গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
জনগণের স্বার্থে সরকার বিশেষ করে দরিদ্রজনের হিতার্থে কত না প্রকল্প চালু করে। প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী ওই প্রকল্প— এমন অনেক প্রকল্পের কথাই তো আমরা জানি। সবই কি সঠিক ভাবে রূপায়িত হয়? সফল হয়? না। হলে তো দেশে গরিব মানুষই থাকত না। হয়তো কোটিপতিও থাকত না। কিন্তু তাঁদের নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। আমরা অভিজ্ঞতায় জানি, অনেক প্রকল্পের কথা সাধারণ জন জানতেই পারে না। কারণ, প্রচার নেই। প্রকল্পের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যাপক প্রচার দরকার। তা হলে কী করণীয়? বাড়ি বাড়ি ইমেল বা পোস্ট কার্ড পাঠালে হবে?
হবে না। কারণ, শুধু জানানোই যথেষ্ট নয়, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এগিয়ে এসে প্রকল্পের সুযোগ নিতে। নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে। হিন্দুদের সব ভাল। কিন্তু তাদের এক সর্বনেশে প্রবৃত্তি আছে নিয়তিকে মেনে নেওয়ার। বাচ্চাটার কঠিন ব্যামো। তীর্থ করলাম। সাধু-সন্তদের আপ্যায়ন করলাম। বাড়িতে এনে রাখলাম। কিছুতেই কিছু হল না। পূর্ব জন্মের পাপের ফল। খণ্ডায় কার সাধ্যি। এই মানসিকতা কমেছে বটে, কিন্তু পুরোপুরি যায়নি। তাই সরকারি প্রকল্পে টাকা আছে জেনেও অনেকে নিতে চান না। যদি না কোনও দেবদূত এসে আমাদের বলে সরকারি প্রকল্পের টাকা না-ও, তোমার সব দুঃখ মিটে যাবে— তা হলে কাজ হয়।
কিন্তু দেবদূত যে যাবেন মানুষের কাছে, তিনি তো অটোয় বা টোটোয় যাবেন না। তাঁর জন্য রথের ব্যবস্থা করতে হয়। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ফরমান জারি করেছে যে, আসছে জানুয়ারি থেকে ছ’মাস জয়েন্ট সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি পদমর্যাদার আধিকারিকেরা রথে চড়ে ঘুরবেন দেশের ৭৬৫ জেলায়। মানুষকে বুঝিয়ে বলবেন, বিগত ন’বছরে সরকার কী কী প্রকল্প গ্রহণ করেছেন এবং তাতে সাধারণ মানুষের কতটা উপকার হয়েছে। এই ক’দিন তা হলে শুধু প্রচারের কাজ হবে? অন্য কোনও কাজ হবে না? তাতে অসুবিধা নেই। লোকসভা নির্বাচনের জন্য এমনিতেই কাজ বন্ধ থাকত। এই কারণেই তো প্রধানমন্ত্রী মোদী নির্বাচন পছন্দ করেন না।
সরকারি সার্কুলার বলছে, এই কাজ চলাকালীন আধিকারিকদের নাম হবে ‘রথপ্রভারী’। তা কী করে হয়? রথী-মহারথীদের নামে তফাত থাকবে না? জয়েন্ট সেক্রেটারি হবেন বরিষ্ঠ রথপ্রভারী অথবা রথ-মহাপ্রভারী। এই মর্মে একটা সংশোধনী জরুরি হয়ে পড়েছে। আর তাঁদের নাম যদি হয় নোডাল অফিসার, তা হলে তো সবটাই ফাঁকি। জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং ডেপুটি সেক্রেটারির রথের সাইজও হবে ভিন্ন। জয়েন্ট সেক্রেটারির রথ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আশা করি, দ্বিতীয় সার্কুলারে এ সব কথার স্পষ্টীকরণ থাকবে। বিরোধীরা যথারীতি আপত্তি তুলেছে। বলছে, সরকারি আধিকারিকদের নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করা যাবে না। আমি একটা সমাধান সূত্র দিতে পারি। অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের ব্যবহার করা হোক এ কাজে। তাঁদের দু’পয়সা রোজগার হবে। বিতর্কও হবে কম। কিন্তু অকৃতী অধমের কথা শুনবে কে?
সরকারি আধিকারিকেরা পারবেন এই দায়িত্ব পালন করতে? যাঁদের অফিসে পৌঁছতে সাধারণ মানুষকে পুলিশের তিনটে বেষ্টনী পেরোতে হয়, তাঁরা পারবেন মানুষের কাছে হাজির হতে? কাজটা সহজ হবে না। কত কিলোমিটার রাস্তা হয়েছে, ক’টা আবাসন বিলি করা হয়েছে, কোথায় ক’টা মন্দির তৈরি হয়েছে সে কথা তাঁরা গড় গড় করে বলে যেতে পারবেন। সমস্যা অন্যত্র। কেউ যদি বলেন, ‘‘স্যর গণতন্ত্র সম্বন্ধে কিছু বলুন! আমরা চিরকাল গর্ব করে বলেছি আমাদের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র। সে সুনাম কি এখনও আছে?’’ মোদীজি এ প্রশ্নের সম্মুখীন হলে চলে যেতেন ২৫০০ বছর আগে। বলতেন, ‘‘বালক এ কথা জানো কি যে, ভারতই গণতন্ত্রের জননী?’’ রথপ্রভারী কিন্তু সে কথা বলতে পারবেন না। তাঁর এক্তিয়ার ২০১৪ পর্যন্ত। তার আগে যা হয়েছে তা নিয়ে কিছু বলার অধিকার তাঁর নেই।
তাঁকে বলতে হবে আজকের কথা। আজকের ভারতে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত। এ কথা আমরা যেমন জানি, তেমনই জানেন আমাদের ‘রথপ্রভারী’ও। তিনি অসত্য কথা বলতে পারবেন না। প্রথমত, আমলারা অসত্য কথা বলেন না। দ্বিতীয়ত, ভয় থাকবে, মিথ্যা বললে যদি রথের চাকা মাটিতে বসে যায়? সে ঝুঁকি তিনি নেবেন না। এই সঙ্কটের মোকাবিলায় তিনি কি করেন তা দেখার ইচ্ছা রইল। দেশের আইন এক দিকে বলে, সরকারি চাকুরেদের নির্বাচনী প্রচারের কাজে লাগানো যাবে না। অন্য দিকে, আমলাদেরও নির্দেশ দেয় নিরপেক্ষ থাকতে। সরকারি সার্কুলারে দুই বিধিরই লঙ্ঘন হয়। বিরোধীদের এই সমালোচনার জবাবে বিজেপির কি বক্তব্য? পার্টির প্রবক্তা বলেছেন, সরকারি নির্দেশ আমলারা মানতে বাধ্য। তাঁদের তো গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই! স্বামীজি বলতেন, প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত। এ হল প্র্যাকটিকাল গণতন্ত্র। সরকার যা বলবে সেটাই ঠিক।
সরকারি অফিসারদের নিরপেক্ষতার কথা আজকাল বড় একটা শোনা যায় না। ইন্দিরা গান্ধী ‘কমিটেড ব্যুরোক্র্যাট’ চেয়েছিলেন তা-ও তো ৫০ বছরের উপর হয়ে গেল। মোদী সরকার যে ভাবে ইডি, সিবিআই আর আয়কর বিভাগকে কাজে লাগাচ্ছে, তাতে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তোলাও বিপজ্জনক। তা-ও যে কংগ্রেস ও বিরোধীরা এ প্রশ্ন তুলেছে, তার জন্য তাদের সাধুবাদ জানাতে হয়। তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, প্রভারীর রথ আটকাতে না পারলে হিন্দুত্বের রথ আটকানো যাবে না। বিজেপির প্রচারক বলতে শুরু করেছেন যে, মোদী যেমন ভারতীয় নাগরিকের নির্বাচিত নেতা, তেমনই বিধাতার মনোনীত নেতাও বটে। তাঁর দায়িত্ব শুধু ভারতের উন্নয়ন নয়, তিনি এসেছেন গোটা বিশ্বকে নৈতিকতার পথ দেখাতে। পাশ্চাত্যের নেতৃত্বে আমরা এগোচ্ছিলাম এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে। বিধাতা এখন মোদীকে দায়িত্ব দিয়েছেন ধর্মের গ্লানি দূর করে মনুষ্য জাতিকে উদ্ধার করতে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে কেন আমরা আমলাদের আচরণবিধিকে অতটা গুরুত্ব দিতে যাব?
আমলাদের মাঠে নামানো হচ্ছে বীর যোদ্ধার বেশে। আর সেনাবাহিনীর জওয়ানদের বলা হচ্ছে, ছুটিতে থাকার সময়ে মানুষের কাছে গিয়ে সরকারি কাজকর্মের ব্যাখ্যা দিতে। ইংরেজি জানা মানুষ বলবেন, সেনাবাহিনীর গৈরিকীকরণ হচ্ছে। বলুক গিয়ে। আমরা জানি, আমাদের পীড়িত, লাঞ্ছিত বহু পরাজিত দেশে সরকারের প্রধান কাজ সীমান্তরক্ষা। ভূমি সংস্কার নয়। তাই আমলাবর্গ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনও কৃত্রিম প্রাচীর আমরা রাখব না।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy