দাবি: কুমিল্লার ঘটনায় ন্যায়বিচার চেয়ে মানববন্ধনে শামিল বাংলাদেশের লেখক ও সমাজকর্মীরা, ১৯ অক্টোবর, ঢাকা। রয়টার্স।
যে দেশটি ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান থেকে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির অহঙ্কারকে হাতিয়ার করে, মুক্তিযুদ্ধকে সফল করে, পঞ্চাশ বছর আগে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন উৎসবের বছরটিতেই ইদানীং কালের সবচেয়ে মর্মান্তিক সাম্প্রদায়িক ও সংখ্যালঘু বিদ্বেষের ঘটনাটি ঘটলে, তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগের। উদ্বেগ বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের, উদ্বেগ বাংলাদেশ সমাজ ও রাষ্ট্রের, উদ্বেগ ভারত, এমনকি পাকিস্তানের সমাজ, রাষ্ট্র, ও বিশেষত সংশ্লিষ্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরও, উদ্বেগ সমগ্র উপমহাদেশের।
এই উপমহাদেশের দেশগুলির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি ঘটেছে দেশভাগের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। মানুষের ছিন্নমূল হওয়ার ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে। দেশভাগের ছায়া যে এখনও এই অঞ্চল থেকে কোনও ভাবেই সরেনি, এই বছরের দুর্গোৎসবের ঘটনা আবার তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দেশভাগ হলেও উপমহাদেশের সব ক’টি দেশেই অন্য সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা রয়েছেন— কোনও দেশে কম, কোনও দেশে বেশি। সংবিধানকেন্দ্রিক, ও প্রধানত নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র যে পরমতসহিষ্ণুতার মন্ত্রে মানুষকে দীক্ষিত করতে পারেনি, এ বারের দাঙ্গায় তা পুনরায় প্রমাণিত।
কুমিল্লার ঘটনার জের বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে খবর এবং গুজব অত্যন্ত দ্রুতগামী। এক সময়ে বাংলাদেশের প্রায় ২২টি জেলায় বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নামাতে হয়। পরিস্থিতি এক সময়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে। অপরাধী ও অন্যায়কারীরাও ধরা পড়বে। কিন্তু এই ঘটনা বাংলাদেশ এবং এই উপমহাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।
প্রথমত, দেশের শাসনতন্ত্রে ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দগুলি থাকলেই একটি সমাজ ও দেশ কিন্তু গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠে না। এই লক্ষ্যে উপনীত হতে চাইলে প্রয়োজন নিরন্তর অনুশীলনের। অনুশীলন ব্যক্তিজীবনে, সমাজ-জীবনে, এবং রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক স্তরে। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য সদা সজাগ ও সচেতন না থাকতে পারলে বিপদ অনিবার্য। তার উদাহরণ অগণিত।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিজীবনে অন্য জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করব, তাঁদের সম্পর্কে সম্যক জানার চেষ্টার পরিবর্তে পথচলতি অগভীর, তথ্যবিচ্ছিন্ন, অযৌক্তিক অনুমানগুলিকে নির্দ্বিধায় সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্য মাধ্যমে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেব, আর ভাবব কেমন দিলাম— এই মানসিকতা পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অজ্ঞতাকেই প্রশ্রয় দেয়, বিশ্বাস ও সহনশীলতাকে নয়। আর, ব্যক্তি নিয়েই সমাজ গড়ে ওঠে বলে সমাজের মুষ্টিমেয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে সমাজের অভিমুখ বদল করা কঠিন। অথচ, তুলনায় সমাজ-সচেতন মানুষ নীরব দর্শকের ভূমিকা নিলে, তা বিপদকে ঘনীভূতই করে, বিপন্মুক্তির পথ দেখায় না। দেবালয় পুড়লে জনপদ নিরাপদ থাকে না। তবে, বাংলাদেশের এই চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তে যে ভাবে সে দেশের ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, ক্রীড়াবিদ বা শিল্পী তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন, তা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়াও এই প্রতিবাদ আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ শামিল হয়েছেন— এ ঘটনা আলোর দিশারি। নাগরিক সমাজই পারে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দায়বদ্ধ করে তুলতে, সামাজিক বৈচিত্রকে উদ্যাপন করতে।
তৃতীয়ত, এই উপমহাদেশে অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও হিংসার ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের এবং কায়েমি স্বার্থান্বেষী মানুষকে বরাবর উৎসাহ দিতে দেখা গিয়েছে। দেশভাগেও এর ইতি ঘটেনি। উত্তর-ঔপনিবেশিক এই রাষ্ট্রগুলি ধর্ম বা অন্য কোনও পরিচিতি বা সত্তার ভিত্তিতে কৃত্রিম নেশন নির্মাণের যে কর্মকাণ্ডে বহু ক্ষেত্রেই যুক্ত, তা প্রমাণ করে যে, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কয়েক দশক আগে আমাদের মুক্তি ঘটলেও আমাদের মন এখনও ঔপনিবেশিকতায় আচ্ছন্ন। ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাস হিসাবে দেখা এক জিনিস। সেটি মানুষের ব্যক্তিগত। আর ধর্মকে রাজনৈতিক মতাদর্শে ব্যবহার করা অন্য জিনিস। দ্বিতীয়টি এক দিকে বিপজ্জনক বিষকুম্ভ, অন্য দিকে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ধর্মমতের বহ্ন্যুৎসব আমাদের কোন চূড়ান্ত লক্ষ্যে ধাবিত করে? সেই লক্ষ্য শান্তি-সুস্থিতির নয়, ধ্বংসের পাথেয়।
আফগানিস্তানে পুনরায় তালিবানের ক্ষমতারোহণে যে উপমহাদেশের দেশগুলিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে চলেছে, বাংলাদেশের ধ্বংসলীলা তারই ইঙ্গিতবহ। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার অনল আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পক্ষে যতটা বিপজ্জনক, ভারতের পক্ষেও ততটাই। ধর্মবিশ্বাসকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক মতাদর্শ দক্ষিণ এশিয়ার সব ক’টি দেশের বৈচিত্রের পক্ষেই অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই অঞ্চলের বৈচিত্রই কিন্তু এখানকার সভ্যতার সমৃদ্ধি।
এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রগুলির দায়িত্ব গুরুতর। যে দেশে যে শাসক দল বা পক্ষ ক্ষমতাসীন, তাদের দায়িত্ব অন্য মতের, ধর্মের, ভাষার, সংস্কৃতির প্রতি অসহিষ্ণুতা, বিদ্বেষ বা তাচ্ছিল্যকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উস্কানি দেওয়া নয়, তাদের দায়িত্ব আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সমাজের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্প্রীতিকে গড়ে তোলা, তাকে সুদৃঢ় করা। গণতন্ত্র মানে নিয়মমাফিক, পর্যায়ক্রমিক নির্বাচন নয়। সর্বাত্মক ভাবনার অভাব নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র বা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ গড়ে তোলে। এতে আপাত লাভ মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদি স্তরে ধ্বংসাত্মক। ইতিহাস তার সাক্ষী। বাংলাদেশের এ বারের ঘটনা আমাদের জন্য এক জরুরি সতর্কবার্তা। এই বার্তাকে উপেক্ষা করা মানে নির্মাণ নয়, ধ্বংসের পথ বেছে নেওয়া। যে সয়, সে-ই কিন্তু রয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy