Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
সমাজতন্ত্র মানেই রাষ্ট্রের হাতে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা নয়
Supreme Court Of India

ব্যক্তিগত বনাম সর্বজনীন

ভারত এমনিতেই ব্যক্তিপূজার দেশ। কাজেই, বিচারপতি চন্দ্রচূড় তাঁর রায়ে কৃষ্ণ আয়ার ডকট্রিনকে নাকচ করায় আইনের দুনিয়ায় অনেকেই সম্ভবত তাঁর উপরে ক্ষুণ্ণ হয়েছেন।

অগ্নিদীপ্ত তরফদার
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:৩১
Share: Save:

গত মাসের গোড়ার দিকে এক মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি নয় সদস্যের বেঞ্চ জানাল যে, অধিগ্রহণ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যে কোনও ‘প্রাইভেট প্রপার্টি’ বা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে ‘পাবলিক গুড’ বা সর্বজনীন সম্পদ হিসাবে গণ্য করতে পারে না। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের লেখা এই রায়টি সাড়ে চার দশক পুরনো একটি রায়কে নাকচ করল— রাষ্ট্রের শক্তির ভারসাম্য পুনরায় স্থির করল, এবং সংবিধানস্বীকৃত ‘স্যোশালিজ়ম’ বা সমাজতন্ত্র বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তুলল।

নয় বিচারপতির বেঞ্চের ৭-২ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়টি সংবিধানের ৩৯(খ) ধারার অন্তর্গত ‘সমাজের বাহ্যিক সম্পদ’ শব্দবন্ধটিকে ব্যাখ্যা করল— আগের ব্যাখ্যার চেয়ে সঙ্কীর্ণতর অর্থে— এবং শেষ পর্যন্ত জানাল যে, শুধুমাত্র প্রয়োজন মেটাতে পারে বলেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সমাজের ‘বাহ্যিক সম্পদ’ হিসাবে গণ্য করা চলে না। অতীতে এই শব্দবন্ধটিকে যে ভাবে বিস্তীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, এবং যার ফলে স্থাবর বা অস্থাবর যে কোনও ব্যক্তিগত সম্পদই এই ধারায় সর্বজনীন সম্পদ হিসাবে গণ্য হত, বিচারপতি চন্দ্রচূড় তার সমালোচনা করেন। কোনও সম্পদকে সত্যিই সমাজের সর্বজনীন সম্পদ হিসাবে গণ্য করা যাবে কি না, তা প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে বিচার করে দেখার জন্য চার ধাপবিশিষ্ট একটি পরীক্ষার কথা প্রস্তাব করেন তিনি। পরীক্ষার মাপকাঠিগুলি হল— সেই সম্পদটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তার সহজলভ্যতার অভাব, জনজীবনে সেই সম্পদটির গুরুত্ব ও অভিঘাত, এবং সম্পদটি অল্প কয়েক জনের হাতে সীমাবদ্ধ থাকায় জনজীবনে তার কী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অর্থাৎ, শীর্ষ আদালতের বেঞ্চের অধিকাংশ সদস্যের মতে, কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সর্বজনীন সম্পদ হিসাবে মানা যেতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পদ মানেই তা সর্বজনীন, এমন কোনও পূর্বানুমান স্বীকার করা চলবে না; এবং বৃহত্তর সার্বিক ব্যবহারের জন্য সম্পদটিকে অধিগ্রহণ করার আগে আদালতের তৈরি করে দেওয়া শর্ত পূরণ করতে হবে।

যে দু’জন বিচারপতি পৃথক রায় রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে বিচারপতি নাগরত্ন বলেছেন, পার্সোনাল অ্যাফেক্ট অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্মৃতি বা অন্য কোনও আবেগজড়িত সম্পদ না হলে তাকে সর্বজনীন সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। বিচারপতি ধুলিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের সঙ্গে আংশিক মতানৈক্য প্রকাশ করে আদালতের পূর্বতন অবস্থানের পক্ষে— অর্থাৎ যে কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তিই অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হলে রাষ্ট্র তাকে সর্বজনীন হিসাবে গ্রাহ্য করতে পারে— মত দিয়েছেন।

উপরেই উল্লেখ করেছি যে, এই রায়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড় সাড়ে চার দশক পুরনো একটি রায়কে নাকচ করেছেন। যে কোনও সম্পত্তিকেই রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করতে পারে, এই মর্মে সেই রায়টি দিয়েছিলেন বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার, ১৯৭৮ সালের রঙ্গনাথ রেড্ডি মামলায়। বস্তুত, পরবর্তী কালে সুপ্রিম কোর্ট একাধিক রায়ে এই রায়ের ইতিবাচক উল্লেখ করেছে। এই অবস্থানটি ‘কৃষ্ণ আয়ার ডকট্রিন’ নামে পরিচিত।

আইনব্যবসায় যুক্ত অনেকের কাছেই বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার বিশেষ সম্মানের। শিক্ষা এবং ভাষার উপরে তাঁর দখলের প্রতিফলন ঘটত তাঁর লিখিত রায়ে, এবং বহু ক্ষেত্রেই আইনি খুঁটিনাটির গণ্ডি ছাড়িয়ে তা উত্তীর্ণ হত উচ্চতর স্তরে। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা চিরকালই ভয়ঙ্কর। বিচারপতি আয়ারের সহানুভূতি ছিল সাধারণ মানুষের প্রতি, ফলে বহু ক্ষেত্রে তিনি আইনের তৈলাধার পাত্রের বিশ্লেষণকে পাশ কাটিয়েই পৌঁছে যেতেন তাঁর বিচারে। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, পাশাপাশি ছিলেন বাস্তববাদী— তিনি ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিকে যে ভাবে দেখেছেন, তাতে তাঁর এই দার্শনিক অবস্থানের ছাপ স্পষ্ট। সব মিলিয়ে, তাঁর সমসময়ে তিনি ছিলেন ভারতীয় বিচারব্যবস্থার এক অতি উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।

ভারত এমনিতেই ব্যক্তিপূজার দেশ। কাজেই, বিচারপতি চন্দ্রচূড় তাঁর রায়ে কৃষ্ণ আয়ার ডকট্রিনকে নাকচ করায় আইনের দুনিয়ায় অনেকেই সম্ভবত তাঁর উপরে ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। কিন্তু, বিচারপতি চন্দ্রচূড় তাঁর রায়ে আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছেন। তিনি বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে, রঙ্গনাথ রেড্ডি মামলার রায় দেওয়ার সময় নিজের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক আদর্শকে সেই বিচারের উপরে আরোপ করেছিলেন। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের ভাষায়, “কৃষ্ণ আয়ার ডকট্রিন ভারতীয় সংবিধানের প্রশস্ত ও নমনীয় চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেনি।” বিচারপতি নাগরত্ন ও বিচারপতি ধুলিয়া তাঁদের পৃথক রায়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের এই মন্তব্যটির সমালোচনা করেছেন। বিচারপতি নাগরত্ন মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, যখন বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার তাঁর রায়টি দিয়েছিলেন, তখন ভারতের আর্থ-সামাজিক আবহাওয়ায় সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রভাব ছিল অতি প্রকট। কাজেই, বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ারের মাপের কোনও বিচারকের সমালোচনা করার সময় প্রাসঙ্গিক পরিপ্রেক্ষিতের উল্লেখ না করা প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের অনুচিত হয়েছে। বিচারপতি ধুলিয়ার বিবেচনায়, সংবিধানের মুখবন্ধে যখন ভারতকে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তখন বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার সংবিধানকে সে ভাবে ব্যাখ্যা করে আদৌ নিজের এক্তিয়ার ভঙ্গ করেননি।

যাঁরা ভারতীয় বিচারব্যবস্থা নিয়ে চর্চা করেন, তাঁদের কাছে বিচারপতিদের মতানৈক্য থেকে বেরিয়ে আসা অবস্থানগুলি অতি আগ্রহজনক। কিন্তু, বৃহত্তর জনসমাজের কাছেও এই রায়ের তাৎপর্য রয়েছে। এই রায়কে এ ভাবেও পাঠ করা যায় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় যে-হেতু স্বীকার করে নিয়েছে যে, কিছু কিছু ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রের এক্তিয়ারের বাইরে, অতএব আদালত সরকারের জনস্বার্থে অধিগ্রহণ করার ক্ষমতার একটি সীমা নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। এর ফলে ব্যক্তিস্বার্থকে সর্বজনীন স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়া হচ্ছে, এবং তাতে সংবিধানে বর্ণিত সমাজতান্ত্রিক আদর্শ লঘু হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে ভারতে সাঙাততন্ত্রের যে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যে ভাবে বারে বারেই কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার অভিযোগ উঠছে, তাতে আদালতের রায়ের এই ব্যাখ্যাটি যথাযথ বলেই মনে হতে পারে।

তবে, এই সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তেমন কিছু বলছে না। এই রায়ে কিছু প্রাক্‌শর্ত নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে মাত্র— ভবিষ্যতে কোনও মামলায় সেই শর্তগুলি যথাযথ ভাবে পরীক্ষিত হলে এক শ্রেণির ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা করা যাবে। রাষ্ট্রকে যে কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তিই অধিগ্রহণের ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়ার পরিবর্তে এই রায় নাগরিককে একটি অধিকার দিচ্ছে— যে জনস্বার্থের কথা বলে রাষ্ট্র কোনও সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে চায়, অধিগ্রহণের আগে রাষ্ট্রকে নাগরিকের কাছে তার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থাৎ, কোনও ব্যক্তির থেকে তাঁর সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নেওয়ার আগে রাষ্ট্রকে উত্তর দিতে দায়বদ্ধ হতে হবে। সরকারকে উত্তর দিতে বাধ্য করার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কোনও বিরোধ নেই। বস্তুত, এই দায়বদ্ধতা সেই উচ্চ আদর্শের অপরিহার্য শর্ত। বাস্তবমুখী সমাজতন্ত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রশ্নাতীত ক্ষমতাকে এক করলে যেখানে পৌঁছব, সংবিধান তেমন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা বলেনি।

সুপ্রিম কোর্ট কখনও কোনও একটি নির্দিষ্ট দার্শনিক অবস্থানের পক্ষপাতী হয়নি। বিবিধ বিচারপতি, বিবিধ বেঞ্চ এবং সবার উপরে সময় নিশ্চিত করেছে যে, দার্শনিক অবস্থানের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট সর্বদাই বহুবাদী। বিশেষত, আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালত সর্বদাই সরকারের অভীষ্ট পথের অনুসারী। নেহরু-ইন্দিরা পর্বে যখন সমাজতন্ত্রই রাজনীতির মূলধারা ছিল, তখন আদালত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের অবস্থানের পক্ষেই থেকেছে। ’৯১-পরবর্তী নব্য উদারপন্থী যুগে আদালতও অনেক বেশি বাজারমুখী হয়েছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে আদালতের অর্থনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক ক্ষীণ; বরং শাসনক্ষমতায় আসীন সরকারের পক্ষে জনমত কতটা জোরালো, এবং তাদের আর্থিক নীতির অভিমুখটি কী, এই জাতীয় বিবেচনার সম্পর্ক গভীরতর। এ কথা ঠিক যে, প্রতি পর্বেই এমন কিছু বিচারপতি ছিলেন যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতেন; এমন কিছু রায়ও ঘোষিত হয়েছে, যা আমাদের প্রত্যাশার পরিপন্থী— কিন্তু, সুপ্রিম কোর্ট সর্বদাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের বিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করবে, এমন প্রত্যাশার মধ্যে বাস্তববোধের অভাব রয়েছে।

আইনবিদ্যা বিভাগ, ও পি জিন্দল ইউনিভার্সিটি

অন্য বিষয়গুলি:

Wealth Socialism Supreme Court of India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy