Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Justice

গণতন্ত্রের অন্দরে ন্যায় প্রতিষ্ঠা

তবে কি রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে থাকা লোকজন বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইচ্ছেমতো ওই মূল্যবান জিনিসগুলি বণ্টন করতে পারে?

আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২২ ০৫:০৪
Share: Save:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা স্নাতক স্তরের পাঠ আরম্ভ করেই রাজনীতির দুটো সংজ্ঞা শেখেন। এক, কে কী পাবে, কখন এবং কী ভাবে পাবে, তার পাঠই হল রাজনীতি; এবং দুই, রাজনীতি হল মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের পাঠ। প্রথম সংজ্ঞাটি হ্যারল্ড লাসওয়েলের, দ্বিতীয়টি ডেভিড ইস্টনের। প্রথম সংজ্ঞায় যা পাওয়ার কথা হচ্ছে, সমাজের চোখে সেগুলি মূল্যবান জিনিস— পদ, প্রতিষ্ঠা, সুযোগ ইত্যাদি। আর কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা কী? রাজনীতির দ্বারা যে শাসনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা-ই ক্ষমতা— সরকার। তবে কি রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে থাকা লোকজন বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইচ্ছেমতো ওই মূল্যবান জিনিসগুলি বণ্টন করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর একাধারে হ্যাঁ, এবং না। রাজতন্ত্র, একনায়ক পরিচালিত কোনও ক্ষমতাতন্ত্র বা স্বৈরতান্ত্রিক কোনও ক্ষমতা তার ইচ্ছেমতো এই মূল্যবান জিনিসগুলি বণ্টন করতে পারে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সরকার তা পারে না।

কেন পারে না? লাসওয়েল এবং ইস্টন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই দুই তাত্ত্বিকই ‘পাবলিক পলিসি’-র দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের অবস্থানে পৌঁছেছেন। এই ‘পলিসি’ শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘নীতি’। গণতান্ত্রিক সরকারকে কিছু নীতি মেনে চলতে হয়। এই কারণেই সমাজের এই সমস্ত মূল্যবান জিনিসগুলি গণতান্ত্রিক সরকার নিজের ইচ্ছেমতো বিলিবণ্টন করে দিতে পারে না। সুপারিশের প্রথা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশেও প্রচলিত আছে, তবে তা যোগ্যদের বৃহৎ অংশকে বঞ্চিত করে নয়।

বঞ্চিত করার প্রসঙ্গে কেউ কেউ এই কুযুক্তির অবতারণা করতে পারেন যে, যাঁরা ‘যোগ্য’, তাঁরা বঞ্চিত হওয়ার কাঁদুনি গেয়ে সময় নষ্ট না করে পুনরায় তাঁদের যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়ে এই সমস্ত সামাজিক ভাবে মূল্যবান বস্তুগুলির প্রতি তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। তা হয়তো পারেন। তবে, ‘নীতি’ কথাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও একটি শব্দ— ‘ন্যায়’। আর এখানে প্রশ্নটা আরও এক বার যোগ্যতা প্রমাণের নয়, মূল প্রশ্নটা ন্যায়ের।

উন্নয়নের কোনও এক নির্দিষ্ট খাতে খরচের জন্য বরাদ্দ অর্থ তছরুপ, অথবা নিলামে কম পয়সায় লাভজনক সরকারি সম্পত্তি পছন্দের সংস্থাকে পাইয়ে দেওয়ার মতো আর্থিক দুর্নীতি, আর যোগ্যকে বঞ্চিত করে অযোগ্যকে সুযোগ করে দেওয়ার দুর্নীতির মধ্যে মূলগত পার্থক্য আছে। সেতু বা সড়ক নির্মাণের অর্থ তছরুপের ফলে উন্নয়নের ধারায় যে ভাবে এবং যতটুকু ব্যাঘাত ঘটে, সদিচ্ছা থাকলে দ্রুত তা সংশোধন করা সম্ভব। কিন্তু, যোগ্যকে বঞ্চিত করে আর্থিক বা অন্যান্য কোনও সুবিধার বিনিময়ে অযোগ্যকে জায়গা দিলে আসলে মেধার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। দক্ষতার সঙ্গে সমঝোতা করা হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তার মাসুল দিতে হয়।

অন্য দিকে, পদ ও প্রতিষ্ঠার মতো মূল্যবান জিনিসগুলি থেকে যোগ্যদের বঞ্চিত করলে সরাসরি ন্যায়ের পরিসরে আঘাত আসে। কী ভাবে? গত শতাব্দীর আমেরিকান দার্শনিক জন রলস্ তাঁর ন্যায় তত্ত্বের নির্মাণের একদম গোড়ায় যে আদর্শকে রেখেছেন, তা হল সমদর্শিতা— ‘জাস্টিস অ্যাজ় ফেয়ারনেস’। এখানে ‘সমদর্শিতা’ মানে হল, সকলের জন্য সমান সুযোগ। এই সুযোগ আসলে ওই সামাজিক মূল্যবান জিনিসগুলি গ্রহণের সুযোগ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যোগদান করার সমদর্শী সুযোগ। এরই দ্বিতীয় ভাগে তিনি যুক্ত করছেন কম সুবিধাপ্রাপ্তদের বেশি সুবিধা দেওয়ার কথা। যোগ্যকে বঞ্চিত করে অর্থ অথবা অন্যান্য কিছুর বিনিময়ে অযোগ্যকে সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে এইখানেই ভঙ্গ হচ্ছে ন্যায়।

কেউ বলতে পারেন যে, ভারতের মতো দেশে তা হলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়েই আছে— ভারতীয় সংবিধানে সাম্যের অধিকার আছে; পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য আছে সংরক্ষণ— অতএব, এই দেশে ন্যায় সুরক্ষিত। তাত্ত্বিক ভাবে কথাটা ঠিক। কিন্তু, অমর্ত্য সেন তাঁর দি আইডিয়া অব জাস্টিস বইটিতে ‘নীতি’ এবং ‘ন্যায়’-এর পার্থক্য নির্ধারণ করেছেন। নীতি হল ‘বিধিবদ্ধ এই বিপুল আয়োজন’, প্রকৃতই যা ভারতীয় সংবিধানে উপস্থিত। আর, সেই নীতির কার্যপদ্ধতির উপর নির্ভর করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।

নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দেখে জন রলস্ যে রকম ‘নীতির বিপুল আয়োজন’, ‘সমদর্শী সুযোগ’ এবং ‘কম সুযোগপ্রাপ্তদের বিশেষাধিকার’ দ্বারা সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে করেছিলেন, বোধ হয় তৃতীয় বিশ্বে গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা থেকেই অমর্ত্য সেন মনে করেছেন ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজটি আসলে অন্তহীন। ‘অ-ন্যায়’-কে হ্রাস করতে করতে এগিয়ে চলাই ন্যায়। ভারতের সংবিধানের ন্যায়ের কথা অত্যন্ত দৃপ্ত ভাবে লিখিত আছে। সেই থেকে তৈরি হয়েছে আইন, বিধান। সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে আছে আদালত। অতএব, যোগ্যকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে মধ্যরাতেও আদালতকে জেগে থাকতে হয় বইকি!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Justice Democracy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy