সম্প্রতি এক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী তৃতীয় শ্রেণিতে অঙ্কের পাঠ্যক্রমের ভাগটুকু করতে পারছে না। এমনকি মাতৃভাষায় লেখা তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক স্বচ্ছন্দে পড়তেও সে অসমর্থ। এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গ্রামীণ ভারতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রতি ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৭ জন ভাগ করতে পারে না, নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে ২৫ জন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির বই মাতৃভাষায় পড়তে পারে না। ২০০৫ সাল থেকে ‘প্রথম’ নামের এক অসরকারি সংস্থা গ্রামীণ ভারতের শিক্ষার হাল-হকিকত নিয়ে প্রকাশ করছে ‘অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট’। পূর্ববর্তী বছরের রিপোর্টগুলি সম্বন্ধে যাঁরা ওয়াকিবহাল তাঁরা জানেন, এই ছবি নতুন নয়, প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের অবস্থার এক ধারাবাহিক চিত্র মাত্র।
২০২৩-এর সমীক্ষা হয়েছে ২৬টি রাজ্যের ২৮টি জেলার ৩৪,০০০ শিক্ষার্থী নিয়ে। ১৪-১৮ বছরের শিক্ষার্থী, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির। তবে বয়সের মাপকাঠি বিচারে এই সমীক্ষার আওতায় এমন কিছু শিক্ষার্থী আছে, যারা সদ্য স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, স্নাতক স্তরেও শতকরা ৪৩ জন প্রাথমিক স্তরের গুণ-ভাগ করতে ব্যর্থ। সার্বিক ভাবে মাতৃভাষায় পড়ার ক্ষেত্রে মেয়েরা (৭৬%) ছেলেদের (৭০.৯%) থেকে এগিয়ে, ছেলেরা আবার পাটিগণিত ও ইংরেজি বাক্য পাঠে মেয়েদের থেকে এগিয়ে। বাজারের ফর্দ ও হিসাব করতে পারছে সমীক্ষাভুক্ত শিক্ষার্থীদের ৬০%, কিন্তু কোনও দ্রব্যের দামে ছাড় কত, তা হিসাবে সক্ষম মাত্র ৩৭%। সাধারণ বিষয় যেমন পড়া, বাক্য লেখা, যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের দক্ষতা এই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতার পঁচাত্তর পেরিয়েও এই ছবি সরকারি শিক্ষা-ভাবনার পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতাকেই তুলে ধরে।
সমীক্ষায় আলোচিত হয়েছে নানা নতুন বিষয়। যেমন প্রশ্ন করা হয়েছে পড়ুয়ারা স্কুলের বাইরে আর কী করে, টিউশনি পড়ে না কি কোনও কাজে যুক্ত, বড় হয়ে কোন পেশা বেছে নিতে চায় ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ ভারতে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৮২% মেয়ে ও ৬৪% ছেলেকে ঘরের কাজ করতে হয় বা পরিবারকে সাহায্যে শ্রম দিতে হয়। ১৪-১৮ বছরের গ্রামীণ কিশোরদের অর্ধেকেরও বেশি মাসে অন্তত ১৫ দিন বাইরে কাজ করে, এদের মধ্যে ৭৫% কাজ করে পরিবারের কৃষিজমিতে। রাজস্থান, বিহার, ঝাড়খণ্ড-সহ বহু রাজ্যে মেয়েদের ঘরের কাজের তালিকা দীর্ঘ: দূর থেকে পানীয় জল আনা, রান্নার কাঠ জোগাড়, বাড়ির শিশুর যত্ন, রান্নায় সাহায্য ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ বিড়ি বাঁধার কাজে যুক্ত, ১৪-১৫ বছরের শিক্ষার্থীদের অনেকেই এ কাজে দিনে ৪-৫ ঘণ্টা দেয়। কিছুটা স্বস্তি দেয় এই তথ্য, এই শিক্ষার্থীদের ৮৫%-এর নাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নথিভুক্ত। কিন্তু এদের একটা বড় অংশ আবার বাড়ির কাজের জন্য স্কুলে অনিয়মিত। উত্তর ভারতের বহু জায়গায় প্রধান শিক্ষকরা জানিয়েছেন, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীদের অনেকেই সপ্তাহে দুই দিনের বেশি স্কুলে আসতে পারে না। এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে ভাবনার বাইরে রেখে পাঠ্যক্রম, স্কুলের পরিকাঠামো, মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা নেহাতই পণ্ডশ্রম।
প্রথাগত শিক্ষা-ভাবনা ভাবে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের। এক ধরনের স্বল্পশিক্ষিত, সস্তা শ্রমের চাহিদা আজ সর্বত্র। সমীক্ষা কিন্তু গ্রামীণ ভারতের শিক্ষার্থীদের অন্য স্বপ্ন তুলে ধরে। তাদের ৬০% চায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়তে। সমীক্ষাভুক্ত ছাত্রদের মধ্যে সেনায় যোগ দিতে চায় সবচেয়ে বেশি (১৩.৮%), পুলিশে ১৩.৬%। মেয়েদের প্রথম পছন্দ শিক্ষকতা (১৬%), পরে চিকিৎসা (১৪.৮%) ও পুলিশ (১২.৫%)। ১৪-১৮ বছরের ছাত্রদের মধ্যে মাত্র ১.৪% কৃষিতে আগ্রহী।
এসেছে স্মার্টফোনের কথাও। প্রায় ৯০% শিক্ষার্থীর পরিবারে স্মার্টফোন আছে, ছেলেদের মধ্যে ৪৩.৭% তার ব্যবহার জানে, মেয়েদের ১৯.৮%। স্মার্টফোন-ব্যবহারকারীদের ৯০% সমাজমাধ্যমে আছে। আশার কথা, স্মার্টফোন-ব্যবহারকারীদের দুই-তৃতীয়াংশ পড়াশোনার নানা কাজে তা ব্যবহার করে: ভিডিয়ো দেখা, নোট সংগ্রহ, পড়াশোনা সংক্রান্ত প্রশ্নের নিরসনে। এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ফর্ম ভরা, বিল জমা বা রেলের টিকিট বুকিংয়ের মতো অনলাইন কাজ করতে পারে। ৭০% আন্তর্জাল ব্যবহার করে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারে, দুই-তৃতীয়াংশ অ্যালার্ম দিতে পারে, এক-তৃতীয়াংশ গুগল ম্যাপ ব্যবহার জানে।
নতুন শিক্ষানীতিতে ২০২৫-এর মধ্যে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা ও গণিতের দক্ষতা অর্জনই প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু সে এখনও বহু দূর। তারও বড় কথা, শিক্ষার্থীরা যে আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে, তার সমাধান কী। শিক্ষাকে জীবনের চাহিদার সঙ্গে যুক্ত করা তখনই সম্ভব, যখন শিক্ষার্থী তার প্রার্থিত মান অর্জন করতে পারবে। কেউ বলতে পারেন, গুণ-ভাগ না করতে পারা, মাতৃভাষায় পড়তে না পারা মানেই কি সম্ভাবনার শেষ! সমীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়েছিল, ১৫ লিটার জল শোধনে ৩টি ক্লোরিন ট্যাবলেট লাগলে ২৫ লিটার জলে ক’টা লাগবে, অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী ঠিক উত্তর দিতে পারেনি। সব সম্ভাবনা শেষ না হয়ে গেলেও এটা বোঝা যায়, আমাদের শিক্ষানীতি পড়াশোনার মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। রাষ্ট্রের দায় তাই থেকেই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy