এই সঙ্কট সময়ে এই ছবিটা সম্ভবত হাজার-হাজার শব্দ বলে গেল। ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
এই ছবিটা দেখুন। যে ছবি দিয়ে এই লেখা শুরু হচ্ছে। যে ছবির জন্য।
আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা দখল, কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে অবিশ্রান্ত ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ, পঞ্জশির দখলে লড়াই, সাধারণ আফগানিদের আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা। কাবুলে আটকে-পড়া ভারতীয়দের উদ্বেগ। অফিসটাইমের লোকাল ট্রেনে ওঠার মতো করে বিমানে ওঠার জন্য দেশত্যাগে মরিয়া মানুষের দঙ্গল। কাবুলের আকাশে অতিকায় বিমান থেকে খসে পড়া বিন্দু বিন্দু মানুষের ফুটেজের জটলা।
তার মধ্যে এই ছবিটা ভেসে এল ইনস্টাগ্রামে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অ্যাকাউন্টে। ছবিটা এক ঝলক দেখে ধাক্কা লাগল। এই পেশায় আসা ইস্তক শুনেছি, একটা ছবি হাজার শব্দের সমান কথা বলে। আ সিঙ্গল ফটোগ্রাফ টেল্স আ থাউজ্যান্ড ওয়ার্ডস। এই সঙ্কট সময়ে এই ছবিটা সম্ভবত হাজার-হাজার শব্দ বলে গেল।
ছবিটা তুলেছেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফটোগ্রাফার জ্যাসপার ডুয়েস্ট। কোনও এক সকালে তাঁর শিশুকন্যার হাত ধরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন জ্যাসপার। হাঁটতে হাঁটতেই তাঁদের চোখে পড়ে রাস্তায় এক একরত্তি ফিঞ্চ পাখির প্রাণহীন দেহ। জ্যাসপারের কন্যা দ্রুত নিজের ডিসপোজেব্ল মাস্ক দিয়ে ঢেকে দেয় চডুইয়ের সাইজের পাখির শরীর। যেন ঘুমোনর সময় পরম আদরে গা ঢেকে দেওয়া কম্বলে। যেন ওই ওমটুকু তাকে ছেড়ে না যায়। পরে ফিঞ্চ পাখিটিকে তাঁদের বাড়ির কাছে মাটি দেন জ্যাসপার এবং তাঁর কন্যা।
‘পড়ে-থাকা’ বেওয়ারিশ পাখির দেহ থেকে মমতা-সম্পৃক্ত মাস্ক-ঢাকা শান্তি শয়ানের ছবিটা তুলে রেখেছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফটোগ্রাফার জ্যাসপার। সম্প্রতি ‘ওয়ার্ল্ড ফটো ডে’ উপলক্ষে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কর্তৃপক্ষ সেখানে কর্মরত ফটোগ্রাফারদের বলেছিলেন, সহকর্মীদের তোলা সেরা ছবিটি বেছে নিতে। জ্যাসপারের তোলা মাস্ক-ঢাকা পাখির দেহের ছবিটি বেছে নিয়েছেন তাঁর এক সহকর্মী। যে ছবি এই সঙ্কটসময়ে এক ভিনদেশির কানে কানে হাজার-হাজার শব্দ বলে গেল।
কী বলে গেল?
কেন বেছে নিলেন জ্যাসপারের তোলা ছবি? তাঁর সহকর্মী লিখেছেন, ‘এই ছবিটা আমাকে বলে, জীবন কত ভঙ্গুর আর অসহায়। কিন্তু তার পাশাপাশিই এই ছবি আমায় আরও কিছু বলে। ওই মাস্কটা আমাদের সামনে মানবসভ্যতার ইতিহাসের এই সময়টাকে ধরে রাখে। কিন্তু তার মধ্যেও একটা কাব্যিক আর শাশ্বত অনুরণন দেখায়। যে ভাবে একটা ডিসপোজেব্ল মাস্ক দিয়ে নিষ্প্রাণ দেহটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে, সেই প্রতীকী দৃশ্য আমায় এই অস্থির সময়, করোনাভাইরাস আর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার পাশাপাশিই মানবতা, ভালবাসা, মায়া, মমতার একটা আশাবাদও বয়ে আনে।’
ছবিটা দেখতে দেখতে আর জ্যাসপারের সহকর্মীর মন্তব্য পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, ঠিকই তো! করোনার ভয়ে কুঁকড়ে-থাকা এই জীবন তো কেউ ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না রাতের অন্ধকার চিরে অহরহ অ্যাম্বুল্যান্সের মাথায় বিকনের ঝলকানি আর হুটারের শব্দ। ভুলতে পারব না মাস্ক-পরা সারি সারি মুখের সারি। ভুলতে পারব না প্রিয়জনের থেকে দূরত্ব। ভুলতে পারব না আশপাশের কিছু মানুষের বিনা নোটিসে শবদেহ হয়ে যাওয়া। ভুলতে পারব না গঙ্গায় ভেসে-আসা শ’য়ে শ’য়ে লাশ। ভুলতে পারব না পরিজনকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়ে-বেড়ানো রিক্ত, দীর্ণ, অসহায় সেই সব মুখ। ভুলতে পারব না লক্ষ লক্ষ নাচার পায়ে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতে-থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের দল। ভুলতে পারব না বাস টার্মিনাসের খোঁয়াড়ে-ভরা চিলুবিলু মানুষের উপর স্যানিটাইজারের বৃষ্টি। শহরে ঢুকতে দেওয়ার আগে শোধন। এখনও মাথার মধ্যে ভিড় করে আসে তাদের নিঃশব্দ পদধ্বনি। চোখ বুজলে ভেসে আসে ফুটপাথে বা অ্যাম্বুল্যান্সের পাদানিতে দম আটকে বিস্ফারিতনেত্র কিছু মুখের সারি। ভেসে আসে ফুসফুসে শ্বাসবায়ুটুকু ধরে রাখার জন্য তাদের গোঙানিটুকু।
ঠিক তখনই খবর আসে, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে রিপোর্ট দিয়ে বলেছে, অক্টোবরে তুঙ্গে পৌঁছবে করোনার তৃতীয় ঢেউ। বাচ্চা-বুড়ো কেউ রেহাই পাবে না তার থেকে। সেই বিপর্যয়ের দিন গুনতে গুনতে মনে পড়ে অগ্রজ হিতৈষীর সাবধানবাণী— এই সময়টা এমনই যে, যদি তুমি পাঁচ’শ মানুষকে ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনে থাকো, দেখবে তাদের মধ্যে অন্তত দশজন থাকবে না। কিন্তু আসল কথাটা হল, তুমি জানো না, সেই দশটা লোক কারা! কোন দশটা লোকের নাম তোমার ফোনবুক থেকে ডিলিট করে দিতে হবে। কোন দশটা লোকের সঙ্গে তোমার শেষবার কথা বলা হয়ে গিয়েছে!
মনে মনে চারপাশে তাকাই। মনে হয়, সত্যিই তো! কারা সেই দশজন? বা বিশজন। অথবা তিরিশ! মাথা ভোঁ-ভোঁ করে। জিভে তিক্ত, কষায় স্বাদ। ভোম্বল লাগে।
তখনই ইনস্টাগ্রামে আচম্বিতে ভেসে আসে ডিসপোজেব্ল মাস্ক ঢাকা দেওয়া অ্যাসফল্টের রাস্তায় একরত্তি পাখির নিষ্প্রাণ দেহ। মনে হয়, জীবনের উষ্ণতাটুকু চলে যেতে যেতেও কোথাও একটা তাকে এখনও আঁকড়ে রেখেছে। অনন্তশয্যায় অনন্তঘুমে চলে গেলেও তাকে ছেড়ে যায়নি ওই ওমটুকু। মনে পড়ে অসুস্থদের বাড়িতে রাতবিরেতে ওষুধ আর অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া কিছু নেই-আঁকড়া ছেলেপুলের কথা। মনে পড়ে করোনা রোগীর বন্ধ দরজার সামনে দিনের পর দিন খাবার রেখে আসা পড়শির কথা। মনে হয়, সেই দেবদূতেরা এখনও কোথাও না কোথাও আছেন নিশ্চয়ই। যাঁরা নিষ্প্রাণ দেহের যাই-যাই উষ্ণতাটুকু ধরে রাখার জন্য বয়ে নিয়ে যাবেন মমতার ওম। যেমন এই পৃথিবীর কোথাও এক হাঁটাপথের পাশে কোনও এক শিশু কোনও এক পাখির দেহ পরম যত্নে ঢাকা দিয়ে রাখে অন্ত্যেষ্টির আগে।
ওই ছবিটা মনে করিয়ে দিল রোজকার জীবনের সাধারণ সত্যিটুকু। দৈনন্দিনতার মধ্যেও ওই সারল্যটুকুই তৈরি করে দিল এক আশ্চর্য জাদুকরী মুহূর্ত। বোঝাল, তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে… । বোঝাল, ভঙ্গুর-অসহায়-দুর্বল জীবনেও ফিরে ফিরে আসে আশাবাদ। ওই ছবিটা এই অস্থির সময়, করোনাভাইরাস আর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিল। পাশাপাশি মানবতার জন্য, ভালবাসার জন্য, মায়ার জন্য, মমতার জন্য বয়ে নিয়ে এল এক দুর্মর আকাঙ্ক্ষা আর আশাবাদ।
ওই ছবিটা। ওই ছবিটা দেখুন। যে ছবি দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছিল। যে ছবির কথা বলে এই লেখা শেষ হচ্ছে। যে ছবির জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy