ভাড়া-দেওয়া বাড়ি ভাড়াটের থেকে ফিরে পাওয়া এমনই ঝঞ্ঝাট যে, ভারতে এক কোটিরও বেশি বাড়ি বা ফ্ল্যাট ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এ তথ্য মিলেছিল ২০১১ সালের জনগণনায়। অন্য দিকে, ভিন্রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে বাড়ি পেতে সমস্যায় পড়েন নানা পেশার মানুষ, বিশেষত তরুণ-তরুণীরা। অত্যধিক সেলামি দাবি করেন বাড়িওয়ালারা, নিম্নবিত্ত এলাকায় ঘরগুলির যথাযথ দেখভাল হয় না, চুক্তি সই না করিয়ে ভাড়াটে বসান অনেকে, ফলে উচ্ছেদের ভয় থেকে যায়। পরিযায়ী শ্রমিক থেকে উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক, সকলেরই হয়রানি হয় ভাড়া পেতে। কেন্দ্র ‘মডেল বাড়িভাড়া আইন, ২০২১’ অনুমোদন করল। এ বার কি দীর্ঘ দিনের সমস্যার সূত্র মিলবে? রাজ্য সরকারগুলি এই ‘মডেল’ অনুসরণ করে আইন তৈরি বা সংশোধন করলে কি বাড়িভাড়া দেওয়া নিরাপদ, আর ভাড়া পাওয়া সহজ হবে?
বাড়িওয়ালার পক্ষে সুবিধেজনক কিছু ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মডেল আইনে। যেমন, জোর করে বাড়ি দখল করে থাকার জন্য খেসারত অনেক বেশি গুনতে হবে ভাড়াটেকে। ভাড়াটে যদি চুক্তির খেলাপ করেন, তা হলে এই প্রতি মাসে ভাড়ার দ্বিগুণ দিতে বাধ্য থাকবেন প্রথম দুই মাসের জন্য, তার পরে যত মাস তিনি অবৈধ ভাবে দখল করে থাকবেন, তাঁকে নির্দিষ্ট ভাড়ার চার গুণ দিতে হবে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বাড়িভাড়া সংক্রান্ত আইনে (১৯৫৬) বর্ধিত ভাড়া দেওয়ার নিয়ম নেই। ভাড়ার অঙ্ক নিয়ে বিবাদ হলে নিয়মিত ভাড়া জমা দিয়ে যেতে হয় নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের (রেন্ট কন্ট্রোলার) কাছে।
মডেল আইনে ‘প্রপার্টি ম্যানেজার’ নামে একটি পদকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। তিনি বাড়িভাড়া আদায় করবেন, ভাড়া দেওয়া অংশের প্রয়োজনীয় মেরামত করবেন, ভাড়া দেওয়া অংশ খালি করানো, ভাড়ার চুক্তিপত্র নবীকরণ, সবই করতে পারবেন। যে বাড়ির মালিকরা দূরে থাকেন, তাঁদের এতে সমস্যা কমবে। অন্য দিকে, ভাড়াটের সুরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে এই শর্ত বহাল থাকছে যে, বাড়িওয়ালা বা প্রপার্টি ম্যানেজার জল, বিদ্যুৎ প্রভৃতি কোনও অবস্থাতেই বন্ধ করতে পারবেন না।
তবে, রাজ্যের বর্তমান আইনে এলাকাভিত্তিক ভাড়া কত হওয়া উচিত, সেই ন্যায্য ভাড়ার (‘ফেয়ার রেন্ট’) উল্লেখ রয়েছে। মডেল আইনে সে সম্পর্কে কিছু নেই। রাজ্যগুলি যদি এ বিষয়ে তাদের আইনে কিছু না যোগ করে, তা হলে বাড়িওয়ালারা ইচ্ছেমতো ভাড়ার দাবি করতে পারেন, সে ভয় থাকছে।
মডেল আইনে প্রধান পরিবর্তন হল ভাড়াটে উচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলার বিচারকে প্রশাসনিক আধিকারিকদের অধীনে নিয়ে আসা, এখন যা কেবল দেওয়ানি আদালতের অধীনে রয়েছে। এখন প্রস্তাব করা হয়েছে একটি ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার। সবার নীচে ‘রেন্ট অথরিটি’, যার দায়িত্বে থাকবেন ডেপুটি কালেক্টর অথবা সম-পদমর্যাদার কোনও আধিকারিক। তার উপরে ‘রেন্ট কোর্ট’, যার দায়িত্ব পাবেন অতিরিক্ত জেলাশাসক অথবা সম-পদমর্যাদার কোনও আধিকারিক। তার উপরে ‘রেন্ট ট্রাইবুনাল’, যা কাজ করবে অতিরিক্ত জেলা জজ বা তাঁর সমান পদমর্যাদার বিচারকের অধীনে। ট্রাইবুনালের রায় পছন্দ না হলে যেতে হবে হাই কোর্টে। বর্তমানে কেবল ‘রেন্ট কন্ট্রোল’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে, যেখানে উচ্ছেদ ছাড়া অন্যান্য বিবাদ (বাড়ি ভাড়া বাড়ানো, গ্রহণ না করা, বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ইত্যাদি) সমাধান করা হয়। মডেল আইনে এই দায়িত্ব পাবে ‘রেন্ট অথরিটি’।
বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার মামলার মূল সমস্যা ছিল আদালতের দীর্ঘসূত্রতা। মডেল আইনে জোর দেওয়া হয়েছে ‘দ্রুত নিষ্পত্তি’র উপরে। ‘রেন্ট কোর্ট’-এ করা একটি আবেদন ত্রিশ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতেই হবে। ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার কোথাও মামলায় মোট তিন বারের বেশি সময় চাওয়া (‘অ্যাডজারমেন্ট’) যাবে না।
‘রেন্ট অথরিটি’ এবং ‘রেন্ট কোর্ট’ মডেল আইনে অনেক ক্ষমতা পেয়েছে। কিন্তু বিচারবিভাগের সমান নিরপেক্ষতা প্রশাসনের আধিকারিকদের মিলবে কি না, সে প্রশ্ন থেকে যায়। আবার, মডেল আইন অনুযায়ী, মামলা শুনানিতে দেওয়ানি কার্যবিধি আইনও মানার প্রয়োজন হবে না। ফলে যে প্রশাসনিক আধিকারিক মামলা শুনবেন, তিনি কোন পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি করবেন, সেটা পরিষ্কার নয়। ‘সরল, স্বাভাবিক নিয়মনীতি’ (‘ন্যাচারাল জাস্টিস’) মেনে বিবাদ নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোন আধিকারিকের কাছে কোন বিচার ‘স্বাভাবিক’, তা নিয়ে অস্পষ্টতার সুযোগ থাকছে।
মডেল আইন বাড়ির দালালদের ‘রেন্টাল এজেন্ট’ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে; মালিক ও ভাড়াটের মধ্যে মধ্যস্থতার অধিকার দিচ্ছে। কিন্তু তাঁদের দায়বদ্ধতা কী, পালনীয় বিধি কী, না মানলে কী শাস্তি হতে পারে, তার কোনও উল্লেখ নেই আইনে।
দুশ্চিন্তা জাগে আর একটি বিষয়ে। মডেল আইন বলছে, বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের মধ্যে চুক্তি সংক্রান্ত নথি একটি নির্দিষ্ট ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আপলোড করলে ‘ইউনিক আইডি’ নম্বর মিলবে। অভিযোগ দায়ের করলে ওই নম্বর দিয়ে মামলার দিনক্ষণ, প্রগতি দেখতে হবে। যে দেশে বস্তির খুপরি ঘরে ভাড়া থাকেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, সেখানে স্মার্ট ফোন-নির্ভরতা কতটা সাহায্য করবে? আর, এই সব তথ্য কতটা সুরক্ষিত থাকবে?
উচ্ছেদের মামলার দ্রুত সমাধান হলে অনেক বাড়িওয়ালা হয়তো ভাড়া দিতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু তার ফলে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে কি না, সে চিন্তাটা থেকেই যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy