হিমানশু-সুস্মিতা কি আসলে মনে করেছিলেন বিষণ্ণ নৈকট্যের চেয়ে দূরে থাকার ভালবাসা অনেক বেশি কাম্য? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
একজনকে খুবই ক্ষীণ ভাবে চিনতাম। মাত্র কয়েক ঘণ্টার আলাপ। খানিক সাহস এবং খানিক ওপরচালাকিতে ভর করে সটান গিয়ে পেশাগত সহায়তা চাওয়া। এবং কেন কে জানে, পাওয়া।
অন্যজনকে চিনতাম না। জীবনে কখনও দেখা হয়নি। হওয়ার অবকাশও বিশেষ ছিল না।
প্রথমজন দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন ২০১৮ সালের ১১ মে। স্বেচ্ছায়। নিজের মুখে সার্ভিস রিভলভারের নল ঢুকিয়ে আত্মঘাতী ট্রিগার টেনে দিয়ে। দ্বিতীয়জন চলে গেলেন গত ৩১ অক্টোবর। স্বেচ্ছায়। উত্তর কলকাতার শহরতলিতে ডানলপের কাছে নিজের বি-হাইভ গার্ডেনের চারতলার ফ্ল্যাটে। গলায় দড়ি দিয়ে।
প্রথমজন ৫৫ বছরের হিমানশু (বাঙালি ‘হিমাংশু’ নয়। মরাঠি ‘হিমানশু’) রায়। ১৯৮৮ ব্যাচের আইপিএস। মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ছাত্র। মহারাষ্ট্র পুলিশের প্রাক্তন অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল, মুম্বই পুলিশের প্রাক্তন যুগ্ম কমিশনার এবং মহারাষ্ট্র পুলিশের জঙ্গিদমন শাখার প্রাক্তন প্রধান। আইপিএলে গড়াপেটার তদন্ত করে আচ্ছা আচ্ছা লোককে জেলে পুরেছেন। ঈর্ষণীয় কেরিয়ারের অধিকারী। সৎ। বন্ধুবৎসল। সহকারী অফিসারদের প্রশংসাকারী (পুলিশ মহলে আপাত-বিরল দৃষ্টান্ত)। হ্যান্ডসাম। স্মার্ট। নিয়মিত জিমন্যাসিয়ামে শরীরের সৌষ্ঠব গঠনকারী। জোরাল হাতের বাঘা পাঞ্জায় করমর্দন (মর্দনই বটে) করায় অন্তরাত্মা পর্যন্ত কে রে-কে রে করে উঠেছিল। ঘন ভ্রূ-র নীচে গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। মিতবাক। অথচ দোর্দন্ডপ্রতাপ। মাথার কুচকুচে কালো ব্যাকব্রাশ চুল থেকে পায়ের পালিশ-করা বুট পর্যন্ত পুলিশ অফিসার। আনখশির।
দ্বিতীয়জন সুস্মিতা রায়চৌধুরী। সদ্য ৬০ বছরে পদার্পণকারিনী। সামাজিক আন্দোলনের পরিচিত মুখ। সমাজকর্মী। বন্ধুবৎসলা। হইহই করে জীবন-বাঁচা। স্বামী, অগুন্তি পরিচিত মানুষ এবং কাছের লোকজনকে নিয়ে ঘেরা তাঁর দুনিয়া। বিবাহিতা। কোনও দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন বলে শোনা যায়নি। আপাতদৃষ্টিতে জীবন সম্পর্কে কোনও গ্লানি, কোনও হতাশা বা তীব্র কোনও মানসিক যন্ত্রণাও ছিল না। কোনও আকস্মিক অভিঘাত তাঁর মৃত্যু (‘আত্মহত্যা’। সুস্মিতার কাছে ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’) ডেকে আনেনি।
আত্মহত্যা অপরাধ কি না, তা নিয়ে আইনি বিতর্ক এখনও অমীমাংসিত। কোনও মানুষের আত্মহত্যা কী ভাবে ধ্বস্ত, অসহায় এবং নাচার করে দিয়ে যায় তাঁর পরিজন, পরিবার এবং পারিপার্শ্বিককে, তারও দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। তবু, তবু তিন বছরের ব্যবধানে দু’টি মৃত্যু কোথাও একটা একই বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল এক বিস্মিত অবলোকনকারীকে। সেই বিন্দুতে প্রশ্নের সিন্ধু।
প্রথমজন বোন ম্যারো ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। অস্থিমজ্জায় কর্কট রোগের শিকার প্রতাপশালী আইপিএস ভেবেছিলেন, ক্যানসারকে হারিয়ে আবার কখনও না কখনও জিমে ফিরবেন। বিদেশে চিকিৎসা করিয়ে সাময়িক সুস্থও হয়েছিলেন। কিন্তু ক্যানসার তাঁকে ছেড়ে যায়নি। পায়ের গোছ থেকে পৌঁছেছিল মস্তিষ্কে। চিকিৎসার জন্য টানা এক বছর ছুটি নিতে হয়েছিল চাকরি থেকে।
অসহায় রোগযন্ত্রণা এবং অবসাদের শেষ সীমায় পৌঁছে একদিন দুপুরের খাওয়ার পর নিজের বেডরুমে ঢুকে ধীরেসুস্থে লোডেড সার্ভিস রিভলভারের ঠান্ডা নল মুখে ঢুকিয়ে যিনি নিজের জীবনে ঐচ্ছিক ইতি টেনে দিলেন, তাঁর সুইসাইড নোটে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল, ‘টেকিং দিস এক্সট্রিম স্টেপ আউট অব এক্সট্রিম ডিপ্রেশন ডিউ টু অ্যান ইনকিউরেব্ল ক্যানসার।’ দুরারোগ্য ক্যানসারে ভুগতে ভুগতে চূড়ান্ত অবসন্ন আমি। তাই এই চূড়ান্ত পদক্ষেপ করছি।
দ্বিতীয়জন এক বছর আগে ফেসবুকে তাঁর ‘এপিটাফ’ লিখেছিলেন— ‘আমার মরণবাসর সজ্জা আমি নিজেই রচনা করব। এটা আমার খুব ছোটবেলার স্বপ্ন।…আমার প্রচন্ড ভালবাসার জীবনকে আমি কিছুতেই স্বাভাবিক যাপনের বিরুদ্ধে আপস করতে দেব না। সেই ছোট্টবেলা থেকে জরা, ব্যাধি, মৃত্যুর কথা জানি। জীবনকে যতটা ভালবাসি, মৃত্যুকেও ততটাই ভালবাসি। মৃত্যুকে কোনওদিন ভয় পাইনি বলেই তো জীবনকে এত গভীর ভাবে উপভোগ করতে পেরেছি। রোগশয্যায় শুয়ে মৃত্যুর কাছে কাতর অনুনয় করতে পারব না। ভিক্ষা নয়, মৃত্যুকেও আমি অর্জন করতে চাই। মৃত্যু আমার কাছে পালানো নয়। আমি মৃত্যুর প্রণয়প্রার্থী। যেদিন আমার স্বাস্থ্য আমার সুরে মিলবে না, আমার তালে পা ফেলতে পারবে না, সেদিন বিদায় জানিয়ে আমি জীবনের হাত ছেড়ে দেব।’
আনন্দবাজার অনলাইনে সুস্মিতার মৃত্যু (স্বেচ্ছামৃত্যু) নিয়ে দীর্ঘ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর পরিপার্শ্বে একটা আলোড়ন পড়েছে। যে তরঙ্গ এখনও চলছে। চলতেই থাকছে। এবং ক্রমশ উত্তাল ঢেউয়ে পরিণত হচ্ছে। ইতিউতি বিভিন্ন আলোচনায় আর অনুষঙ্গে আসছে সুস্মিতার কথা। কেউ বলছেন মানসিক দুর্বলতা, পলায়নী মনোবৃত্তি বা স্বার্থপরতা। কেউ কুর্নিশ জানাচ্ছেন সুস্মিতাকে। কারণ, সুস্মিতার মৃত্যু আত্মহত্যার কারণ হিসেবে অদ্যাবধি বর্ণিত বিভিন্ন তত্ত্বকেই সটান চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছে। ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে দীর্ঘদিনের লালিত সব ‘মিথ’।
আর এই বিস্মিত জীবনযাত্রীকে মনে করিয়ে দিয়েছে তিন বছর আগে স্ব-ইচ্ছায় দুনিয়া ছেড়ে-যাওয়া ঘণ্টাখানেকের আলাপী ‘রায়সাহেব’-এর কথা। সেই বিন্দুতে দাঁড়িয়েই তৈরি হয়েছে প্রশ্ন-সিন্ধু।
হিমানশু যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, সুস্মিতা কি তেমন কোনও পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা থেকেই নিজেকে সচেতন ভাবে রেহাই দিয়ে গেলেন? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আত্মনির্ভরতা থেকে পরনির্ভরতার দিকে এক অমোঘ সরণ ঘটে। সুস্মিতা কি আসলে সেই সরণটা আটকাতে চেয়েছিলেন নিজের প্রাণকেই পণ করে?
হিমানশু-সুস্মিতা কি আসলে মনে করেছিলেন বিষণ্ণ নৈকট্যের চেয়ে দূরে থাকার ভালবাসা অনেক বেশি কাম্য? তাঁরা কি আসলে মরবিড অ্যাটাচমেন্টের চেয়ে লাভিং ডিটাচমেন্টে বেশি বিশ্বাস রেখেছেন?
চুরানব্বইয়ের ডিমেনশিয়া-আক্রান্ত বৃদ্ধ যখন টানা ৩৫ দিন আইসিইউ-এ কাটিয়ে ইহলোক ছেড়ে যান, তখন মনে হয়, যাক বাবা! যাওয়ার আগের দিনগুলো তো যত্নে রইলেন। পিতৃবিয়োগের খবর ঘনিষ্ঠদের বলতে দ্বিধা হয়। জড়তা আসে। কারণ, উল্টোদিক থেকে অবধারিত আসে, ‘‘ওহ্! অনেক বয়স হয়েছিল তো।’’
আর্থারাইটিসে কার্যত পঙ্গু, পাঁচ ফুট বাই আট ফুটের বিছানা-বন্দি অশীতিপর বৃদ্ধা তাঁর শিক্ষিকাজীবনের দিনগুলোর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস মোচন করতে করতে নিয়ত স্বগতোক্তি করেন, ‘‘এ জীবন আর বাঁচতে ভাল লাগে ন।!’’ আর বিস্মিত জীবনপথিকের মনে হতে থাকে, আসলে বোধহয় বার্ধক্যে সত্যিই কোনও মর্যাদা থাকে না। যাকে আমরা মর্যাদা বলি, তা আসলে স্রেফ আর্থিক স্বাচ্ছল্য আর এক ধরনের পরিকাঠামোগত নির্ভরতা।
জিম-স্যাভি, সর্বদা ফিটফাট পোশাকদুরস্ত এবং ‘মাচো’ পুলিশ অফিসার হিমানশু স্বেচ্ছাহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, জীবন তাঁকে আর সেই দিনগুলো ফিরিয়ে দেবে না। যে অন্ধকার গহ্বরে তিনি ঢুকে পড়েছেন, তা তাঁকে সেপ্টোপাসের মতো গিলে ফেলছে। দ্রুত এবং অবধারিত। তাতে অবসাদ ছিল। চূড়ান্ত অবসাদ। কিন্তু সুস্মিতার মৃত্যুতে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা জীবনের সঙ্গে তাঁর প্রেম ভেঙে যাওয়ার।
কেউ কোনও অপ্রাপ্তির কারণে আত্মহত্যা করলে প্রশ্ন ওঠে, তাঁর বাসনার ধন তো জীবন তাঁকে পরবর্তীকালে এনে দিলেও দিতে পারত। সে সম্ভাবনার কথা ভেবেও কি আরও কিছুদিন জীবনের সঙ্গে থাকা যেত না!
কিন্তু সুস্মিতার মৃত্যু তো তা নয়। এ মৃত্যু বলছে, সুস্মিতা ভেবেছিলেন, জীবনকে তিনি ভালবাসলেও জীবন কোনও একটা সময়ে তাঁকে আর পাল্টা ভালবাসা দেবে না। বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনকে তিনি আকণ্ঠ পান করলেও জরা-ব্যাধিতে সে জীবন ক্রমশ যে রূপ নেবে, তাতে সে আর ভালবেসে তাঁর পাশটিতে চুপটি করে বসবে না। প্রেমিকের মতো হাতে-হাত রাখবে না। তা হলে কি মৃত্যুর প্রেমে পড়ে জীবনের সঙ্গে তাঁর প্রেমের বিচ্ছেদের কাহিনিই লিখে গেলেন সুস্মিতা?
জানি না!
কিন্তু যিনি স্বেচ্ছামরণের আগে ঘনিষ্ঠ এবং পরিচিতদের মোবাইলে বার্তা লিখে যান, ‘রবিবার বিকেলটা কোনও কাজ রাখিস না। দরকার লাগতে পারে।’ বা ‘তুমি কি রবিবার আমাদের বাড়ি আসছ?’ অথবা, ‘জয়, তুই রবিবার বিকেলে এক বার আসিস। সন্ধে করিস না। দিন থাকতে থাকতে আসিস’; তাঁর তো জীবনের সঙ্গে ভালবাসাবাসির দিন শেষ হয়ে মরণের জন্য প্রেম হয়েই গিয়েছে!
ঝটকা লাগে। তিন বছরের ব্যবধানে দু’টি মৃত্যু কোথাও একটা একই বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যায় এক জীবন-ছাত্রকে। আকুল হয়ে সে জানতে চায়, তা হলে কি বিষণ্ণ নৈকট্যের চেয়ে দূরে থাকার ভালবাসা অনেক বেশি কাম্য? কোনটা ভাল— মরবিড অ্যাটাচমেন্ট? নাকি লাভিং ডিটাচমেন্ট?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy