ভাল কাটল না ২০২১। বছরের গোড়ায় মনে হয়েছিল, অতিমারির কবল থেকে এ বার হয়তো মুক্তি ঘটবে। একটু একটু করে শুরু হচ্ছিল স্বাভাবিক লেনদেন, বেচাকেনা। ভিড় জমছিল পার্কে, রেস্তরাঁয়। কেউ ভাবেননি, আবার কয়েক মাসের মধ্যেই এসে পড়বে দ্বিতীয় ঢেউ, যা প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় আরও অনেক ভয়ঙ্কর। বস্তুত, এপ্রিল থেকে জুন, ২০২১ সালের এই তিন মাস দেশ জুড়ে কোভিড-১৯ যে অবাধ ধ্বংসলীলা চালাল, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। এমন মানুষ এখন বিরল, যাঁর কোনও পরিচিত-বন্ধু-পরিজন অতিমারিতে চলে যাননি।
এই অবস্থায় অর্থনীতির চাকা রুদ্ধ হয়ে আসা স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার প্রকাশিত জানুয়ারি, ২০২১-এর ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক থেকে জানতে পারছি, ২০১৯ সালে ভারতের জাতীয় আয় ৪.২% হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বৃদ্ধির হারটা খুব বেশি নয়। কয়েক বছর আগে এর দ্বিগুণেরও বেশি ছিল বৃদ্ধির হার। তার পর নোট বাতিল এবং বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে কমতে কমতে এখানে এসে ঠেকেছিল। ২০২০ সালের অতিমারি ও লকডাউন ভারতীয় বৃদ্ধির হারকে এক ধাক্কায় ঋণাত্মক করে দিল। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালে ভারতের জাতীয় আয় ৮% কমে গিয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে অনেকেরই মনে হচ্ছিল যে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এ বার অতিমারির
কবল থেকে বেরিয়ে আসবে। বছরের শুরুতে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, ২০২১ সালে ভারতের জাতীয় আয় ১১.৫% হারে বাড়বে।
১১.৫% হারে বৃদ্ধি পাওয়াটা অবশ্য তেমন বিরাট কিছু নয়। ধরা যাক, ৪.২% হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পর ২০১৯ সালের শেষে ভারতের জাতীয় আয় ছিল ১০০ টাকা এবং ২০২০ সালে ৮ শতাংশ কমে গিয়ে সেই আয় দাঁড়াল ৯২ টাকায়। এই ৯২ টাকার উপর যদি ১১.৫% বৃদ্ধি হয়, তা হলে ২০২১-এর শেষে জাতীয় আয় হবে ১০২.৫৮ টাকা। অর্থাৎ ২০১৯-এর তুলনায় ২০২১-এ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি হবে মাত্র ২.৫৮ শতাংশ। দ্বিতীয় দফার কোভিডের পরে মনে হচ্ছে ওটুকু বৃদ্ধিও হবে না। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক তাদের অক্টোবর, ২০২১-এর সংখ্যায় ভারতের বৃদ্ধিহার সম্পর্কে ধারণা পাল্টেছে। তাদের নতুন হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-এর তুলনায় ২০২১-এ জাতীয় আয় ১.১৫% বাড়বে আর মাথাপিছু আয় কমবে ০.২৭ শতাংশ।
এই সব সংখ্যাগত ভবিষ্যদ্বাণীতে কিছু ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে, কিন্তু মূল বার্তাটায় কোনও অস্পষ্টতা নেই— ২০২১ সালে ভারতের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারল না। বিশেষ করে উদ্বেগজনক হল ২০১৯-এর তুলনায় ২০২১-এর মাথাপিছু আয় কমে যাওয়া। মাথাপিছু আয় আসলে ভারতীয় নাগরিকদের গড় আয়। গড় মানে তার মধ্যে উঁচু-নিচু-মাঝারি সব রকমের আয়ই আছে। অতিমারির ফলে সব ভারতীয় নাগরিকের আয় কিন্তু কমেনি। তথ্যপ্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলোতে মানুষের ব্যয় বেড়েছে, ফলে এ সব ক্ষেত্রে আয়ও বেড়েছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে কিছু সংস্থা যে ভাল করছে, শেয়ার বাজারের ঊর্ধ্বগতি তার প্রমাণ। আবার যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁদের আয় মোটামুটি অপরিবর্তিত আছে। এর মানে হল, যাঁদের আয় কমেছে, তাঁদের এতটাই আয় কমেছে যে, গড় আয়টাকে তাঁরা টেনে নামিয়ে দিয়েছেন। উদ্বেগ এই কারণে যে, যাঁদের আয় কমেছে, তাঁরা মোটের উপর গরিব মানুষ; আর যাঁদের আয় বেড়েছে, তাঁরা অবস্থাপন্ন। অর্থাৎ, অসাম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
অসাম্য বাড়ার খবরটা নানা সূত্র থেকে সরাসরি জানতে পারছি। বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২-এ ভারতের ক্রমবর্ধমান অসাম্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রিপোর্টটি জানাচ্ছে, ১৯৮০ সালে ভারতের সচ্ছলতম ১০ শতাংশের আয় ছিল জাতীয় আয়ের ৩০%। ২০২১ সালে সেটা বাড়তে বাড়তে জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশে পৌঁছেছে। একই সময়ে, দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের আয় জাতীয় আয়ের ২১ শতাংশের থেকে কমতে কমতে ১৩ শতাংশে নেমে গিয়েছে। বস্তুত, সচ্ছলতম এক শতাংশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে। এখন সচ্ছলতম এক শতাংশের দখলে জাতীয় আয়ের প্রায় ২২ শতাংশ। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২১ সালে ভারতে দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের মাথাপিছু বাৎসরিক গড় আয় ৫০ হাজার টাকা, সচ্ছলতম ১০ শতাংশের প্রায় ১২ লাখ টাকা এবং ঊর্ধ্বতম ১ শতাংশের ৪৪ লাখ টাকার উপর।
যতটা অসাম্য বেড়েছে বলে বিশ্বব্যাঙ্ক বলছে, বাস্তবটা সম্ভবত তার থেকেও ভয়ঙ্কর। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ এই বলে উষ্মা প্রকাশ করেছে যে, ভারতে অসাম্য সংক্রান্ত যথাযথ তথ্য পাওয়া ক্রমশই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ, সরকার ইচ্ছে করে তথ্য গোপন রাখছে, যাতে আসল সত্যটা জনসমক্ষে প্রকাশ না পায়। সরকারের বোঝা প্রয়োজন, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।
অসাম্য নিয়ে অন্যান্য সূত্রও একই কথা বলছে। আমেরিকার চিন্তন-ভান্ডার পিউ রিসার্চ সেন্টার গত মার্চ মাসে প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে জানাচ্ছে যে, ২০২০ সালে কোভিড অতিমারির প্রকোপে ৩.২ কোটি ভারতীয় মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের শ্রেণিতে নেমে গিয়েছেন। বস্তুত, অতিমারির ফলে সারা পৃথিবীতে যত মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ৬০ শতাংশই ভারতীয়। চিনে এই সংখ্যাটা এক কোটি, অর্থাৎ ভারতীয়দের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশেরও কম। হিসাবটা তুলনীয়, কারণ জনসংখ্যার নিরিখে দুটো দেশ কাছাকাছি, এবং যে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে এক জন ভারতীয় নাগরিককে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র বলা হচ্ছে, চিন বা অন্য দেশের নাগরিকদের শ্রেণি-নির্ধারণ করার সময় সেই একই মাপকাঠি ব্যবহার করা হচ্ছে।
অসাম্য বাড়ার আর একটা সঙ্কেত সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি। আমাদের দেশে মূল্যসূচক তৈরি করার সময় অন্যান্য জিনিসের তুলনায় খাদ্যদ্রব্যের উপর অনেক বেশি জোর দেওয়া হয়, কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষ, দারিদ্রের কারণে, তাঁদের মোট খরচের সিংহভাগ খাদ্যদ্রব্যের উপর ব্যয় করতে বাধ্য হন। তাই মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়া মানেই খাবারের দাম বাড়া। খাবারের দাম বাড়লে ধনীদের তেমন কিছু যায় আসে না, কিন্তু গরিবদের পক্ষে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। গত নভেম্বরের তুলনায় এই নভেম্বরে পাইকারি জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ১৪.২৩%। এর মূল কারণ আনাজ এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধি। আশঙ্কা হয়, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে অচিরেই খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়বে। তখন অসাম্য আরও বৃদ্ধি পাবে।
তা হলে কি ২০২১ উন্নয়নের কোনও বার্তাই দিতে পারল না? হয়তো এতটা হতাশ হওয়ার কারণ নেই। হয়তো এই প্রগাঢ় অন্ধকারের আড়ালে দু’-একটা রুপোলি রেখাও আছে। কোভিড-১৯ আমাদের প্রচলিত অভ্যাসগুলোকে বদলে দিয়েছে। মানুষ, অন্তত শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষ, আগের চেয়ে অনেক বেশি কম্পিউটার-নির্ভর হয়েছেন। দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র কেনার বদলে অনেকেই এখন অনলাইনে জিনিস কিনছেন। ফলে দোকানপাট রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কমছে, যার ফলে বিক্রেতা আরও সস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারছেন। একই ভাবে কর্পোরেট কর্তারা আজকাল অনলাইনে মিটিং করছেন। তাঁদের বিজ়নেস ক্লাসের ভাড়া, বা পাঁচতারা হোটেলে থাকার খরচ সংস্থা বাঁচিয়ে ফেলছে। যদি বাজারে প্রতিযোগিতা থাকে, তা হলে এই হ্রাসপ্রাপ্ত খরচের কিছু প্রতিফলন জিনিসের দামের উপর দেখা যাবে।
নতুন ব্যবস্থায় সকলের যে লাভ হচ্ছে, তা নয়। অনলাইনে বেচাকেনা বাড়লে, কিছু দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবে। দোকানের কর্মচারীদের ক্ষতি হবে। কর্পোরেট কর্তারা তাঁদের ব্যবসায়িক ভ্রমণ বন্ধ করে দিলে, শকট-চালক থেকে হোটেলের পরিচারক, সকলের বিপদ। এঁদের নতুন নতুন ক্ষেত্রে কাজ খুঁজতে হবে। নতুন নতুন কাজ তৈরিও তো হচ্ছে। অনলাইন ব্যবসায়, কুরিয়র পরিষেবায় যেমন কাজ তৈরি হচ্ছে, তেমনই তৈরি হচ্ছে আইটিতে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। একটা পুরনো ব্যবস্থা থেকে নতুন একটা ব্যবস্থায় উত্তরণ সহজ নয়। কিন্তু
নতুন ব্যবস্থাটা দক্ষতর হলে সে দিকে যাওয়াটা লাভজনক। কোভিড-১৯ হয়তো আমাদের সেই উত্তরণ ত্বরান্বিত করল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy