উদুপি জেলার সরকারি কলেজে হিজাব পরিহিত ছয় ছাত্রীকে ক্লাসে প্রবেশাধিকার না দেওয়া থেকে ঘটনার সূত্রপাত। ফাইল চিত্র।
কর্নাটক সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব এনেছে। উদুপি জেলার সরকারি কলেজে হিজাব পরিহিত ছয় ছাত্রীকে ক্লাসে প্রবেশাধিকার না দেওয়া থেকে ঘটনার সূত্রপাত। কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনেন। তারা প্রতিবাদ করলে কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ করার নির্দেশিকা জারি করে সরকার। তাদের মতে, যে পোশাক সমতা, অখণ্ডতা ও আইনশৃঙ্খলা ব্যাহত করে, তা পরা যাবে না। রাজ্যের শিক্ষা আইন উল্লেখ করে সরকার বলেছে, কলেজ অনুমোদিত পোশাকই ছাত্রীদের পরতে হবে। এই নির্দেশের প্রতিবাদে মুসলিম ছাত্রীরা কলেজের দরজায় আন্দোলনে শামিল। হিজাবে মাথা ঢেকে প্ল্যাকার্ড হাতে তারা জানিয়েছে, হিজাব তারা ভালবাসে, হিজাব তাদের অধিকার।
হিজাব নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশে, এবং ভারতেও নানা আপত্তি। ফ্রান্সে মুসলিম মেয়েদের হিজাবের দাবিতে আন্দোলন সুপরিচিত। ভারতের বর্তমান আবহে হিজাবের প্রতি এই আক্রমণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশ জুড়ে মুসলিমদের উপর লাঞ্ছনা চলছে। গোমাংস রাখার সন্দেহে জুনেদকে খুন, আসিফাকে ধর্ষণ করে হত্যা, ‘লাভ জেহাদ’-এর নামে মুসলিম যুবক ও তাদের পরিবারকে হেনস্থা— তালিকা দীর্ঘ। হিজাবের অজুহাতে মুসলমান মেয়েদের উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা— তাদের শিক্ষার অধিকার হনন— এই তালিকায় সংযোজনমাত্র।
কিছু দিন আগেও হিন্দু উচ্চবর্ণ সমাজে ধারণা ছিল, বেশির ভাগ মুসলিম যুবক সমাজবিরোধী, এবং মুসলিম মেয়েরা তাদের অত্যাচারে জর্জরিত। এবং, এই ‘বেচারা’ মেয়েদের ‘উদ্ধার’ করতে হিন্দু উচ্চবর্ণের দাদা-দিদি আকুল হত। উদ্ধারের প্রথম ধাপ হিজাব উন্মোচন। বহু ‘লিবারাল’ ব্যক্তিকেও বলতে শুনেছি, মুসলিম মেয়েদের ক্ষমতায়নের মাপকাঠি হিজাব পরিত্যাগ। হিজাব পরা মানেই বেচারা— এই ধারণায় আঘাত করল শাহিন বাগ। সাধারণ মুসলমান মেয়েদের প্রতিবাদের ছবি দেশ জুড়ে আলোড়ন ফেলে দিল। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রী লাদিদা ফরজানা, আয়েশা রেন্নাদের হিজাব পরিহিত প্রতিবাদী মূর্তি এই মুসলিম মেয়ে মাত্রেই নিপীড়িত ধারণাটিকে তছনছ করে দিল। একই ভাবে, ‘সুল্লি’ আর ‘বুল্লি’ অ্যাপে মুসলিম মেয়েদের নিলামে চড়ানোর মতো অপরাধ ঘটে চললেও প্রতিকার হয়নি। কিন্তু, কলকাতার মেয়ে নুর মেহভিস তাঁকে নিলামে চড়ানোর অভিযোগ জানালে কলকাতা পুলিশ এক মাস পর এফআইআর গ্রহণ করে। একই অভিজ্ঞতা বিমানচালক হানা খানের। তাঁরা কেউ লড়াই ছাড়েননি, অপরাধীও গ্রেফতার হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের এই প্রতিরোধের ক্ষমতা দেখে রাষ্ট্র ও হিন্দুত্ববাদী সমাজ আধিপত্য হারানোর ভয় পেয়েছে। এই ভয় থেকেই সংখ্যালঘু মেয়েদের লেখাপড়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ফন্দি। উচ্চশিক্ষায় মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণ যত বাড়ছে, ততই চলছে তাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এক দিকে কন্যাদের পড়ানোর বা সবার বিকাশের স্লোগান, অন্য দিকে কলেজে প্রবেশাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া। এমন ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে লেখাপড়ায় বৈষম্য সংবিধানে সংখ্যালঘুর শিক্ষার অধিকারের ধারাটি (ধারা ৩০) লঙ্ঘন করে।
কর্নাটক সরকারের মত, হিজাব নাকি কলেজে ছাত্রীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করবে, সম্প্রীতির বাতাবরণ ক্ষুণ্ণ করবে। ধর্মীয় পরিচিতির চিহ্ন যদি বৈষম্যের সূচনা করে, তা হলে হিন্দু বিবাহিত মেয়ের শাঁখা-সিঁদুর পরে কলেজ যাওয়াও কি নিষিদ্ধ হবে? তা যদি না হয়, তবে সরকার ও কলেজ কর্তৃপক্ষই হিজাব পরিহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করছে। এ প্রসঙ্গে সাম্যের ধারণাটাও খতিয়ে দেখা দরকার। সাম্য মানে সকলের জীবনধারণ এক রকম হবে তা নয়, সাম্য মানে বৈচিত্রের উদ্যাপন, বিভিন্নতার উৎসব। মুসলিম মেয়েরা হিজাব পরলে তাদের পাল্লা দিতে হিন্দু ছেলেমেয়েদের যদি গেরুয়া উত্তরীয় গলায় ঝোলাতে হয়, তা হলে বুঝতে হবে সংবিধানে উল্লিখিত সাম্যের মূল্যবোধকে আমরা রেষারেষির পণ্যে পরিণত করছি। সংখ্যাগরিষ্ঠের অহমিকার নিরিখে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এমনই হওয়ার কথা। সাম্যের আসল অর্থ উন্নয়ন এবং সামাজিক জীবনের সর্বস্তরে সংখ্যালঘুর অন্তর্ভুক্তিকরণ। তাদের জীবনধারণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়াদাওয়াকে সসম্মানে স্বীকৃতি দেওয়া, পোশাকের কারণে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা নয়।
এই আন্দোলন ঘিরে একটা প্রশ্ন সামনে আসছে। এটা কি সাধারণ ভাবে নারী অধিকারের আন্দোলন, না কি মুসলিম নারীর ধর্মীয় অধিকারের আন্দোলন? ট্যাংরা অঞ্চলের নারীবাদী নেত্রী নাফিসা খাতুনের (নাম পরিবর্তিত) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর বয়স ২৫। ২০১৯ পর্যন্ত তিনি হিজাব পরতেন না। ২০২০ থেকে তিনি স্বেচ্ছায়— বাড়ির বা প্রতিবেশীর চাপ ছাড়া— হিজাব পরা শুরু করেন। তাঁর বক্তব্য, শরীরের কতখানি ঢাকবেন বা ঢাকবেন না, সে সিদ্ধান্ত তাঁর। অধিকার হনন যখন শুধু মুসলিম মেয়েদের বিরুদ্ধেই হচ্ছে, তখন এই আন্দোলনও ধর্মাচারণের অধিকারের জন্যই। সুতরাং, হিজাবের দাবিতে আন্দোলনকে একমাত্রিক ভাবে নারীর পোশাকের অধিকারের আন্দোলন বললে, তার দ্বিমাত্রিকতাকে অস্বীকার করা হয়। সংখ্যালঘু মেয়েদের আন্দোলন আত্মসাৎ করা হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy