Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
12th Fail Movie

আমরা যারা দ্বাদশ ফেল!

‘টুয়েলভ্‌থ ফেল’ এই মধ্যবয়সির মনে পরিশ্রম, একমুখিতা এবং হার-না-মানার প্রতি বিশ্বাসকে আবার প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই ছবির গল্প ব্যর্থ হতে হতেও বারংবার প্রয়াসকে ‘রিস্টার্ট’ করে হাল না-ছেড়ে উল্টে তেড়ে ধরার।

Takes of real life from the Vidhu Vinod Chopra Film Twelfth Fail

নম্বর সব কথা বলে না। ‘টুয়েলভ্থ ফেল’ ছবির পোস্টার।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:০০
Share: Save:

বেইমানির ফার্স্ট ডিভিশনের চেয়ে ইমানদারির থার্ড ডিভিশন ভাল!

বাক্যটা শোনা ইস্তক মাথায় ঘুরঘুর করছে। কথাটা বলল একটি হিন্দি ছবির এক চরিত্র। যে চরিত্র বছরের শেষে এসে হইহই ফেলে দিয়েছে। চরিত্রের নাম মনোজ কুমার শর্মা। ছবির নাম ‘টুয়েলভ্থ ফেল’। অর্থাৎ, দ্বাদশ ফেল। বানিয়েছেন বিধু বিনোদ চোপড়া।

চম্বলের এক গ্রামের তরুণ মনোজের আইপিএস অফিসার হয়ে ওঠার জীবনকাহিনি অবলম্বনে তৈরি এই ছবি বক্স অফিসে যে দুর্দান্ত ব্যবসা করেছে, তা নয়। কিন্তু বছরের শেষে ডিজ়নি হটস্টার নামক ওটিটি মঞ্চে সহজদ্রষ্টব্য হয়ে উঠে প্রায় গোটা দেশকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে! মুক্তি পাওয়ার মাত্র তিন দিনের মধ্যে এই ছবি সেই ওটিটি মঞ্চে প্রদর্শিত ২০২৩ সালের সমস্ত ছবির মধ্যে সর্বোচ্চ দর্শকসংখ্যায় পৌঁছেছে। সেই ভালবাসার অভিঘাত এত তীব্র এবং প্রবল যে, দর্শককুল নিজেদের মতো করে রায় দিতে শুরু করেছে— ‘টুয়েলভ্থ ফেল’ ২০২৩ সালের সেরা ছবি! এহ বাহ্য, এই ছবিকে ‘স্বাধীন এন্ট্রি’ হিসেবে পাঠানো হচ্ছে অস্কারে।

বছরের সেরা ছবি কি না, সেই সিনেম্যাটিক বিচারের যোগ্যতা বা ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু ‘টুয়েলভ্‌থ ফেল’ এই মধ্যবয়সির মনে পরিশ্রম, একমুখিতা এবং হার-না-মানার প্রতি বিশ্বাসকে আরও একবার প্রতিষ্ঠিত করেছে। ‘না’ বলার তাগদ এবং তাগিদকে আরও জোরালো করেছে।

এই ছবির গল্প চম্বলের মোরেনার বাসিন্দা মনোজের জীবনের। ব্যর্থ হতে হতেও বারংবার প্রয়াসকে ‘রিস্টার্ট’ করে হাল না-ছেড়ে উল্টে তেড়ে ধরার। ‘হার নহি মানেঙ্গে’ মানসিকতার। ২০ কোটি টাকায় তৈরি এই ছবি বক্স অফিসে ব্যবসা করেছিল ৬৬ কোটি টাকার। ২৭ অক্টোবর সারা দেশে মাত্র ৬০০টি স্ক্রিনে মুক্তি পেয়েছিল ‘টুয়েলভ্‌থ ফেল’। এ দিক-ও দিক ছুটকোছাটকা প্রশংসা হলেও সমাজে আলোড়ন তো দূরস্থান, কোনও তরঙ্গও তোলেনি। ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’ বা ‘অ্যানিম্যাল’-এর সঙ্গে দৌড়ে এই ছবিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কিন্তু নম্বরই যদি সব এবং শেষ কথা বলবে, তা হলে দুনিয়ায় আর বৌদ্ধিক অভিঘাতের দাম থাকবে কেন!

অজ গ্রাম বেলগাঁওয়ের এক পরিবারের সন্তান মনোজ। যে সস্তার স্যান্ডো গেঞ্জি আর কিটকিটে ট্র্যাকবটম পরে ছাদের কিনারায় বসে প্রাণপণে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় টুকলি করার জন্য একের পর হাতছিপ্পু ‘চোথা’ বানায়। মনোজের বাবা সরকারি কর্মচারী। যিনি ঘুষ নেওয়ার প্রতিবাদ করে অন্যায় সাসপেনশনের জবাবে উপরওয়ালাকে জুতোপেটা করে চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন। তার আগে পর্যন্ত তিনি খোলার চাল আর মাটির ঘরের দাওয়ায় দড়ির চারপাইয়ে বসে কিশোরী কন্যাকে কবিতা মুখস্থ করাতেন, ‘হার নহি মানুঙ্গা, রার নহি ঠানুঙ্গা, কাল কে কপাল পর লিখতা-মিটাতা হুঁ, গীত নয়া গাতা হুঁ’। ছাদ থেকে তা শুনে মনে আর মগজে গেঁথে নিত মনোজ। আর মাকে বলত, বাবা সাসপেন্ড হলেও চিন্তা নেই। ১২ ক্লাস পাশ করলে চাপরাশির চাকরি তো পেয়েই যাব।

সতীর্থদের সঙ্গে দ্বাদশ ক্লাসের পরীক্ষায় অন্যান্য বারের মতোই প্রধানশিক্ষকের সক্রিয় সহায়তায় টুকলি করতে বসে মনোজ। আচম্বিতে সেখানে উদয় হন এলাকার ডেপুটি পুলিশ সুপার দুষ্মন্ত সিংহ। হাতেনাতে ধরা পড়ে সকলে। গ্রেফতার হন ‘ইমানদার’ অফিসারকে উৎকোচ দিতে গিয়ে ব্যর্থ প্রধানশিক্ষক। সেই পরীক্ষায় ফেল করে সব ছাত্র। দ্বাদশ ফেল! তাতে অবশ্য কিছু ইতরবিশেষ হয় না। সারা গ্রাম ফেল করে। আর অপেক্ষা করে পরের বছর দ্বাদশ পাশ করার জন্য।

মনোজের বাবা অন্যায় সাসপেনশনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই লড়তে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে শহরে রওনা দেন। পিছনে পড়ে থাকে পুরো পরিবার। মনোজ আর তার ভাই টেম্পো চালিয়ে দিন গুজরান করতে থাকে। তাতেও স্থানীয় বিধায়কের রোষানলে পড়ে তারা। মিথ্যা অভিযোগে টেম্পো বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় তাদের। মরিয়া মনোজ দ্বারস্থ হয় সেই সৎ পুলিশ অফিসারের। তিনি দুই ভাইকে উদ্ধার করেন। চোখ খুলে যায় মনোজের। সে ভাবে, তাকেও ওই রকম ‘ডিএসপি’ হতে হবে। পুলিশ অফিসারকে সে বলে, ‘‘আমি আপনার মতো হতে চাই। কী করতে হবে?’’ ডিএসপি মুচকি হেসে বলেন, ‘‘চিটিং বন্ধ করো। তা হলেই হবে।’’

সেই বাক্যটিকে ধ্রুবপদের মতো আঁকড়ে ধরে কোনওক্রমে বিএ পাশ করে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে লাট খেতে খেতে মনোজ এসে পড়ে দিল্লি শহরে। ততদিনে সে বুঝতে পেরেছে, ডিএসপি-র চেয়েও বড় আর ‘ভারী অফসর’ হলেন আইপিএস। সেই শুরু তার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেওয়ার সাধনা। লোকের বাড়ির শৌচাগার সাফ করে, লাইব্রেরিতে ভবিষ্যৎহীন ফুরনের খাটনদারের চাকরি করে, আটা পেষাইকলে কাজ করে, টিমটিমে বাল্‌বের আলোয় লেখাপড়া করে সে আইপিএস হওয়ার প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসে। সফল হয় না। তবু মনোজ হাল ছাড়ে না। তার লড়াইয়ে কিছু সঙ্গীও জুটে যায়। তাদের সহায়তা আর সহযোগিতায় তিন-তিন বার ফেল করে শেষমেশ ইউপিএসসি-র প্রবেশিকা পরীক্ষার বেড়া উতরোতে পারে মনোজ। উতরে যায় মূল পরীক্ষাতেও। কিন্তু ইন্টারভিউয়ে গিয়ে তাকে আবার সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়— সে দ্বাদশ ফেল কেন?

দরজা ঠেলে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হওয়ার আগে ইউপিএসসি দফতরের প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ বেয়ারা মনোজকে বলেন, সে যেন ভুলক্রমেও দ্বাদশে ফেল করার কথা না-বলে। অন্য যে কোনও অসত্য বলে গাঁটটা পেরিয়ে যায়।

কিন্তু তাবড় অফিসারদের সামনে সামান্য টাইট অনভ্যাসের শ্যু আর স্যুট-টাই পরিহিত মনোজের মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে সেই ধ্রুবপদ— তঞ্চকতা কোরো না।

মনোজ সত্য বলে। এ-ও বলে যে, সৎ পুলিশ অফিসার বদলি হয়ে যাওয়ার পরের বছর পরীক্ষায় তার ক্লাসের সকলে টুকলি করেছিল। একমাত্র সে করেনি। তাই সহপাঠীরা প্রথম ডিভিশনে পাশ করলেও সে পেয়েছিল থার্ড ডিভিশন। তাতে তার একটুও খারাপ লাগেনি। কারণ, সে মনে করেছিল— বেইমানির ফার্স্ট ডিভিশনের চেয়ে ইমানদারির থার্ড ডিভিশন অনেক ভাল!

ইন্টারভিউ বোর্ডে কড়া কড়া প্রশ্নের মুখে অকুতোভয় এবং সৎ থেকে মনোজ জবাব দেয়। চতুর্থ তথা শেষ বারেও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে কী করবে, সে প্রশ্নের জবাবে বলে, ‘‘হার নহি মানুঙ্গা, রার নহি ঠানুঙ্গা..। আইপিএস হওয়া আমার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য দেশের শোধন। আইপিএস না-হলে গ্রামে গিয়ে শিক্ষক হব। বাচ্চাদের শেখাব, চিটিং ছাড়তে হবে। ওই বয়সে ওরা এটা শিখে গেলে জীবনে আর কোনও দিন ঠকানোর রাস্তা নেবে না।’’

আইপিএসে সুযোগ পায় মনোজ। চাকরিতে যোগ দেওয়ার এক বছর পরে তার বিবাহের আমন্ত্রণপত্রটি নিয়ে সে সকলের আগে যায় সেই পুলিশ অফিসার দুষ্মন্ত সিংহের কাছে। পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। তিনি আগন্তুককে চিনতে না-পারায় বলে, ‘‘স্যর, আমি সেই ছেলে, যাকে আপনি চিটিং ছাড়তে বলেছিলেন।’’ তাঁর চেয়ে পদমর্যাদায় উঁচু আইপিএস অফিসারকে স্যালুট ঠোকেন ডিএসপি। তার পরে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আন্ডারডগের জীবন আখ্যান রূপকথার সোনার কাঠির ছোঁয়া পায়।

মনোজের ভূমিকায় বিক্রান্ত ম্যাসি সম্ভবত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়টি করেছেন। বিক্রান্ত নিজেও ছবিটি নিয়ে অভিভূত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বহু লড়াইয়ের পরে চূড়ান্ত প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন মনোজ হাঁটু ভেঙে অ্যাসফল্টের রাস্তার উপর বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে, সেই দৃশ্যে পরিচালক ‘কাট’ বলার বহু ক্ষণ পরেও ধারাস্রোতের মতো তাঁর দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে নেমেছে অশ্রু। ছবির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে বহু দিন। কিন্তু ‘মনোজ’ এখনও তাঁর সঙ্গে রয়ে গিয়েছে। বিক্রান্ত বলেছেন, ২০ বছর ধরে তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন। কিন্তু আড়াই বছর ধরে এই ছবিতে কাজ করতে করতে মানুষ হিসেবে তাঁর যে উত্তরণ হয়েছে, তা কেরিয়ারের বাকি সাড়ে সতেরো বছরে হয়ে ওঠেনি।

ঠিকই। ২ ঘণ্টা ২৯ মিনিট ধরে যে জাদু-বাস্তব পরতে পরতে বিধু বিনোদ খুলে ধরেছেন, তা অপলকে দেখলেও মনে হয়, আরও এক বার দেখি। এতটাই শক্তিশালী সেই আখ্যান! কিন্তু তার মধ্যেও সম্ভবত গভীরতম মুহূর্ত তৈরি হয় যখন টিমটিমে আলোয় আটা চাক্কির সামনে বসে রাষ্ট্রের সঙ্গে নিষ্ফল আইনি লড়াইয়ে ধ্বস্ত মনোজের বাবা ভেঙে-পড়ে পুত্রকে বলেন, ‘‘চল্, আমরা গ্রামে ফিরে যাই। ভেবেছিলাম, বেইমানির বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালে শেষে সত্যেরই জয় হয়। ভুল ভেবেছিলাম! আমি মূর্খ! সব বৃথা! সমস্ত! অনেক হয়েছে এই ইমানদারির লড়াই। আমাদের মতো লোকেরা এই লড়াইয়ে কখনও জেতে না!’’ তখন তাঁর যোদ্ধা ছেলের মুখে এক আশ্চর্য আলো জ্বলে ওঠে। ভরসার আলো। তার মনে পড়ে যায় বাবার গলাতেই শোনা, ‘হার নহি মানুঙ্গা...।’ বিহ্বল পিতাকে সে বলে, ‘‘কিন্তু হারও তো মানব না। পাপা, আপনি ভুলে গেলেন? হার নহি মানুঙ্গা, রার নহি ঠানুঙ্গা, কাল কে কপাল পর লিখতা-মিটাতা হুঁ...! আপনি লড়ুন! আমি আছি আপনার সঙ্গে।’’

বিক্রান্তকে এর আগে কঙ্কনা সেনশর্মার পরিচালিত ‘ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’ ছবিতে দেখেছি। সেখানে খানিক নিরুচ্চার ভঙ্গিতে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই ছবিতে বিক্রান্ত তাঁর প্রতিভার ডানা মেলে দিয়েছেন অভিনয়ের অসীম আকাশে। এতটাই বিশ্বাস্য লেগেছে তাঁকে। ‘হিন্দি মাধ্যম’-এর গেঁয়ো ছাত্রের শরীরী ভাষা, প্রাণখোলা হাসির সঙ্গে ঠোঁটের খোলা-বন্ধ সূচক উচ্চারণ হুবহু উঠে এসেছে তাঁর কণ্ঠে। এবং তাঁর চেহারা! শুটিং শুরুর আগে এক সহকারী পরিচালকের সঙ্গে প্যাক করে বিক্রান্তকে চম্বলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বিধু বিনোদ। সেখানে গায়ে আচ্ছা করে সর্ষের তেল মেখে রোজ তিন ঘণ্টা কড়া রোদে বসে থাকতেন বিক্রান্ত। কিছু দিন পরে তাঁর চামড়া খসে পড়তে শুরু করে। প্রথমে কাঁধ, তার পরে গলা। গায়ে ফোস্কা পড়ার উপক্রম। মলম-টলম দিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। ৩৬ বছরের যুবক তিনি। অথচ তাঁকে হতে হবে ১৯ বছরের তরুণ! কিন্তু পিছিয়ে আসেননি বিক্রান্ত। টানা ২০ দিন ধরে অর্ধতরল আর সেদ্ধ খাবারও খেয়েছিলেন। যাতে তাঁকে গঞ্জের রোগাপটকা দ্বাদশ ফেলের মতো লাগে।

‘টুয়েলভ্থ ফেল’ যে কত ঘটনা মনে পড়িয়ে দিয়ে গেল!

সরকারি আবাসনে অপরিসর ফ্ল্যাটে অনটনের সংসার। রেফ্রিজ়ারেটর কেনার পয়সা নেই বলে মাটির কুঁজোর জলেই প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার স্তোকবাক্য, টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য নেই বলে দিন আনি-দিন খাই বাবা-মায়ের বলা, টিভি দেখলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে! তাই টিভি কেনা হচ্ছে না। প্রতি বুধবার বিকেলে দূরদর্শনে যখন ‘চিত্রহার’-এর টানে খেলা ফেলে বন্ধুরা দৌড় লাগাত বাড়িতে, তখন একা মাঠে ফেকলুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা। প্রতিটি জন্মদিনে বাংলা অনুবাদে বিশ্বসাহিত্যের পাঁচটা করে বিখ্যাত উপন্যাস উপহার পাওয়ার অভ্যাস। মাধ্যমিকে মাপমতো ভাল রেজ়াল্ট করেও উচ্চ মাধ্যমিকে আশানুরূপ ফল না-হওয়ার গ্লানি (প্রায় দ্বাদশ ফেল)। ভালবাসার বাংলা অনার্স নিয়ে কলেজে পড়তে চাই শুনে পরিপার্শ্বের টীকাটিপ্পনী (বাংলায় এমএ-দের তো চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচায় বাঘ সাজার চাকরি নিতে হয়)। পার্ট ওয়ানের ফলপ্রকাশের দিন একলা ঘরে ঠাকুরের আসনের সামনে একটি মাত্র প্রদীপ জ্বালিয়ে পুত্রের জয়ের আশায় বসে থাকা আকুল মা। বিএ পাশ করেই বাংলা কাগজের চাকরির প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষানবিশ সাংবাদিকতায় ঢুকে-পড়া নিয়ে সকলের অনুযোগ— লেখাপড়াটা আর হল না!

চারপাশের সেই গুঞ্জনের মধ্যেও প্রাণপণে নিজেকে বলতাম, তোমার যেটা স্বাভাবিক ভাবে ভাল লাগে, তার দিকে মন দাও। সেটাই তোমার পথ, তোমার ভালবাসা আর তোমার বেঁচে থাকার অর্থ। সেটাকেই আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেখাও।

এখন যখন পেশার প্রদোষকালে কর্মজীবনের সূর্য পশ্চিমদিগন্তে ঢলে পড়েছে, তখন মনে হয়, জীবনের ৩০-৩৫ বছর ধরে যে অক্ষরেখায় হাঁটছি, সেটা ২/১ ডিগ্রি ঘুরে গেলে অন্য জায়গায় থাকতেও পারতাম। জীবনটা এ রকম হত না। চিত্তের সঙ্গে কিছু বিত্তও থাকত। কিন্তু সেই বিচলনটা হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি! যা করেছি, তা নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই। থাকেনি কখনও। বরাবর মনে করেছি, বাইরের অন্ধকার নয়, আসলে ভয় পেতে হবে ভিতরের অন্ধকারকে। যে অন্ধকার সুবিধার লোভে সমঝোতা করতে শেখায়।

‘টুয়েলভ্‌থ ফেল’ ফিরিয়ে নিয়ে গেল অতীতের দিন আর রাতগুলোয়। পরিশ্রম, একমুখিতা এবং হার-না-মানার প্রতি বিশ্বাসকে আবার প্রতিষ্ঠিত করে গেল। ‘না’ বলার তাকত আরও জোরালো করে দিয়ে গেল।

বলে দিয়ে গেল, ‘হার নহি মানুঙ্গা’। বলে দিয়ে গেল, আমাদের মতো যারা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘ফেল’ করেও বিশ্বাস হারাইনি, ‘রিস্টার্ট’ করেছি বার বার, তাদের মতো ‘দ্বাদশ ফেল’ মূঢ়মতিদের ঐকতানের এটাই সুর।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy