ধরুন, দাঁতের ব্যথায় জেরবার আপনি দন্ত চিকিৎসকের চেম্বারে বসে আছেন, এমন সময় আক্ষরিক অর্থেই আকাশ থেকে একটা জ্বলন্ত ধাতব পাত ছাদ ফুটো করে ঢুকে পড়ল অতর্কিতে। অথবা, গ্রামের শান্ত পরিবেশে দু’দিন থাকতে গিয়েছেন— আবারও আকাশ ফুঁড়ে এক বিশাল আকৃতির জ্বলন্ত ধাতব পিণ্ড আছড়ে পড়ল মাটিতে। ওজন প্রায় পাঁচশো কিলোগ্রাম, ব্যাস আট ফুট।
কষ্টকল্পনা নয় কিন্তু। দু’টি ঘটনাই বাস্তব। প্রথমটি আমেরিকার পূর্ব টেক্সাস এলাকার ঘটনা, ২০০৩ সালে কলাম্বিয়া স্পেস শাটল দুর্ঘটনায় পড়ে টুকরো হয়ে যাওয়ার পর। দ্বিতীয়টি মাত্র কয়েক দিন আগে ঘটল— কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে। অনুমান করা হচ্ছে, বস্তুটি কোনও পরিত্যক্ত কৃত্রিম উপগ্রহের অংশবিশেষ। ভারতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালের ২ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে আকাশ থেকে অনেক টুকরোটাকরা এসে পড়েছিল। একটি বিশাল গোল আকৃতির ধাতব পিণ্ডও ছিল মহাকাশ থেকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে ঢুকে পড়া বস্তুগুলির মধ্যে। অনুসন্ধান শুরু করে ইসরো। জানা গিয়েছে, সম্ভবত সেটি একটি চিনা রকেটের তৃতীয় দশার অংশবিশেষ।
১৯৫৭ সালে স্পুটনিক-১ উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাকাশ অভিযান শুরু। এর পর থেকে গত সত্তর বছরে কম-বেশি ছাপ্পান্ন হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ বা সমতুল বস্তু পৃথিবীর চার দিকে নানা কক্ষপথে ঘুরেছে। এর অর্ধেকেরই ব্যবহারযোগ্যতা ফুরিয়েছে, ফলে সেগুলি পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ঘুরে চলেছে। আবার ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনায় উদ্ভূত বিভিন্ন আকারের বস্তুও আছে তালিকায়।
আকাশ কোথায় শেষ আর মহাকাশ কোথা থেকে শুরু, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি ধরে নেওয়া হয়, ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে ষাট মাইল বা একশো কিলোমিটার দূরত্বে যে গোলাকার কারমান রেখা টানা হয়, তার পরেই মহাকাশ। পৃথিবীকে ঘিরে নানা কক্ষপথে বিভিন্ন দেশের উপগ্রহ ঘুরছে। প্রায় ২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত আছে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন কক্ষ বা লো আর্থ অরবিট, এর উপর ৩৫০০০ কিলোমিটার অবধি মধ্যম শ্রেণির কক্ষ, আর তার উপরে ৪২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভূসমলয় ও অন্যান্য উচ্চ কক্ষগুলি। বিভিন্ন দেশের মহাকাশ সংস্থাগুলির সমীক্ষা অনুযায়ী, আনুমানিক ১৪,০০০ উপগ্রহ এই মুহূর্তে ভূপৃষ্ঠের কাছের কক্ষগুলিতে ঘুরছে।
নাসা-র বিজ্ঞানী ডোনাল্ড জে কেসলার ১৯৭৮ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, সহলেখক বার্টন জি কুর প্যাল। মহাকাশে আবর্জনা কী হারে বাড়ছে এবং মানবসভ্যতার অস্তিত্বের পক্ষে তা কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, তার ভবিষ্যৎ-চিত্র তুলে ধরা হয় এই নিবন্ধে। পারমাণবিক শক্তিবিকাশে নিউক্লিয় বিভাজনের ক্ষেত্রে এক থেকে বহু বিক্রিয়া ঘটানোয় বিশেষ ভূমিকা নেয় চেন প্রক্রিয়া বা ক্যাসকেডিং। ঠিক একই রকম ভাবে মহাকাশে ভাসমান নানা বস্তুর সংঘর্ষ হলে চেন প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে অনুমান করা হয়। এমন হতে পারে, পৃথিবীকে ঘিরে এই সব নানা আকারের আবর্জনা মেঘের মতো একটি বলয় তৈরি করে দৃশ্যমানতা কমিয়ে দেবে।
গ্র্যাভিটি সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখা যায়, রাশিয়ার ছোড়া মিসাইল একটি পরিত্যক্ত উপগ্রহের উপরে আঘাত করার সময় চেন প্রক্রিয়ায় বহু উপাংশ তৈরি হয়। যদিও বাস্তবে এমন কেসলার প্রভাব অনুঘটিত হওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার— কয়েক দশক লাগতে পারে। শুধু সিনেমা-সিরিজ় বা উপন্যাসে নয় অবশ্য, বাস্তবেও দেখা গিয়েছে কেসলার প্রভাব। এ-যাবৎ সাতটি ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি সাইবেরিয়ার আকাশে মাটি থেকে ৭৭৬ কিলোমিটার উপরে একটি আমেরিকান যোগাযোগ উপগ্রহ ইরিডিয়াম-৩৩’কে মুখোমুখি ধাক্কা মারে একটি রাশিয়ান মিলিটারি উপগ্রহ কসমস ২২৫১। প্রায় ২৩০০ টুকরো তৈরি হয়, যেগুলির অনেক টুকরো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে ভস্মীভূত হয়। বাকিরা রয়েই গেছে।
সুতরাং, এই সব আবর্জনা কমাতেই হবে। এই বিষয়ে এখন কম-বেশি সব জাতীয় মহাকাশ সংস্থাই উদ্যোগ করছে। ভবিষ্যতে রকেট উৎক্ষেপণ এবং মহাকাশ অভিযান এমন ভাবে হবে, যাতে অভিযানজনিত আবর্জনা একেবারেই জমতে না পারে মহাকাশে। ইসরোর অঙ্গীকার, ২০৩০ সালের মধ্যে আবর্জনাহীন মহাকাশ কর্মসূচিতে সফল হবে আমাদের দেশ। ভারতও অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে লেসার রশ্মি প্রয়োগ ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে মহাকাশ আবর্জনা ক্রমশ কমিয়ে ফেলতে অগ্রণী ভূমিকা নেবে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা একটাই— শক্তিধর দেশগুলির যুদ্ধের জিগির তোলা নানা গোপন কর্মকাণ্ড। যেমন, সম্প্রতি একটি আন্টি স্যাটেলাইট পরীক্ষা। ২০০৭ সালে চিনের ফেং ইয়ুন ১সি উপগ্রহ ভেঙে টুকরো টুকরো করা হলে মহাকাশে আবর্জনা হঠাৎ বেড়ে যায় বহুলাংশে— প্রায় ২৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ওই সব রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা মানবজাতির পক্ষে একমাত্র আশা।
পদার্থবিদ্যা বিভাগ, সেন্ট জ়েভিয়ার’স কলেজ, কলকাতা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)