Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
coronavirus

অধিকার বনাম সামাজিক দায়িত্ব

হিংসা, দ্বেষ সরিয়ে রেখে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মতো গুণগুলি রপ্ত করতে পারব না? তা যদি না পারি, তবে আর কবে আমরা মানুষ হব?

আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২১ ০৫:৪৬
Share: Save:

এক গৃহবন্দি বিকেলে গুগল নিউজ় ফিডে খবরটা এল। রেলের কর্মীদের জন্য সংরক্ষিত কামরায় ওঠার কারণে এক স্বাস্থ্যকর্মীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে তোলা হল আদালতে। খবরটা বিস্তারিত পড়লাম— নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের এক নার্স সকাল ন’টা নাগাদ বারুইপুর থেকে শিয়ালদহগামী ট্রেনে ওঠেন। ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় থাকায়, ভুল করে উঠে পড়েন রেলকর্মীদের জন্য সংরক্ষিত কামরায়। এর পরই কর্তব্যরত আরপিএফ জওয়ান তাঁকে হেনস্থা করেন। এমনকি আদালতেও তোলা হয় বলে দাবি করেন সেই নার্স।

কিছু দিন আগেই রেলওয়ে কর্মচারীরা ইউনিয়নের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য বরাদ্দ ট্রেনে ডাক্তার, নার্স বা ব্যাঙ্ককর্মীদের মতো কেউ যাতে না ওঠেন সেই বন্দোবস্ত করতে হবে। নয়তো তাঁরা দলবদ্ধ ভাবে কাজে অনুপস্থিত থাকবেন এবং দায় হবে কর্তৃপক্ষের। কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন যে, ব্যাঙ্ক থেকে ব্যাঙ্ক কর্মচারী স্বল্প সুদে ঋণ পান, সেটি তাঁর বিশেষ অধিকার। তেমনই রেল কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ ট্রেন আসলে ওই বিভাগের কর্মীদের বিশেষ অধিকার!

যে কোনও অজুহাতে এখন হিংসার পথই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। রাজনীতি থেকে সমাজ, কোথাও আর কোনও পথ যেন অবশিষ্ট নেই। রেলকর্মীরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ করেছেন— রেল কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট বগিতে এক জন স্বাস্থ্যকর্মী উঠবেন কেন?

‘সঙ্ঘ’ শব্দটির একটি অর্থ সমাজ। ডাক্তার, নার্স-সহ অন্যান্য সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যাঙ্ককর্মী সবাই সেই সমাজের অংশ। সমাজ চলে সহযোগিতার নীতিতে। সেই সহযোগিতার সম্পর্ক সরিয়ে রেখে সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক কেবল প্রতিযোগিতা আর দ্বন্দ্বের হয়ে উঠলে সমাজের সুসামঞ্জস্য নষ্ট হতে বাধ্য। এক জন স্বাস্থ্যকর্মী এই মুহূর্তে পিপিই পরে প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে এতটা সময় ধরে কাজ করছেন। তার পরে ভিড়ের মধ্যে তিনি যদি ঠিক কামরা বেছে উঠতে না পারেন, সেইটুকুও কি আমরা ক্ষমা করতে পারি না? আর তিনি তো কর্মস্থলের দিকে রওনা দেওয়ার সময় ট্রেন ধরতে গিয়ে ভুল কামরা নির্বাচন করে ফেলেছেন। সেও তো করেছেন ঠিক সময় পৌঁছে রোগীর সেবারই জন্য!

পৃথিবীময় অতিমারি সঙ্কট চলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে অধিকার বুঝে নেওয়ার যথাযথ সময় কি এখন? সাধারণ মানুষের স্বার্থেই যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই ব্যাঙ্ককর্মীরা দফতরে যাচ্ছেন। কারণ, অর্থব্যবস্থা থেমে গেলে গোটা ব্যবস্থাটা থেমে যাবে। আর এক জন নার্স তো সরাসরি স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। সে ক্ষেত্রে এই সঙ্কটকালে এই বিশেষ সুবিধাটুকু কি তাঁর প্রাপ্য হতে পারে না?

নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন অন্য সব কিছুর মতোই স্বাস্থ্যকে ‘সেবা’ থেকে পণ্যের দিকে নিয়ে চলে গিয়েছে। তবুও, সদ্য পাশ করা তরুণ-তরুণীরা এখনও হিপোক্রেটিসের নামে শপথবাক্য পড়ছেন। সরকারি চাকরি নিয়ে গ্রামীণ হাসপাতালেও যাচ্ছেন। আর সমস্যায় পড়ছেন। গ্রামীণ হাসপাতালের সীমাবদ্ধ পরিকাঠামোর মধ্যে অনেক সময় মুমূর্ষু রোগী আসামাত্র, পরীক্ষা করার সময়ই মারা যান। দেখা যায়, তা রোগীর পরিবারের কাছে ডাক্তারের অপদার্থতা বলে গণ্য হয়েছে। আবার, সঙ্কটাপন্ন রোগীকে পরীক্ষা করে কোনও ওষুধ প্রয়োগ করলে এবং তিনি মারা গেলেও বিপদ থাকে। রোগীর পরিবারের তরফে তাকে ভুল চিকিৎসা বলে প্রায়শই ধরে নেওয়া হয়। এই সঙ্কটের কালে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি এই রকম অবুঝ ব্যবহার কতটা ন্যায্য? এর পরেও কি আমরা আশা করতে পারি যে, আগামী প্রজন্ম স্বেচ্ছায় এ রকম সেবামূলক পেশায় যুক্ত হতে চাইবে?

শুরুটা আগেই হয়েছিল। স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনকে বাড়িভাড়া না দেওয়া, ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দিতে বলা, এমনকি সরকারি আধিকারিককে পাড়ায় ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনাও সামনে এসেছে। এখন প্রতিষেধকের লাইনে দাঁড়িয়ে গুন্ডামি, মারামারি চলছে। অতিমারির কালে ডাক্তাররা তো তাঁদের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু আমরা এখনও সেই অমোঘ সত্যিটাকে উপলব্ধি করতে পেরেছি কি? অসম এবং কর্নাটকে করোনা রোগীর মৃত্যুতে ডাক্তারদের উপরে যে অত্যাচার হয়েছে, এ রাজ্যে হুগলির পাণ্ডুয়াতে যে নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে, সে সব দেখে তো মনে হয় না। হয়তো দোষীরা ধরা পড়বে, হয়তো শাস্তিও পাবে। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হল, এই সঙ্কটকালে এত মৃত্যু দেখেও আমরা কি অধিকারের জায়গাটিকে একটু সঙ্কুচিত করে কর্তব্যের জায়গাটিকে একটু বাড়িয়ে দেব না? হিংসা, দ্বেষ সরিয়ে রেখে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মতো গুণগুলি রপ্ত করতে পারব না? তা যদি না পারি, তবে আর কবে আমরা মানুষ হব?

অন্য বিষয়গুলি:

coronavirus COVID19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy