ফাইল চিত্র।
সর্দার উধম’ সিনেমাটা আন্তর্জালে দেখলাম কয়েক দিন আগে। সিনেমাটা দেখে ও এই নিয়ে লেখালিখি পড়তে পড়তে মাস দুয়েক আগে এক বন্ধুর তোলা অমৃতসরের কয়েকটা ছবির কথা আমার মনে পড়ছে বার বার। নবনির্মিত ইটের খিলানে ‘এগজ়িট’ লেখা একটা চকচকে স্টিলের নেমপ্লেটের ছবি। সঙ্গে আরও ছবিতে ছিল খিলান পেরিয়ে বেশ চওড়া ও স্পটলাইটের আলোয় চোখ-ধাঁধাঁনো পথ। পথের শেষে বাহারি গেট। মানুষ স্বচ্ছন্দে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারছেন সেখান দিয়ে, যেমন বেরোন মাল্টিপ্লেক্স থেকে সিনেমা দেখে। কোথা থেকে বেরোচ্ছেন তাঁরা? জালিয়ানওয়ালা বাগের ভিতর থেকে বাইরের রাস্তায়।
যে বন্ধু ছবি পাঠান ওই ‘এগজ়িট’ লেখা পথের, অগস্টের শেষে নবসাজে সজ্জিত জালিয়ানওয়ালা বাগ উদ্বোধিত হলে, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন এক দিন। বদলে যাওয়া প্রবেশপথ, স্মারকস্তম্ভের উপর গোলাপি আলোর বিচ্ছুরণ ইত্যাদি দেখে ও সাউন্ডবক্স থেকে ভেসে আসা লঘু সঙ্গীতের সুখী সুখী আমেজ গায়ে মেখে তিনি যখন বেরোতে যাবেন যে দিক দিয়ে ঢুকেছিলেন সেই পথে, তখন দ্বাররক্ষীরা তাঁকে থামিয়ে দেখিয়ে দিলেন ‘এগজ়িট’ কোন দিকে!
ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে যত বার ভাবি ওই নতুন প্রস্থানপথের কথা, শিউরে উঠি তত বার। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল যে সব নিরস্ত্র মানুষ প্রাণে বাঁচতে বেরোনোর পথ খুঁজছিলেন, সব পথ বন্ধ দেখে দেওয়াল টপকে ওই বধ্যভূমির ও পারে যেতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে অকালে ঝরে গিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে এ কী মর্মান্তিক ঠাট্টা! আসলে যাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ওখানে তৈরি হয়েছিল স্মরণ উদ্যান, তাঁরা তো আজ আর কেউ নন। তাঁদের পরিবারের মানুষজনেরও মতামতের কোনও গুরুত্ব নেই, কোনও প্রতিনিধিত্ব কখনওই ছিল না বিভিন্ন সময়ে গঠিত এই ‘ন্যাশনাল মেমোরিয়াল’-কে সাজানোর পরিকল্পনা কমিটিগুলোয়।
রাষ্ট্রের কাছে ১৯১৯-এর শহিদদের বড়সড় সংখ্যাটা জরুরি এবং জালিয়ানওয়ালা বাগ নামটার ওজন আজও বেশ ভারী হওয়ায়, রাজনীতির জগতে পরস্পরকে টেক্কা দিতে সেটা ব্যবহৃত হয় বেশি বই কম নয়। কে কাকে টেক্কা দেবে সেই দৌড়ে পুরনো বাগের নবরূপ প্রকাশ্যে আসার দু’সপ্তাহ আগেই, স্বাধীনতার ৭৪তম দিবসের প্রাক্কালে ‘জালিয়ানওয়ালা বাগ সেন্টিনারি মেমোরিয়াল পার্ক’-এর দ্বারোদ্ঘাটন হল অমৃতসরের অন্যত্র। নতুন পার্কের উদ্বোধন করতে গিয়ে পঞ্জাবের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, জালিয়ানওয়ালা বাগে ‘শহিদ’ হওয়া যে সব মানুষের নামপরিচয় আজও অজ্ঞাত, তাঁদেরই উদ্দেশে নিবেদিত হল সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ওই পার্ক।
১৯১৯-এর সরকারি তালিকায় ছিল ৩৭৯ জনের নাম। পরবর্তী কালে অমৃতসরের ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারের দফতরের নথিতে ৪৮৮ জনের নাম লিপিবদ্ধ হয়। শুনলাম নতুন পার্কে কালো পাথরে খোদাই করা হয়েছে ওই ৪৮৮টি নাম! পুরনো বাগের বাইরে ৩৭৯ জনের নাম সাদা পাথরে খোদাই করা ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ২০-২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পুরনো বাগের যে ভোলবদল বা ‘মেকওভার’ ঘটিয়েছে, তাতে অবশ্য নতুন ‘এগজ়িট’ ও ‘এন্ট্রান্স’ ছাড়াও আছে আরও নানা চমক। পুরোটাই— যাঁরা আসবেন সেই পর্যটক-কাম-ভোটার/ভাবী ভোটারের যাতে একটা মসৃণ অভিজ্ঞতা হয়, সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে। সম্ভবত কিছু দিনের মধ্যেই দেখা যাবে কোনও বেসরকারি সংস্থার হাতে চলে গেছে জালিয়ানওয়ালা বাগ রক্ষণাবেক্ষণের ভার, দামি টিকিট কেটে ঢুকতে হলেও আশ্চর্য হব না।
‘মেকওভার’ ঘটতে চলেছে সাবরমতী আশ্রমেরও। আশ্রমের চৌহদ্দির মধ্যে পড়া ৫৪ একর জমিতে ১২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বিশ্বমানের বা ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তার দরুন আমরা পেতে চলেছি নতুন জাদুঘর, অ্যাম্ফিথিয়েটার, ভিআইপি লাউঞ্জ, ফুড কোর্ট— সবই। এতে যদি সাবরমতী আশ্রমের শান্ত, অনাড়ম্বর সৌন্দর্য হারিয়ে যায়, ওই আশ্রমের প্রায় জন্মলগ্ন থেকে বসবাসকারী ২০০-২৫০ দলিত পরিবারকে ঘর ছাড়তে হয়, তবুও তো গাঁধীকে ঘটা করে শ্রদ্ধা জানানো হবে। ওই ‘আধুনিক’, ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ পর্যটক-আকর্ষণ কেন্দ্রে গাঁধীর থাকার তো দরকার নেই! তাঁর চিন্তাভাবনার থেকে আমাদের অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই এত আয়োজন! ঠিক যেমন জালিয়ানওয়ালা বাগের চৌহদ্দি থেকে সহস্র যোজন দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসের সব স্মৃতি। জালিয়ানওয়ালা বাগের ইতিহাস আমাদের রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ অস্বস্তির বলেই এত তোড়জোড় করে ভুলিয়ে দিতে চাওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বীভৎস রূপ, যা ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ৭৪ বছর পরেও অব্যাহত শুধু নয়, হিংস্রতায় এত বছরের রেকর্ডকে সব দিক দিয়ে ছাপিয়ে যাচ্ছে!
১৯২০-২১’এ পরাধীন দেশের মানুষ প্রাণ খুলে দান করেছিলেন, যাতে জালিয়ানওয়ালা বাগের জমি ইংরেজদের মালিকানায় চলে গিয়ে গণহত্যার সব চিহ্ন বিলুপ্ত না হয়ে যায়, যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় নির্মাণ করা যায় এক স্মরণ উদ্যান এবং তা হয়ে ওঠে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান-শিখ একতার প্রতীক। তার চল্লিশ বছর পর, স্বাধীনতা-দেশভাগ পেরিয়ে ১৯৬১-তে যখন সেখানে জাতীয় স্মারক-সৌধ তৈরি হল, সেটা কিন্তু ছিল সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি— তাতে আর স্বাধীন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে যৌথতা থাকল না। গত ৫০-৬০ বছরে জায়গাটার পুরোপুরি চরিত্র বদল ঘটে গেছে। ওই পার্ক এখন রাষ্ট্রের সম্পত্তি, যেখানে জালিয়ানওয়ালা বাগের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত মানুষদের জীবনের গল্প, পারিবারিক স্মৃতি, প্রান্তস্বর, স্থানীয় ইতিহাস— এ সবের কোনও স্থান নেই। জালিয়ানওয়ালা বাগে নানা ধর্ম ও জাতের মানুষের উপস্থিতির ইতিহাস তো কবেই মুছে গেছে। আছে শুধু এক জাতীয় স্মারক-সৌধের প্রাণহীন, গর্বিত অধিষ্ঠান।
এ বারের ভোলবদলের পর যখন পরিকল্পিত ভাবে ইতিহাসের বিকৃতি ও বাণিজ্যিকীকরণ ঘটার খবর পেলাম, তার কিছু দিনের মধ্যেই বিশ্বজোড়া আন্তর্জালে মুক্তি পেল সর্দার উধম ছবিটি। ছবিতে ‘রাম মহম্মদ সিংহ আজ়াদ’ নাম নিয়ে হিন্দু-মুসলমান-শিখ পরিচয়ের সমন্বয় ঘটাতে চাওয়া উধমকে দেখে ও তাঁর জীবনে ভগত সিংহের ভূমিকার স্বীকৃতি লক্ষ করে একটা প্রত্যাশা জাগছিল, কারণ এর আগে উধম সিংহকে নিয়ে তৈরি পুরনো হিন্দি ছবিগুলোতে ভগত সিংহ প্রায় অনুপস্থিত। অমৃতসরেও দেখেছি, উধম সিংহের দু’টি বিশাল মূর্তি থাকলেও ভগত সিংহ একেবারেই দৃশ্যমান নন। ভাবছিলাম, মধ্য এশিয়া-আফ্রিকা-আমেরিকা ও ইউরোপে দীর্ঘ দিন এক জন বাদামি শ্রমজীবী মানুষ ও গদর আন্দোলনের কর্মী হিসাবে কী ভাবে তৈরি হচ্ছিলেন উধম, তার হদিস পাওয়া যাবে ছবিতে। তা ছাড়া ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে ফ্রন্টে গিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল উধমের। ঔপনিবেশিক শাসন ও বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইটা যে বহুমাত্রিক, কেবল ১৩ এপ্রিল ১৯১৯-এর ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নয়, ছবিটা সে দিক দিয়ে গেলই না।
বিগ বাজেট সিনেমায় চলে এল জালিয়ানওয়ালা বাগ। মনে হচ্ছে, নবরূপা বাগ-এ যদি সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসের সব চিহ্ন মুছে গিয়ে থাকে, তবে কুছ পরোয়া নেহি। এই ছবিতেই দেখা যাবে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে গুলি চালনার সময় থেকে শুরু করে সারা রাত জুড়ে ওই মৃত্যুপুরীর ভয়াবহ সব দৃশ্য! একটা রাতের পুনরাবৃত্তিমূলক দৃশ্যায়ন ঢেকে দেবে সে সময়কার পঞ্জাবে বহু দিন ধরে চলা নানা সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন এবং একটা গোটা বিশ্বযুদ্ধের তীব্র অভিঘাত। এক দিকে স্মৃতি উদ্যানের স্মৃতিশূন্যতা ও অন্য দিকে সিনেমায় একটা আতঙ্কের রাতের ‘স্পেকট্যাকল’ নির্মাণ— এই দুইয়ের মাঝে হারিয়ে যেতেই থাকবে জালিয়ানওয়ালা বাগের অনেক ভুলে যাওয়া ও ভুলিয়ে দেওয়া দিক, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, যুদ্ধ ও হিংসার বিরুদ্ধে পর্যটক-দর্শকের মন ঘোরাতে যেগুলো তুলে ধরা যেত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy