সূচনা: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেওয়ার পর নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস, ঢাকা, ৮ অগস্ট। ছবি: রয়টার্স।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান এবং তার পর-পরই দ্রুত তৈরি হওয়া সার্বিক অরাজকতা সতেরো কোটি মানুষের এই দেশটিকে নিঃসন্দেহে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে। কোনও কেতাবি ঢঙে পৃথিবীর কোথাও অদ্যাবধি অভ্যুত্থান হয়নি, হয় না। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সমাজের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ কতটা নিখাদ ও প্রশ্নহীন আনুগত্যের একান্ত দাবিদার শাসকের অপরিণামদর্শিতার কারণে, আর কতটা আঞ্চলিক বা বহিঃশক্তিগুলির রাজনৈতিক এবং অন্যতর কূটকৌশলের জন্য, তার উত্তর পেতে সময় লাগবে। বস্তুত, দেশের নাটকীয় পালাবদলের আকস্মিকতা এবং সতত পরিবর্তনশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক চালচিত্রের প্রেক্ষাপটে এর বিচার করতে যাওয়া হয়তো এক ধরনের হঠকারিতাই। কিন্তু, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এবং আর্থ-রাজনৈতিক কারণে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের দেশটিতে এই পর্বান্তর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
সদ্য অভিষিক্ত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তুলনামূলক বিচারে পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের বহু দেশের কান্ডারিদের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। সেই হিসাবে তাঁর সাময়িক শাসনের কাছে ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা অনেক। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ জনঘনত্বের এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিপন্ন, এমন অভিযোগ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় বেশ কিছু দেশের তরফেই ইদানীং কালে শোনা গেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের আগেই তার সঙ্গে যে ভাবে আমেরিকা সুসম্পর্ক গড়তে প্রত্যাশী ছিল, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
অন্য দিকে, এই অঞ্চলে দ্রুত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী চিন বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির উপরে কড়া নজর রেখে চলেছে। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত অবতারণা জরুরি। নয়াদিল্লি-ঘনিষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে ঢাকার সঙ্গে চিনের বাড়তে থাকা ঘনিষ্ঠতা ছিল সাউথ ব্লকের কর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলার বিষয়। দু’বছর আগে উদ্বোধন হওয়া ছ’কিলোমিটার দীর্ঘ এবং একত্রিশ হাজার কোটি বাংলাদেশি টাকার বিনিময়ে তৈরি নজরকাড়া পদ্মা সেতুটি চিনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় সেই দেশেরই একটি সংস্থা দ্বারা নির্মিত। বিগত পাঁচ বছরে চিন বাংলাদেশকে অন্তত তিন বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের সমতুল্য অর্থ ঋণ বাবদ দিয়েছে। সোনাদিয়া দ্বীপের কাছে চিনের সাহায্যে এক গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের বিষয়েও দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া তাৎপর্যপূর্ণ। এ ছাড়াও চিনের আর্থিক সাহায্যে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি প্রকল্প বর্তমানে নির্মীয়মাণ। কাজেই বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহে চিনের তীক্ষ্ণ নজর স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চিন সফরকালে বেজিং শুধুমাত্র সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ের জন্য আওয়ামী দলকে অভিনন্দনই জানায়নি, চিনা বিবৃতিতে বাংলাদেশকে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখার বিষয়ে অঙ্গীকারও করা হয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব পরিস্থিতি বুঝে স্বাধীন ভাবে আর্থিক বিকাশে ঢাকার উদ্যোগও চিনে প্রশংসিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও সফররত প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছিল যে, তাঁর এই সর্বশেষ সফরে তিনি প্রত্যাশিত গুরুত্ব বেজিংয়ে পাননি। প্রসঙ্গত, তাঁর চিন সফরের প্রাক্কালে তখনকার বিরোধী এবং পর্বান্তরের পরবর্তী পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) নেতৃত্বের একাংশ বেজিংয়ে সে-দেশের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অশান্তি ও নৈরাজ্য চিনকে সাময়িক উদ্বেগে রাখলেও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক অঙ্কে এই দেশটি বেজিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ তাস হিসাবে থাকবেই। চিনা উদ্যোগের বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চিন, ভারত, মায়ানমার)-এর অন্যতম শরিক অবশ্যই ঢাকা।
বাণিজ্যিক ও সামরিক ক্ষেত্রেও চিন ও বাংলাদেশ বিগত পঁচিশ বছরে পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। তিন বছর আগে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার মূল্যমানের। এর মধ্যে বাংলাদেশে চিনের রফতানিকৃত পণ্যের পরিমাপই ছিল সিংহভাগ। সদ্য প্রাক্তন সরকার সম্পর্কে অতিরিক্ত নয়াদিল্লি-ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠলেও আর্থিক সাহায্য এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো নির্মাণে চিন মোটেই তেমন পিছিয়ে ছিল না। তবে, বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ (বিআরআই)-এর মাধ্যমে বেজিং ঢাকাকে নিজস্ব প্রভাবের বলয়ে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করতে চাইলেও ভারত এ-যাবৎ নানা কারণে অনেকটাই বাড়তি সুবিধার জায়গায় ছিল বইকি। কয়েকটি বিষয় নজরটানা প্রাসঙ্গিক।
প্রথমেই বলতে হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকা। দুই, চিনের তুলনায় ভারত ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য। তিন, ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ঢাকার নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যের সুযোগ (এই বিষয়ে বিবিআইএন উল্লেখ্য)। চার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা। পাঁচ, দুই দেশের স্থলসীমা চুক্তির মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময়। ছয়, দ্বিপাক্ষিক স্তরে উন্নত মানের সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন। সাত, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার মূল্যমানের হওয়া। এ ছাড়াও ছিল দুই দেশের উপকূলে পরস্পরের জাহাজ চলাচলের বিষয়ে সমঝোতা, উত্তর-পূর্ব ভারতের সাপেক্ষে বাংলাদেশে একদা আশ্রিত জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ঢাকার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ বা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের সংক্ষিপ্ততর সড়ক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগের ব্যবস্থার মতো নয়াদিল্লির পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত।
এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক প্রাপ্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অপ্রাপ্তির অভিযোগও কম ছিল না। নয়াদিল্লি ও ঢাকার এত নিবিড় সম্পর্ক সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা অন্তত ৫৪টি নদীর জল বণ্টনের বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত, কিছু ক্ষেত্রে প্রায় অনালোচিত। বাংলাদেশের তরফে ভারতের সাপেক্ষে আক্ষেপ, অনুযোগ বা অভিযোগের এই তালিকা এবং সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে দিল্লির বিশেষ ঘনিষ্ঠতা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভারত-বিদ্বেষকে উস্কানি দিয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কে শুধু স্মৃতির সরণি বেয়ে অতীতের কৃতকর্মের প্রতিদান সন্ধান নিরর্থক। রাজনীতিতে আবেগ স্বাভাবিক। সম্পর্কেও। কিন্তু সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে একটি দেশের সমাজ ও অর্থনীতির বাস্তবতা সম্যক অনুধাবন করে, আঞ্চলিক বা ভূমণ্ডলীয় ভূ-রাজনৈতিক
সমীকরণকে স্মরণে রেখে ভবিষ্যতের বিদেশনীতির রূপরেখা নির্মাণে নিজস্ব পছন্দের অগ্রাধিকার স্থির করাই বিধেয়।
কোনও দেশের সমাজ বা রাজনীতি একমাত্রিক নয়। উভয়ই বহুগামী এবং বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে অরাজকতা অনাসৃষ্টির অচিরেই অবসান ঘটানোয় নিশ্চিত উদ্যোগী হবে। এই সময় প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের রাজনীতির নয়। প্রয়োজন পুনরুদ্ধারের, নবনির্মাণের রাজনীতির। এই পুনরুদ্ধার ও নবনির্মাণ সংবিধানের, আইনের। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির এবং পরমতসহিষ্ণুতার। না হলে আবেগের নৌকা অল্প সময়েই তলিয়ে যায়।
বাংলাদেশে সঙ্কট হলে এই উপমহাদেশও সঙ্কটাপন্ন হবে। সে দেশের মাটিতে বর্তমানে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার তুল্যমূল্য বিচারের সময় এটা নয়। শাসনের ক্রমহ্রাসমাণ বৈধতার নিরিখে সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ভেদরেখাটি মুছতে বসেছিল কি না, অনেকেই খেয়াল করেননি। তবে এই মৃত্যু উপত্যকা কোনও ভাবেই বাংলাদেশের হতে পারে না। অবিলম্বে অনিশ্চয়তার অন্ধকার কাটিয়ে দেশবাসী নতুন ভোরের সন্ধান করবে, সেই বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই প্রত্যয়ী। নয়াদিল্লিও উদ্যোগী হলে সেই নতুন সকালে ঢাকার হাত ধরতে সক্ষম। শপথের পরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির যথাযথ পর্যালোচনার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন তরী বাওয়ার এই সুযোগ। দ্রোহকালে যে কোনও সঙ্কটই কিন্তু নতুন সুযোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy