আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত এক বারও প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে গেলেন না। অথচ কুম্ভমেলা চলাকালীন এগারো দিন পশ্চিমবঙ্গে কাটালেন। সাম্প্রতিক অতীতে আরএসএস-এর কোনও সরসঙ্ঘচালক এত দীর্ঘ সময় পশ্চিমবঙ্গে কাটাননি। এর অর্থ কী? নাগপুরের পাখির চোখ কি আগামী বছরের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট?
প্রশ্ন শুনে উত্তরপ্রদেশের আরএসএস-এর এক প্রান্ত সচিব বলছিলেন, সরসঙ্ঘচালকের পশ্চিমবঙ্গের সফরসূচি গত মার্চেই ঠিক করা ছিল। তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। তবে এ কথা ঠিক, সঙ্ঘ এ বার কোমর বেঁধে পশ্চিমবঙ্গের ভোট-ময়দানে নামবে। অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের মধ্যে অঙ্গ, কলিঙ্গ যদি জয় করা যায়, তা হলে বঙ্গ নয় কেন?
অঙ্গ অর্থাৎ বিহারে বিজেপির জোট সরকার চলছে। চলতি বছরের শেষে বিধানসভা ভোটে বিজেপি ফের বিহার জয়ের আশা করছে। গত বছর বিজেপি প্রথম কলিঙ্গ অর্থাৎ ওড়িশায় ক্ষমতায় এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের বাকি প্রতিবেশী রাজ্যগুলির মধ্যে অসমের মুখ্যমন্ত্রীর গদিও এখন বিজেপির দখলে। ঝাড়খণ্ডে বর্তমানে বিজেপি বিরোধী সরকার চললেও অতীতে বিজেপি সেখানে ক্ষমতায় ছিল। অথচ অতীতের মহাকরণ বা অধুনা নবান্নে কখনও গেরুয়া রং লাগেনি।
আরএসএস-এর ওই প্রবীণ নেতা বলছিলেন, আসলে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ, রাজনীতি অন্য রকম। সেখানে আর পাঁচটা রাজ্যের কৌশল চলে না।‘আর পাঁচটা রাজ্যের কৌশল’-এর অর্থ হিন্দুত্ববাদের চেনা ছক। মুসলিমদের সম্পর্কে আতঙ্ক, বিদ্বেষ তৈরি এবং গোটা হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করে বিজেপির ঝুলিতে নিয়ে আসা। পশ্চিমবঙ্গে এখনও এই কৌশল পুরোপুরি কাজ করেনি। কিন্তু মুশকিল হল, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ‘ক্ষমতায় এলে মুসলমান বিধায়কদের চ্যাংদোলা করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হবে’র মতো হুঁশিয়ারি থেকে বার হতে পারেন না। ফলে বার বার ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ভোট তৃণমূল সরকার সম্পর্কে বিক্ষুব্ধ হলেও বিজেপির থেকে দূরে সরে যায়।
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি সম্পর্কে নিজেকে মেলাতে না পারার এই সমস্যায় শতবর্ষে পা দেওয়া আরএসএস বরাবরই ভুগেছে। ১৯৩৯ সালে কলকাতার মানিকতলার তেলকল মাঠে আরএসএস-এর প্রথম শাখা চালু করেছিলেন মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর। আরএসএস-এর সেই ‘গুরু গোলওয়ালকর’ এ জন্য হিন্দু নববর্ষের দিন বেছেছিলেন। পয়লা বৈশাখের কথা ভাবেননি। গোলওয়ালকর পরে মধুকর দত্তাত্রেয় দেওরাস, দত্তোপন্থ বাপুরাও ঠেঙ্গাড়ি, একনাথ রানাডের মতো আরএসএস শীর্ষনেতারা বঙ্গে সঙ্ঘের শিকড় ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। দেওরাসই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে আরএসএস-এর কাছে টেনে এনেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ বিজেপির আদি অবতার ভারতীয় জনসঙ্ঘের নেতৃত্ব দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্ঘ সম্পর্কে বঙ্গের সিংহভাগ মানুষের অ্যালার্জি থেকেই গিয়েছে।
মোহন ভাগবত হয়তো আরএসএস-এর শতবর্ষে বাঙালিদের মনে আরএসএস সম্পর্কে এই অ্যালার্জিই দূর করতে চাইছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব বর্ধমানের জনসভার ভাগবত তাই বাংলার মানুষকে আরএসএস-এ যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাইরে থেকে মন্তব্য করার বদলে আরএসএস-এ যোগ দিয়ে দেখুন, তারা কী করে। আরএসএস-এর সঙ্গে মত বিনিময় করুন। আরএসএস-এর সদস্য হতে গেলে কোনও টাকা লাগে না। একবার সদস্য হলে, আজীবন থেকে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। কেউ চাইলে পরে যখন ইচ্ছে বেরিয়ে যেতে পারেন।
এতে কোনও ভুল নেই, গত পনেরো বছরে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস তথা গেরুয়া শিবিরের প্রভাব বেড়েছে। রাজ্যের রাজনীতি ও সমাজের অলিগলিতে সিপিএম তথা বামেদের রাশ যত আলগা হয়েছে, ততই গেরুয়া শিবিরের শিকড় ছড়িয়েছে। এই ক্ষোভ থেকেই হয়তো মহম্মদ সেলিমের মতো সিপিএমের নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘আরএসএস-এর সৃষ্টি’ বলে অভিযোগ তোলেন, আরএসএস বামেদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরাতে তৃণমূল নেত্রীকে সাহায্য করেছিল। সিপিএমের ক্যাডাররা বছরের পর বছর নিঃশব্দে পাড়ায় পাড়ায় আরএসএসের শাখা বিস্তারে বাধা তৈরি করে গিয়েছেন। তৃণমূলের আক্রমণে সিপিএমের সংগঠন যত দুর্বল হয়েছে, আরএসএস-এর ততই শিকড় ছড়ানো সহজ হয়েছে। সেই কারণেই আরএসএস-এর শাখার সংখ্যা রাজ্যে গত পনেরো বছরে পাঁচ গুণ বেড়েছে।
প্রশ্ন হল, আরএসএস-এর এই প্রভাব বৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি কি আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে?এখনও বিজেপির কোনও জাতীয় বা রাজ্য নেতা বুক ঠুকে সেই দাবি করতে পারছেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার সম্পর্কে মানুষের নালিশ কম নেই। অথচ তার সুবিধা বিজেপি পাচ্ছে না। তার একটি প্রধান কারণ, বিজেপি তথা আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের জন্য সেই হিন্দুত্ববাদ ও ভোটের মেরুকরণের চেনা ছকেই বার বার ফিরে যাচ্ছে। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কখনও বিধানসভার সামনে গেরুয়া পাগড়ি পরে মন্ত্র আওড়াচ্ছেন। কখনও বিধানসভা থেকে মুসলিম বিধায়কদের ছুড়ে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের যে ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য এবং তাকে ঘিরে বাঙালিয়ানার গর্ব, সেই সরল সত্যটি বিজেপি, আরএসএস নেতারা যেন বুঝেও বুঝে উঠতে পারছেন না।
মোহন ভাগবতের বঙ্গ সফরের পরেই মার্চের গোড়ায় হাওড়ায় আরএসএস-এর সমন্বয় বৈঠক বসেছিল। তাতে দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রামদত্ত চক্রধর ও অরুণ কুমার যোগ দিতে গিয়েছিলেন। বিজেপির ত্রিমূর্তি সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষও হাজির ছিলেন। দিলীপ, সুকান্তের মতো আদি বিজেপি ও তৃণমূল থেকে আসা শুভেন্দুর মতো নব্য বিজেপির মধ্যে সেতুবন্ধন বড় চ্যালেঞ্জ। সমন্বয় বৈঠক থেকে ইঙ্গিত, আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদের মূলমন্ত্রকে পুঁজি করে হিন্দু রাষ্ট্র ও হিন্দুদের রক্ষার বার্তা নিয়ে এগোতে চাইছে। যদিও বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মনে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা তত সফল হয়নি। তা সত্ত্বেও আরএসএস ফের রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীর আয়োজনে জোর দিতে চাইছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ ছিল, থাকবে। তবে তার সঙ্গে তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতির সঙ্গে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধকেও আরএসএস প্রচারে আনতে চাইবে। আর জি করের ঘটনায় নির্যাতিতার পরিবার দিল্লিতে মোদীর দেখা না পেলেও ভাগবত তাঁদের সঙ্গে কলকাতায় দেখা করেছেন।
মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও শেষে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল আরএসএস-এর নীরব প্রচার। গত লোকসভা নির্বাচনে আরএসএসের নিষ্ক্রিয়তার কারণে গোটা দেশেই বিজেপির আসন কমেছিল। পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির আধ ডজন আসন কমেছিল। মোদী সরকার সম্পর্কে একটা ‘গেল, গেল’ আবহ বিরোধীরা তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন। মহারাষ্ট্র-হরিয়ানা-দিল্লি জয়ের পরে তা এখন অতীত। তার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য আরএসএস-এর। হয়তো মোদী সে জন্যই এখন নিয়মিত আরএসএস-এর ঢালাও প্রশংসা করছেন। গত দশ বছর প্রধানমন্ত্রীর গদিতে থাকলেও তাঁর মুখে এই প্রকাশ্যে প্রশস্তি শোনা যায়নি।
এখন দেখার বিষয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’, ‘হিন্দুদের সঙ্কট’, দুর্নীতি, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সম্পর্কে প্রচার চালিয়ে আরএসএস বিজেপিকে বঙ্গের গদিতে পৌঁছে দিতে পারে কি না। সিপিএমের শীর্ষনেতা প্রকাশ কারাট ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আরএসএস পশ্চিমবঙ্গকে সাম্প্রদায়িক শক্তির ভরকেন্দ্র করে তুলতে চাইছে। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিবাদ ও হিংসা তৈরির চেষ্টা করবে। হিন্দি বলয়ে বিজেপি-আরএসএস বরাবরই এই চেনা ছকেই হেঁটেছে। তৃণমূল নেত্রী সেই চেনা ছক উল্টে দিতে পারেন কি না, সেটাও দেখার বিষয় বটে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)