অপেক্ষায়: আবাসন প্রকল্পের তালিকায় রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের তেত্রিশ লক্ষ মানুষ। মালঙ্গপাড়া, স্বরূপনগর —ফাইল চিত্র।
গরিবের ঘর যেমন হয়, তেমনই ঘরখানি। বাঁশের কাঠামোর উপরে প্লাস্টিক আর টালির ছাদ, দরজা এমন যে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। তবে বসিরহাটের স্বরূপনগরে এই ঘরটির সামনে দাঁড়ালে এমনিই মাথা নিচু হয়ে আসে। এখানে থাকতেন রেবা বিশ্বাস রায়, যাঁর শেষ ডিউটি ছিল ‘আবাস প্লাস’-এর তালিকা যাচাই করা। রাজ্যের দু’লক্ষাধিক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, পঞ্চান্ন হাজার আশাকর্মীর মতো, রেবারও ‘না’ বলার জো ছিল না। রেবার ভ্রাতৃবধূ পাপিয়া জানালেন, ঘরের কাজ করতে করতে প্রায়ই শুনতে পেতেন ফোনে রেবা বলছেন, “মনে হয় আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।” ১২ ডিসেম্বর, ২০২২, রেবার ঝুলন্ত দেহ মিলেছিল বাড়ির পিছনের কাঁঠাল গাছে।
তেমনই শূন্যে ঝুলছে রাজ্যের তেত্রিশ লক্ষ মানুষের ভাগ্য, যাঁদের অধিকাংশ বাস করছেন দরমা, টিন, কাদায়-গাঁথা ইটের দেওয়ালের ঘরে। এগারো লক্ষ বাড়ি হওয়ার কথা ছিল এ বছরই। আবাস প্রকল্পে বেনিয়মের অভিযোগে কেন্দ্র টাকা আটকে দিয়েছে। অন্যান্য রাজ্য যখন ২০২৪ সালের মধ্যে ‘সকলের জন্য আবাস’-এর লক্ষ্যে এগোচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তি নেতাদের কলহ, দরিদ্রের দীর্ঘশ্বাস আর আশা-অঙ্গনওয়াড়িদের বিপন্নতা। “এখনও লোকে বলে, তোর জন্য আমার বাড়ি কাটা গিয়েছে, তোকে ছাড়ব না,” বললেন স্বরূপনগরের এক আশাকর্মী।
গ্রামের তৃণমূল নেতারা টাকার বিনিময়ে তালিকায় নাম তুলেছেন, দলও তা স্বীকার করছে। স্বরূপনগর পঞ্চায়েত সমিতির জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ কর্মাধ্যক্ষ দুলাল ভট্টাচার্য বললেন, “যে পঞ্চায়েত সদস্যরা এ সব করেছে, তারা এ বার টিকিট পাবে না।” কত জন বাদ যাবে তা হলে? “সত্তর শতাংশ।” মানে, দুর্নীতিটাই নিয়ম হয়ে উঠেছিল। তবে এই বিপুল ব্যর্থতার জন্য তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান, বা বুথ কমিটির সচিবের দিকে তোপ দাগা হল বন্দুক তুলে ছুঁচো মারার শামিল। তাকাতে হবে কলকাতা, দিল্লির দিকে। গৃহহীনের বঞ্চনা, আর মহিলা কর্মীদের উৎপীড়ন, এই দুইয়েরই উৎস রাজ্য ও কেন্দ্রের আধিকারিকদের কিছু ‘অতুলনীয়’ নির্দেশ। ২ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের এক অতিরিক্ত সচিব যখন তালিকা যাচাইয়ের কাজ চাপিয়েছিলেন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে, তখনই ফাঁস পড়েছিল দড়িতে। তবে দড়ি পাকানো শুরু হয়েছিল আরও আগে, ২০১৭ সালে। সে বছর কেন্দ্র জারি করেছিল গৃহপ্রার্থীর তালিকায় নাম ঢোকানোর এমন এক কাছাকোঁচা-খোলা পদ্ধতি, সরকারি প্রকল্পের ইতিহাসে যা বেনজির।
কেন, বুঝতে হলে তাকানো চাই অতীতের দিকে। ২০০৬ সালে এ রাজ্যে এপিএল-বিপিএল সমীক্ষা হয়। তার ভিত্তিতে যাঁরা গৃহহীন ও দরিদ্রতম, তাঁদের আগে রেখে আবাসের তালিকা তৈরি হয়। ২০১৫ পর্যন্ত সেই তালিকা অনুসারে (ইন্দিরা আবাস যোজনা) ঘর দেওয়া হয়েছিল। ২০১৩-১৪ সালে করা হয় আর্থ-সামাজিক ও জাতি সমীক্ষা। তার ভিত্তিতে ফের তালিকা তৈরি হয়, তা অনুসারে (প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, তথা ‘বাংলা আবাস যোজনা’) ঘর দেওয়া হয় ২০১৬-২০২১। এই দু’টি প্রকল্পেই নিয়ম ছিল, ব্লক অফিস প্রাপক তালিকা তৈরি করে পাঠাত গ্রাম পঞ্চায়েতে। গ্রামবাসী আপত্তি-আবেদন জানানোর সুযোগ পেতেন। চূড়ান্ত তালিকা পেশ হত গ্রামসভায়। গ্রামসভা বস্তুটি অবশ্য ভারতের গণতন্ত্রের মতোই— নামে আছে, কাজে নেই। তবু পেটোয়া ‘গ্রামসভা’ যা পাশ করত, তা গ্রামবাসীর দেখাশোনা তালিকা।
এই দু’টি প্রকল্পেও ‘ও পেল, আমি পেলাম না’ অভিযোগ উঠেছে, তবে সেই ক্ষোভের কারণ সরকারি নিয়মের নিগড়ও বটে। কেন গৃহহীন ওবিসি পড়বে ভাঙা-ঘরের মালিক দলিতের পিছনে, কে বোঝাবে? সরকারি ‘কোটা’ বিপন্নের চোখে অবিচার। এই দুই আবাস প্রকল্পে প্রায় ঘোষিত দুর্নীতি ছিল কাটমানি— বাড়ি তৈরির টাকা এলে নেতার খাঁই মেটাতে হত গরিবকে। তালিকায় কারচুপি হয়নি, এমন নয়— মিথ্যা তথ্য দিয়ে, বা সমীক্ষকের ভুলে অযোগ্যও স্থান পেয়েছে। তবু তথ্যের গ্রন্থি খুলে গরিবকে বাদ দেওয়া সোজা ছিল না।
‘আবাস প্লাস’ সেই আঁটুনি আলগা করে দিল। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক জারি করল এক অদ্ভুত নির্দেশ— যাঁরা বাড়ি চান, তাঁদের বর্তমান আবাসের সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে, আপলোড করে দিতে হবে কেন্দ্রের পোর্টালে। জানামাত্র নেতা, চেলারা কেউ গোয়ালঘরের সামনে, কেউ ত্রিপল টাঙিয়ে ছবি তোলালেন। অধিকাংশ গ্রামবাসী, বিরোধী সদস্যরা জানতেই পারেননি কী হচ্ছে। “আমার সংসদে ছবি তোলা হয়েছিল, আমি জানিই না,” বললেন মকফুর রহমান, স্বরূপনগরের গোবিন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য। ব্লক আধিকারিকরা একান্তে স্বীকার করলেন, কেবল ছবির ভিত্তিতে প্রাপকদের তালিকা বানাবে কেন্দ্র, এ কথা মাথাতেই আসেনি তাঁদের।
অথচ, এমন ভাবেই তালিকা হল। অতীতের আবাস যোজনা, এবং জব কার্ডের তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্র সেই তালিকা থেকে বাদ দিল কিছু নাম। এই ডেটা-সর্বস্ব ‘অটো-এক্সক্লুশন’-এর জেরে যাঁরা বাদ পড়লেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগই পেলেন না তাঁরা। ঊনপঞ্চাশ লক্ষ প্রার্থীর ‘সংশোধিত’ তালিকা এল রাজ্যের কাছে। দুর্নীতির পাঁকে চোবানো সেই তালিকা নিয়ে গ্রামে যে যাবে, তার অবস্থা কী হবে, আধিকারিকরা তা ভালই বুঝেছিলেন। তা হলে তালিকা যাচাই করবে কে?
কেন, মেয়েরা আছে! হতে পারে ওদের কাজ গর্ভবতী, প্রসূতি ও শিশুদের স্বাস্থ্যবিধান। আর আশাকর্মী তো ‘স্বেচ্ছাসেবী,’ কর্মীও নয়। তাতে কী? চাকরি খাওয়ার ভয় তো হাতে আছে! মাঝরাতেও আশাকর্মীদের সরকারি গাড়ি উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে ভিনপাড়ায়, ‘ভেরিফিকেশন’ শেষ হয়নি বলে। রাজ্যের ‘কার্যপ্রণালী’ (এসওপি) নিচু স্তরের সরকারি কর্মীদেরও যাচাইয়ে নিতে বলেছিল। বাস্তবে আশি শতাংশ যাচাই কর্মীই ছিল মেয়ে।
মজার কথা, ‘আবাসবন্ধু’, ‘ভিআরপি’ ‘ভিসিটি’ প্রভৃতি যে চুক্তি-কর্মীরা গোয়াল-সমুখে ‘গৃহহীন’ নেতার ছবি তুলে ঘুষের গুড়টি খেয়েছিল, তারা প্রায় সবাই পুরুষ। মার খেতে ডাক পড়ল মেয়েদের।
কাকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা প্রশাসনের, আর সুরক্ষা দেয় কাকে!
ব্লক, জেলা স্তরের আধিকারিকরাও যাচাই করতে গিয়েছেন বইকি, সঙ্গে পুলিশ নিয়ে। দেখনদারি ‘গ্রামসভা’-য় পাশ করিয়ে এনেছেন তালিকা। সত্যিই গ্রামের সব মানুষকে ডাকলে তালিকা পাশ অসম্ভব হত, বলছেন একাধিক বিডিও। তবু দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে, সব হুমকি, মারধরের সামনে দাঁড়িয়ে ওই মেয়েগুলোই প্রায় চল্লিশ শতাংশ ভুয়ো নাম বাদ দিয়েছে তালিকা থেকে। সরকারের ছাব্বিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাঁচবে তাতে। বিনিময়ে পেয়েছে কত? শূন্য। অঙ্গনওয়াড়ি, আশাকর্মীদের এ কাজের জন্য এক পয়সাও দেয়নি রাজ্য।
এ রাজ্যে প্রকৃত বাস্তুহারা হল প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র আর সহভাগী পরিকল্পনার আদর্শ। না হলে কি পঞ্চায়েত— তিন দশক ধরে যার অর্ধেক আসন মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত— মেয়েদের প্রতি এমন নিষ্ঠুর হতে পারত? গরিবের দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে দলীয় রাজনীতির আর সম্পর্ক নেই, তাই নির্লজ্জ নেতার লালাসিক্ত তালিকা পাঠাচ্ছে রাজ্য, আর তা আটকে দিয়ে নিরাশ্রয়ের যন্ত্রণা আরও দীর্ঘ করছে কেন্দ্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy