অবসর ঘোষণার দিনে এই জুতোজোড়াই টেবিলে তুলে রেখেছিলেন সাক্ষী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কয়েক বছর আগে রাজ্য রাজনীতির প্রথম সারির এক দাপুটে নেতাকে বলেছিলাম, আপনি কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে যাচ্ছেন। বিপরীতে একটা রাষ্ট্রের সমর্থন আপনার প্রয়োজন। খুব প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্র ছাড়া লড়ে জেতা যায় না। সেই নেতা তখন তৃণমূলে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিজেপিতে চলেছেন। বেড়া যে ডিঙোতে হবে, তা নিয়ে তাঁর মনে কোনও সংশয় নেই। ‘জোশ’ও যথেষ্ট ‘হাই’। তা সত্ত্বেও তিনি উপযাচক হয়ে জ্ঞানদান করতে-যাওয়া হিতৈষী রিপোর্টারকে হ্যাক-ছি বলে ভাগিয়ে দেননি। মন দিয়ে শুনেছিলেন এবং ঘাড় নেড়েছিলেন।
পরবর্তী কালে তিনি হাড়ে-মজ্জায় সেই সাবধানবাণীর মর্মার্থ বুঝেছেন। বাংলার রাজনীতিতে তাঁকে আর কেউ পোঁছে না। সিরিয়াসলি নেয় না। নাম লিখে তাঁকে আরও বিড়ম্বিত করতে চাই না। কিন্তু তাঁকে বলা কথাটা বার বার নিজের মধ্যে আওড়াই। অনুজ সহকর্মীদের প্রায়শ বলিও— জুতসই খোঁটা (বা খুঁটি) না থাকলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে জেতা যায় না।
সাক্ষী মালিককে দেখে আবার সেই কথাটা মনে হল।
সাক্ষী অলিম্পিক্স পদকজয়ী প্রথম ভারতীয় মহিলা কুস্তিগির। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক জয় করে রেলের করণিক থেকে গেজ়েটেড অফিসার পদে উন্নীত হয়েছেন। সেই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু সাক্ষী হয়ে পড়লেন ‘অ্যাকটিভিস্ট’। আন্দোলনকারী। মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থার প্রতিবাদে সহ-কুস্তিগিরদের নিয়ে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সর্বোচ্চ কর্তা তথা বিজেপির প্রতাপশালী সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন তিনি। প্রতিকার চেয়ে সতীর্থদের নিয়ে ৪০ দিন খোলা রাস্তায় থাকলেন। হরিদ্বারে গঙ্গার জলে অলিম্পিক্সের পদক ভাসিয়ে দিতে গেলেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে মরিয়া হয়ে সংসদের অভিমুখে মিছিল করতে চাইলেন। রাজপথ থেকে টেনেহিঁচড়ে তাঁদের প্রিজ়ন ভ্যানে তুলেছিল দিল্লি পুলিশ। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে পদকজয়ী কুস্তিগিরদের নড়া ধরে পুলিশের গ্রেফতার করার দৃশ্য দেখে বিহ্বল হয়েছিল দেশ। ফেসবুকের পাতায় পাতায় টপটপ করে কিছু অশ্রু। কিছু ভার্চুয়াল গর্জন। ওই পর্যন্তই!
২১ ডিসেম্বর নির্বাচন হল ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের। ১২ বছর একটানা রাজত্বের পরে ব্রিজভূষণকে সংস্থার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরানো হয়েছিল। তাঁকে এই ভোটে লড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু লড়েছিলেন সঞ্জয় সিংহ। তিনি ব্রিজভূষণের একনিষ্ঠ অনুগামী তো বটেই। ব্যবসার অংশীদারও বটে। নির্বাচনে সঞ্জয়ই জিতলেন (তাঁর বিপক্ষে ছিলেন এক প্রাক্তন মহিলা কুস্তিগির। দাঁড়াতেই পারেননি)। জিতে গেলেন ব্রিজভূষণের প্যানেলভুক্ত ১৩ জনও। অস্যার্থ: জিতলেন ব্রিজভূষণই। কুস্তি ফেডারেশনের মোট ১৫টি পদের মধ্যে ১৩টিই রইল উত্তরপ্রদেশের এই বাহুবলী নেতা তথা প্রাক্তন ‘পালোয়ান’-এর পাঞ্জার তলায়। আশ্চর্য নয় যে, নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের পরে থরে-বিথরে গাঁদাফুলের মালা গলায় নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্রিজভূষণ বললেন, ‘‘যাদের (ভোটের এই ফলাফল থেকে) বার্তা নেওয়ার আছে, তারা নিক! কুস্তিতে আমাদের দাপট ছিল। দাপট থাকবে। এই জয় দেশের সমস্ত পালোয়ানের জন্য।’’
বার্তা বলে বার্তা! কিছু ক্ষণের মধ্যে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং সফল পালোয়ান কুস্তি থেকে অকাল-অবসরে চলে গেলেন। সাক্ষী বলছিলেন, ‘‘আমরা কুস্তি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট পদে একজন মহিলাকে চেয়েছিলাম। তা হলে মহিলা কুস্তিগিরেরা অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করত। কিন্তু আমাদের সেটাও দেওয়া হল না।’’ তার পরেই নাটকীয় ভাবে অলিম্পিক্স পদকজয়ী কুস্তিগির ঘোষণা করলেন, ‘‘আমি কুস্তিকে বিদায় জানাচ্ছি। আর কখনও ম্যাটে নামব না। আশা করব, অন্য কুস্তিগিরেরা এই লড়াইটা চালিয়ে নিয়ে যাবে।’’
তার কিছু ক্ষণের মধ্যে খবরের চ্যানেল ধরল ব্রিজভূষণকে। প্রতিক্রিয়া চাই। তিনি খুব নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ‘‘তাই নাকি? কী জানি! এর সঙ্গে আমার আর কী লেনা-দেনা আছে?’’
বাহুবলী সাংসদের (নরেন্দ্র মোদী তাঁকে খুব পছন্দ করেন, বিজেপির অন্দরে এমন অভিযোগ নেই। তবে কিনা, তাঁকে উপেক্ষাও করতে পারে না দল। তার উপর এখন আবার সামনে লোকসভা ভোট) প্রথম সগর্ব নির্ঘোষ এবং তার পরে সাক্ষীর অবসরের খবরে তাঁর হেলাফেলাপূর্ণ মন্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল, এই ঘটনায় কি গোটা দেশেরও কোনও হেলদোল আছে? বা কোনও লেনা-দেনা? কী অনায়াস নির্লিপ্ততায় ২২ তারিখ সকালেই উইকিপিডিয়ায় তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়ে গিয়েছে ‘সাক্ষী মালিক ইজ় আ রিটায়ার্ড ফ্রিস্টাইল রেসলার’।
রিটায়ার্ড! অবসরপ্রাপ্ত! এমনিতে সোজাসাপটা এবং সঠিক তথ্য প্রচারকারী একটা শব্দ। কিন্তু নিছক শব্দই। সে শব্দে কোথাও লেখা রইল না হরিয়ানার রোহতকের বাস কন্ডাক্টরের কন্যার আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে রাষ্ট্রকে একের পর একে গরিমা এনে দেওয়ার কথা। লেখা রইল না সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই তাঁর লড়াইয়ের কথা। সে শব্দে কোথাও ধরা থাকল না তাঁর চোখের জল, অসহায়তা আর গাণ্ডীব নামিয়ে রেখে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাওয়া।
ঠিকই। থাকবেই বা কেন? একে মহিলা। তায় কুস্তির মতো কার্যত প্রান্তিক এক স্পোর্ট। হরিয়ানার বিভিন্ন আখড়া থেকে উঠে-আসা সাক্ষী মালিকদের কে চিনত, যদি না আমির খান তাঁর ‘দঙ্গল’ নিয়ে সর্বভারতীয় (এবং আন্তর্জাতিক) মঞ্চে আবির্ভূত হতেন?
টেবিলের তলা থেকে নীলের উপর সোনালি ডোরা দেওয়া কুস্তির জুতোজোড়া টেবিলের উপরে মাইক্রোফোনের পাশে রেখে কাঁদতে কাঁদতে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন ৩১ বছরের কুস্তিগির, তাঁকে দেখতে দেখতে কয়েক বছর আগে সেই বঙ্গজ রাজনীতিককে বলা কথাটা আবার মনে হচ্ছিল— রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়ে জিততে গেলে রাষ্ট্রের সহায়তা দরকার হয়। মনে পড়ছিল অনুজ সহকর্মীদের লঘু চাপল্যে বলা কথাটা— জুতমতো খুঁটি না-থাকলে রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়ে জেতা যায় না।
সাক্ষীর অবসর ঘোষণার পরে তাঁর সতীর্থ কুস্তিগির বজরং পুনিয়া ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব ফিরিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। বলেছেন, ‘‘সারা রাত কেঁদেছি! মহিলা কুস্তিগির নিরাপত্তার অভাব বোধ করে চিরকালের জন্য কুস্তি ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে! আমি আর এ সব সম্মান রেখে কী করব?’’ দীর্ঘ চিঠিতে নিজেদের আন্দোলনের বিবরণ দিয়েছেন বজরং। ‘পদ্মশ্রী’ পদক এবং সেই চিঠি নিয়ে বজরং রওনা হয়েছিলেন সংসদ ভবনের দিকে (মতান্তরে, প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান লোককল্যাণ মার্গ অর্থাৎ, সাবেক রেসকোর্স রোড অভিমুখে)। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সম্মান ফেরাবেন বলে। পুলিশ মাঝপথে আটকে দেয় তাঁকে। রাজধানীর কর্তব্যপথের (সাবেক রাজপথ) ফুটপাথে চিঠিটি রাখেন বজরং। তার উপরে ‘পদ্মশ্রী’ পদকটি রেখে চলে আসেন। পুলিশ এসে চিঠি আর পদক তুলে নিয়ে চলে যায় কে জানে কোথায়! হয়তো পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানার মালখানায়। সংবাদমাধ্যম ছাড়া সেই ঘটনা নিয়ে খুব হইচই হয়েছে বলে তো শুনিনি। উল্টে কুস্তির নিয়ামক সংস্থা বলেছে, ‘‘নির্বাচন সম্পূর্ণ ঠিকঠাক হয়েছে।’’ অর্থাৎ, যে দাবি নিয়ে সাক্ষী-বজরংরা অবসর নিয়ে ফেলছেন বা সরকারি খেতাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন, তার কোনও ভিত্তি নেই।
দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, কুস্তির প্যাঁচ জানতে পারেন সাক্ষী। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির রাজনীতির পয়জারের বিন্দুবিসর্গও জানেন না। আবার পাশাপাশিই মনে হচ্ছিল, সাক্ষী তো হাজার হোক অলিম্পিক্স পদকজয়ী কুস্তিগির! যোদ্ধা! লড়ুয়ে! জীবনের দঙ্গল থেকে সরে গিয়ে কি ঠিক করলেন? ঠিক করলেন কুস্তিকে অকালে বিদায় জানিয়ে? জুতোজোড়া টেবিলে তুলে রেখে তাঁর অশ্রুসজল চোখে বেরিয়ে যাওয়া নাটকীয় কিছু মুহূর্ত তৈরি করল বটে। কিন্তু তাঁর এই অভিমানী প্রস্থান কি কেউ মনে রাখবে? নীরবতা কি সত্যিই চিৎকৃত প্রতিবাদের চেয়ে সশব্দে বাজে এখনও?
পৃথিবীটা শুধু ঝলমলে রোদ্দুর আর রামধনুর নয়। এটা একটা নিষ্ঠুর জায়গা। যতই রোখাচোখা আর কঠিন মানসিকতার হোন না কেন, এই দুনিয়া আপনাকে মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দেবে। আর ওখানেই রেখে দেবে যদি আপনি সেটা ঘটে যেতে দেন। ফলে জীবন আপনাকে কত জোরে মারল, সেটা আসল কথা নয়। আসল হল, আপনি মার খেতে খেতেও কতটা এগোতে পারলেন। কতটা সহ্য করার ক্ষমতা দেখাতে পারলেন। আর সেই সহ্যক্ষমতা দিয়ে লড়তে লড়তে কতটা এগোতে পারলেন। সাক্ষী কুস্তিগির। এই আপ্তবাক্য তো তাঁর জীবনেরই কাহিনি। তবু তিনি রিং ছেড়ে চলে গেলেন?
তার পরে মনে হল, ঠিকই করেছেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসম লড়াই লড়া যায়। জেতা যায় না। রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান। সাক্ষী মালিক অকালে অবসর নিন বা বজরং পুনিয়া ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব ফিরিয়ে দিতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখুন, পদক ফেলে আসুন পথের পাশে। রাষ্ট্রের তাতে কিস্যু আসে-যায় না।
শুধু দেশ একজন চ্যাম্পিয়নকে অকালে হারায়। সাক্ষী হয়ে রয়ে যায় তাঁর দু’পাটি জুতো। গোটা দেশের দুই গালে দু’টি চপেটাঘাতের মতো!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy