Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
coronavirus

করোনায় মৃতদের দেহ ফিরিয়ে দিয়েছে গঙ্গা, প্রশাসন চেপে গেলেও পুণ্যতোয়া নদী অসত্য বলে না

এই মুহূর্তে কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গের দাপট অনেকটাই কমে এসেছে বলে মনে হয়।

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গ মাথাচাড়া দেওয়ার সময় এই প্রাচীন নদী সাক্ষী থেকেছে এক অভাবনীয় ঘটনার।

ওম গৌর
লখনউ শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২১ ১৫:৪৩
Share: Save:

ভারতীয় ঐতিহ্যে ‘পবিত্রতম নদী’ হিসেবে স্বীকৃত গঙ্গা। বেশির ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বীই বিশ্বাস করেন, গঙ্গাস্নান আত্মাকে শুদ্ধ করে। কিন্তু গত বসন্তে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গ মাথাচাড়া দেওয়ার সময় এই প্রাচীন নদী সাক্ষী থেকেছে এক অভাবনীয় ঘটনার। নরেন্দ্র মোদী প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং সেই ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টায় সেই সাক্ষ্যপ্রমাণকে আইনি পরিভাষায় প্রধানতম প্রমাণ বা ‘এগজিবিট-এ’ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

গত এপ্রিল এবং মে মাসে বিহারে অতিমারির কারণে মৃতের সংখ্যা ৫.৪২৪ থেকে পৌণছেছিল ৯,৩৭৫-এ। এপ্রিলে কুম্ভমেলায় শত-সহস্র পুণ্যার্থীর সমাগমের সময় করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিছু বেসরকারি সংস্থাকে। উত্তর ভারতের ওই জনসমাগম করোনাভাইরাস সংক্রমণের এক অতিমাত্রিক ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, ওই মেলায় ১ লক্ষ মানুষের সংক্রমণ ঘটেছিল। যা একেবারেই ভুয়ো পরিসংখ্যান।

এই মুহূর্তে কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গের দাপট অনেকটাই কমে এসেছে বলে মনে হয়। কিন্তু তার প্রভাব সামলাতে গিয়ে দেশের টালমাটাল অবস্থা— প্রায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ দ্বিতীয় তরঙ্গে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন। গত মার্চ মাস থেকে সেই বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য— উভয় প্রশাসনই বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান পেশ করে আসছে। এমত পরিস্থিতিতে যদি কেউ সত্য বলে থাকে, তবে তা বলেছে একমাত্র পুণ্যতোয়া গঙ্গানদী। গত ১২ মে বিহারের বক্সার জেলার গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা দেখতে পান গঙ্গায় ভেসে আসছে বেশ কিছু ফুলেফেঁপে ওঠা বিকৃত শবদেহ। শ’খানেক শব উদ্ধার করা হয় নদী থেকে। উত্তর বিহারের একটি জেলা গাজিপুরের এক পুলিশ আধিকারিক জানান, দেহগুলি ভেসে আসছে উত্তরপ্রদেশ থেকে। প্রসঙ্গত, উত্তরপ্রদেশ ভারতের সব থেকে জনবহুল রাজ্য।

আমি ‘দৈনিক ভাস্কর’ নামে এক হিন্দি সংবাদপত্রের সম্পাদক। সারা দেশে যার বিক্রয়সংখ্যা ৫৫ লক্ষের আশেপাশে। এই কাগজের পাঠক মূলত মফস্‌সল শহর এবং গ্রামাঞ্চলেই বেশি। এমন এলাকায় অতিমারির ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যক্ষ ভাবে পর্যালোচনার জন্য আমরা ৩০ জন প্রতিবেদক ও চিত্র সাংবাদিককে উত্তরপ্রদেশের গঙ্গাতীরবর্তী প্রধান শহর ও জেলাগুলিতে পাঠিয়েছিলাম। শুধুমাত্র ১২ এবং ১৩ মে আমাদের প্রতিবেদকরা নদীতীরবর্তী ৭০০ মাইল পরিক্রমা করে ২,০০০ শবদেহ নদীতে ভাসতে দেখেছেন বলে জানান। দেহগুলি যে কেবল নদীর জলে ভেসে যাচ্ছিল তা নয়। কোনও কোনও দিন ৬৫ থেকে ৭০টি দেহ তীরে এসেও ঠেকছিল। কিন্তু প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছিল, ১ থেকে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে মোট ৭,৮২৬ জন কোভিডে মারা গিয়েছেন।

গঙ্গার অগভীর অংশে এক মাইলেরও কম দূরত্বে প্রায় ৪,০০০ দেহ দেখা গিয়েছে।

গঙ্গার অগভীর অংশে এক মাইলেরও কম দূরত্বে প্রায় ৪,০০০ দেহ দেখা গিয়েছে।

উত্তরপ্রদেশের দক্ষিণাংশের একটি গ্রাম, শৃঙ্গবেরপুর ‘রামায়ণ’-এ উল্লিখিত একটি জনপদ। সেখানে আমাদের সাংবাদিকরা দেখতে পান, মাত্র কয়েক গজের তফাতে অগণিত মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে। শবদেহগুলি ঢাকা দেওয়া ছিল গেরুয়া রঙের আচ্ছাদনে। মাটির নীচ থেকে এখানে সেখানে সেগুলি উঁকি দিচ্ছিল। দরিদ্র গ্রামবাসীদের স্বজনের দেহ দাহ করার জন্য কাঠ কেনারও সামর্থ্য ছিল না। তাই কোনও মন্দির বা দেবালয়ের কাছাকাছি জায়গায় তাঁরা পরিজনদের দেহ মাটিচাপা দিয়ে সান্ত্বনা খুঁজছিলেন তাঁরা।

বেশ কিছু প্রতিবেদন আসার পরে আমরা বুঝতে পারি, এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে মে মাসের মাঝামাঝি গঙ্গার অগভীর অংশে এক মাইলেরও কম দূরত্বে প্রায় ৪,০০০ দেহ দেখা গিয়েছে। হৃদয়বিদারক এই ঘটনার কথা হয়তো আমরা জানতেই পারতাম না। যদি না মে মাসের বৃষ্টিতে গঙ্গার জল বেড়ে গিয়ে দেহগুলি ভেসে উঠত বা তীরে এসে না ঠেকত। গঙ্গার তীরে চাপা দেওয়া দেহগুলিও বৃষ্টির কারণে কাদামাটি ধুয়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। বৃষ্টির কারণেই সরকারের মুখোশ খসে পড়েছিল। গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর পরিচালনা এবং পর্যাপ্ত টিকা সরবরাহে চূড়ান্ত ব্যর্থতা প্রকট হয়ে পড়ে। এই সব বিষয়ে ব্যর্থতা স্বীকার করার সৎসাহসটুকুও যে প্রশাসনের নেই, সেটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মনে রাখতে হবে, ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে বিজেপি-র অন্যতম প্রধান মুখ যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। আরও মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র উত্তরপ্রদেশেরই বারাণসী। গত এপ্রিলে যখন গোটা রাজ্যে অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্কট প্রবল, হাসপাতালের আইসিসিইউ-গুলিতে ভেন্টিলেটর এবং শয্যার অভাব প্রকট, শ্মশান এবং গোরস্থানে যখন তিলধারণের স্থান নেই, তখন আদিত্যনাথ পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে গিয়েছেন। কখনও সখনও হুমকিও দিয়েছেন। তিনি রাজ্যের আধিকারিকদের নির্দেশ দেন, যারা গুজব’ ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যেন সন্ত্রাসবাদ দমনকারী আইন প্রয়োগ করা হয়, তাদের সম্পত্তি যেন বাজেয়াপ্ত করা হয়।

 গঙ্গার তীরে চাপা দেওয়া দেহগুলিও বৃষ্টির কারণে কাদামাটি ধুয়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল।

গঙ্গার তীরে চাপা দেওয়া দেহগুলিও বৃষ্টির কারণে কাদামাটি ধুয়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল।

উত্তরপ্রদেশ সরকার শুধুমাত্র হাসপাতালগুলিতে মৃতের খতিয়ান প্রকাশ্যে আনে। কিন্তু রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য মানুষ চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। তাঁদের অধিকাংশ বাড়িতেই মারা গিয়েছেন। মে মাসের মাঝামাঝি গাজিপুরের রেবতীপুর নামে এক মফস্‌সল শহরের (আনুমানিক বাসিন্দার সংখ্যা ৭০ হাজার) এক এবং একমাত্র চিকিৎসক আমাদের সাংবাদিককে জানান, ৮৫০ জনের করোনা পরীক্ষার ফল পজিটিভ এসেছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছিলেন, ২০০-র কাছাকাছি মানুষ এপ্রিলেই করোনায় মারা গিয়েছেন। যেমন করোনায় পরিবারের তিন সদস্যকে হারানো মহেন্দ্রনাথ উপাধ্যায় আমাদের প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। আমাদের চিকিৎসার খরচ বহন করার কোনও ক্ষমতা নেই।”

কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় গ্রামীণ দারিদ্রের বিষয়টা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে প্রকাশ্যে চলে আসে মোদী প্রশাসনের অপদার্থতা আর নির্বুদ্ধিতা। কোন যুক্তিতে কুম্ভমেলার মতো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম ওই পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক অনুমোদন পায়? কোন বিবেচনায় উত্তরপ্রদেশ-সহ দেশের অন্যত্র নির্বাচন করা হয়? এখনও পর্যন্ত ভারতের মাত্র ৩.৪ শতাংশ মানুষের টিকাকরণ সম্ভব হয়েছে। এমতাবস্থায় সকলেই অতিমারির তৃতীয় তরঙ্গের আশঙ্কা করছেন।

২০১৪-এ পবিত্র বারাণসী থেকে লোকসভা ভোটে লড়ার সময় নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “মা গঙ্গাই আমাকে বারাণসীতে নিয়ে এসেছেন।” এখন সেই পুণ্যতোয়া গঙ্গাই তাঁকে বিদায়ের সঙ্কেত পাঠাচ্ছে।

*লেখক হিন্দি সংবাদপত্র দৈনিক ভাস্কর’-এর সম্পাদক। করোনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে তাঁর সম্পাদনায় বিশদে কাজ হয়েছে।

অন্য বিষয়গুলি:

coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy