১৯
পহেলগাঁও কাণ্ডের পর মোদী সরকার বদলার কথা ঘোষণা করতেই বাড়তি সতর্ক হয়েছে ইসলামাবাদ। ভারতীয় সীমান্তের কাছে সৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি অফিসারেরা। সীমান্ত লাগোয়া ঘাঁটিগুলিতে আমেরিকার তৈরি অত্যাধুনিক এফ-১৬ যুদ্ধবিমান নিয়ে হাজির হয়েছে পাক বিমানবাহিনী। পাশাপাশি, ভারতের উপর পরমাণু হামলার হুমকি দিয়েছেন সেখানকার একাধিক রাজনৈতিক নেতা।
০৯১৯
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনার পক্ষে প্রত্যাঘাত শানানো বেশ কঠিন। কিন্তু, আফগানিস্তান সীমান্তে অশান্তি তৈরি হলে ফৌজকে সে দিকে সরাতে বাধ্য হবে পাকিস্তান। তখন ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বা ‘এয়ার স্ট্রাইক’-এর মতো অপারেশনের সুবর্ণসুযোগ চলে আসবে ভারতীয় সেনা বা বিমানবাহিনীর হাতে। সেই কথা মাথায় রেখে তালিবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করছে নয়াদিল্লি।
১০১৯
বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, ভারতের জন্য সরাসরি ইসলামাবাদের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়াবে না তালিবান। তবে এ ব্যাপারে টিটিপিকে এগিয়ে দিতে পারে তারা। কারণ, কাবুল মুখে অস্বীকার করলেও আফগানিস্তানের পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে খাইবার-পাখতুনখোয়ার এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর একাধিক শিবির ও গুপ্তঘাঁটি। সেখান থেকে গেরিলা কায়দায় হামলা চালিয়ে পাক ফৌজের বড় ক্ষতি করতে পারে তারা।
১১১৯
গত ২৭ এপ্রিলে আফগান সীমান্তে ৫৪ জন সশস্ত্র বিদ্রোহীকে নিকেশ করা গিয়েছে বলে বিবৃতি দেয় পাক ফৌজ। ইসলামাবাদের দাবি, হিন্দুকুশের কোলের দেশটি থেকে তাঁরা খাইবার-পাখতুনখোয়ায় ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। নিহত বিদ্রোহীদের থেকে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার, গোলাবারুদ এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা।
১২১৯
ঠিক এর এক দিন আগে খাইবার-পাখতুনখোয়ায় গুলির লড়াইয়ে ১৫ জন বিদ্রোহীকে খতম করে পাক সেনা। প্রাণ হারান দুই সৈনিকও। সংবাদ সংস্থা এএফপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে দেশটির দু’টি প্রদেশে (পড়ুন খাইবার-পাখতুনখোয়া ও বালোচিস্তান) বিদ্রোহী এবং পাক নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
১৩১৯
খাইবার-পাখতুনখোয়ার পাশাপাশি বালোচিস্তানেও দিন দিন তীব্র হচ্ছে স্বাধীনতার দাবি। সম্প্রতি সেখানে পাক সেনার কনভয়ে হামলা চালান বালোচ লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। এতে অন্তত ১০ জন সৈনিকের মৃত্যুর খবর এসেছে। বিএলএ ও বালোচিস্তানের আমজনতা ইসলামাবাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে খোলাখুলি ভাবেই ভারতের সাহায্য চেয়েছে। এই ব্যাপারে কেন্দ্রের চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে দাবি তুলেছেন এ দেশের সাবেক সেনাকর্তারা।
১৪১৯
তবে পহেলগাঁও হামলার পর থেকেই ভারতীয় ফৌজের প্রত্যাঘাতের ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে ইসলামাবাদ। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা মহম্মদ আসিফ দাবি করেছেন, ‘‘আমরা আমাদের বাহিনীকে তৈরি রাখছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার সেই পথেই হাঁটছে।’’
১৫১৯
শরিফ সরকারের মন্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি, পরমাণু হামলার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অস্তিত্বের উপর যদি সরাসরি হুমকি থাকে, কেবল তখনই আণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে।’’ পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির বাহিনীর নির্দিষ্ট কিছু কোর এবং ইউনিটকে সক্রিয় হওয়ার বার্তা দিয়েছেন বলেও জানা গিয়েছে।
১৬১৯
অন্য দিকে, এই পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ ভারতকে শান্ত করতে কী কী করণীয় তা নিয়ে ভাই তথা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়কে যাবতীয় পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরই পূর্বসূরি নওয়াজ় শরিফ। তাঁর দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ় (পিএমএল-এন)-এর একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে এমনটাই জানিয়েছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’।
১৭১৯
ইসলামাবাদের একটি সূত্র জানিয়েছে, ভাই শাহবাজ়কে ‘ভারত-বিরোধী মন্তব্য’ থেকে বিরত থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন নওয়াজ়। শুধু তা-ই নয়, কূটনৈতিক পথে শান্তি ফেরানোর কথাও নাকি বলেছেন তিনি। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি পাকিস্তানের এই দুই হেভিওয়েট নেতা।
১৮১৯
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার ঘটনায় অবশ্য চিন এবং রাশিয়ার মতো নিরপেক্ষ কোনও দেশকে দিয়ে তদন্তের আর্জি জানিয়েছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের এই দাবিকে সমর্থন করেছে চিন। সংঘাতের আবহে পাক বায়ুসেনাকে ভারতীয় রাফাল যুদ্ধবিমানের সঙ্গে লড়াই করার জন্য বেজিং বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। ড্রাগন সরকারের এই পদক্ষেপ ভারতের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে, মত বিশ্লেষকদের।
১৯১৯
অতীতে তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে ভারতীয় কূটনীতিকদের বৈঠকের পর পরই অশান্ত হতে দেখা গিয়েছে পাক-আফগান সীমান্ত। পাহাড়ি এলাকার ভূ-প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়েছে টিটিপি। এ বারও টিটিপি সেই পদক্ষেপ করলে পাক ফৌজের যে কপাল পুড়বে তা বলাই বাহুল্য। পহেলগাঁও হামলাকে নিন্দা করে তালিবান কড়া বিবৃতি দেওয়ায় সেই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।