এক বৃদ্ধার তিন দিনের পচা লাশ বার হল দরজা ভেঙে। এক প্রৌঢ়া মশা তাড়ানোর ধূপের আগুনে জ্বললেন সারা রাত। এমন ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। সেগুলির প্রেক্ষিত, কারণ আলাদা। কেবল দু’টি বিষয় এক। প্রায় প্রত্যেকেই জীবনের মধ্যম পর্যায় পেরিয়ে গিয়েছিলেন, একা ছিলেন। একা থাকা মানুষের এই ধরনের পরিণতিকে আমরা একটু দীর্ঘশ্বাস সহযোগে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করেছি।
‘একা’ এবং ‘একাকিত্ব’ এক নয়। একাকিত্ব সারা বিশ্বেই মহামারি। ‘কেজো’ দুনিয়া বয়সের খেলায় ‘অকেজো’ হয়ে যাওয়া মানুষকে ‘আউট’ করে দেয়। সেই লাল কার্ড দেখা প্রবীণের একাকিত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। এই নিবন্ধে আলোচ্য মানুষেরা শুধু মানসিক দিক নয়, সমস্ত দিক দিয়েই একা।
‘ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস’ বলছে, ২০৩১-এর মধ্যে, জনগণের ১৩%-এর বেশি অংশ জুড়ে ভারতে প্রায় কুড়ি কোটি নাগরিকের বয়স হবে ষাটের বেশি। এই বিপুল সংখ্যক প্রবীণের বিরাট অংশ হবেন সঙ্গীহীন, একেবারে একা। দেশ কি এই একলাদের নিরাপত্তা দিতে এবং জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত হচ্ছে? মহিলাদের ছবি আরও করুণ। এ যুগেও গ্রামের মাত্র ১০%, শহরের ১১% প্রবীণা স্বনির্ভর। বাকি মহিলাদের, প্রবীণ পুরুষদের অবস্থাও আশাপ্রদ নয়। একে আয় নেই, তার পর ক্রমশ শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে অক্ষম হয়ে পড়েন। খাবেন কী? থাকবেন কোথায়? চিকিৎসা হবে কী ভাবে? সামর্থ্য থাকলেও পাশে থাকবে কে?
বিদেশে নাকি মানুষ ‘টাইম ব্যাঙ্ক’-এ বার্ধক্যের জন্য ‘সহায়তা’ জমাচ্ছেন। সাফল্য তেমন আসেনি। এ দেশে একের পর এক দরজা ভাঙা পড়ছে, মৃতদেহ বেরিয়ে আসছে। কেউ হতাশায় ছাদ থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন। ডুকরে মরছেন কোনও ক্রমে চলা বৃদ্ধাবাসে। কারও ঠাঁই আকাশের নীচে। সরকারি প্রকল্পগুলির আয়োজন প্রয়োজনের তুলনায় আণুবীক্ষণিক। কিছু বৃদ্ধাশ্রম, কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করছে। যানবাহনের ভাড়া, কর খানিক কম দিতে হয়। এই টুকটাক বন্দোবস্ত দিয়ে কি কুড়ি কোটি অশক্ত মানুষকে মানুষের মতো বাঁচিয়ে রাখা যায়?
দেশে অসহায়, একা প্রবীণ বলতে কাদের কথা প্রথমেই মাথায় আসে? যাঁদের আইনসিদ্ধ জীবনসঙ্গী গত হয়েছেন, দেখার কেউ নেই, সন্তানহীন, সন্তানের উদাসীনতার শিকার বা সন্তান কর্তৃক পরিত্যক্ত। প্রায়ই সেই দুর্ভাগা মা-বাবার কাহিনি জানতে পারি, ছেলে বা মেয়ে যাঁদের ফেলে বাইরে গিয়েছে চাকরি করতে। স্টেশনে তাঁদের নামিয়ে দিয়ে চিরতরে ভ্যানিশ হয়েছে। বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে। এদের অপরাধের কোনও সীমা নেই। আদালতও বহু ক্ষেত্রে এদের শাসিয়েছে কড়া ভাষায়।
কয়েনের উল্টো পিঠে প্রশ্ন থাকে— প্রবীণের একলা জীবন কি কেবলই বাধ্যবাধকতা? সেখানে কি ‘স্বেচ্ছা’ শব্দটি নেই? সমস্ত সন্তান ‘খলনায়ক’ হয় না। কিন্তু বয়সের দু’টি স্তর, মনস্তত্ত্বের দু’টি মাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই দুই প্রজন্মকে সহাবস্থানের অনুমতি দেয় না। অনেক মা বা বাবা বয়সকালে স্বেচ্ছায় একা, এমনকি বৃদ্ধাবাসেও থাকার সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের সমাজ সন্তানকে পিতামাতার ‘ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ক্রেডিট কার্ড’ হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত। এর সবটুকুই অযৌক্তিক নয়। কিন্তু অতীতচারিতায় ইচ্ছুক মানুষ যদি বর্তমানের জীবনযোদ্ধাদের সঙ্গে মানাতে না পারেন, সেটা কোনও পক্ষের দোষ না-ও হতে পারে।
অনেকে সারা জীবন একা থাকতে চান। অনেকে হয়তো জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে উপলব্ধি করেন, একা থেকে জীবনকে অধিকতর উপভোগ করতে পারবেন। আমাদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজ একা মানুষকে ‘বেচারা’ বানাতে আগ্রহী, কিন্তু তাঁর একা থাকার সিদ্ধান্তকে ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘অধিকার’ মানতে প্রস্তুত নয়। যে পরিবার তাঁর স্বাতন্ত্র্যকে তছনছ করছে, তার ‘ছাতার তলা’য় থাকার যান্ত্রিক অভ্যাস তাঁকে কষ্টকর কিন্তু স্বাভিমান অলঙ্কৃত একা থাকার ‘মুক্তি’কে উপলব্ধি করতেই শেখায়নি। কিন্তু ‘স্বেচ্ছায় একা’ মানুষেরও বেঁচে থাকতে নিরাপত্তা, চিকিৎসা, যাপনের ন্যূনতম চাহিদাগুলি মেটানো চাই। নইলে বাধ্য একা, স্বেচ্ছায় একা: কেউই বাঁচতে, এমনকি সম্মানজনক ভাবে মরতে পারবেন না।
একা থাকার অধিকারকে ‘স্বীকৃতি’ দেওয়ার দাবি তোলার সময় এসেছে। কেন প্রবীণ নাগরিককে বিনা চিকিৎসায়, বিনা নিরাপত্তায় অসহায় ভাবে বাঁচতে এবং মরতে হবে? সন্তান নেই বলে, স্বেচ্ছায় একা থাকেন বলে বা সন্তান দেখে না বলে এক স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিককে কেন পচা লাশ হয়ে বন্ধ দরজার ও-পারে পড়ে থাকতে হবে? রাষ্ট্র প্রবীণ নাগরিকের প্রতি কর্তব্যের পরিধি অধিকতর প্রসারিত করলে তাঁরা কিন্তু বেশি ভাল থাকেন। সুইৎজ়ারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস— অনেক দেশই তা প্রমাণ করেছে।
একা থাকা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকের অধিকার। প্রত্যেক পরিবারের মতো প্রত্যেক একার প্রতিও রাষ্ট্রের দায় আছে। রাষ্ট্র তা স্বীকার করুক। সদিচ্ছা থাকলে সাফল্য দূরে থাকে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy