Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
school

স্কুলের গণ্ডি আরও ছড়াতে হবে

স্কুল-ক্লাসরুম-সিলেবাস-পরীক্ষা নিয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা যুগ-যুগ ধরে প্রচলিত ছিল, অতিমারি আমাদের অনেক ভাবেই তার বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে।

সীমান্ত গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২২ ০৫:০০
Share: Save:

কোনও স্কুলের কি ডানা থাকে? সীমানা-প্রাচীর পেরিয়ে স্কুল কি উড়ে বেড়াতে পারে এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় বা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে? অতিমারির কারণে সুন্দরবনে স্কুলছুট বাচ্চার সংখ্যা রাজ্যের অঞ্চলের থেকে অনেক বেশি। সেই বিপুল পরিমাণ বাচ্চার কাছে পৌঁছনোর লক্ষ্যে সেখানকার এক হেডমাস্টারমশাই সম্প্রতি একটি অদ্ভুত ‘ভ্রাম্যমাণ শিক্ষাযান’ তৈরি করেছেন। একটা টোটোকে কম্পিউটার, প্রোজেক্টর, ইন্টারনেট কানেকশনে সাজিয়ে নাম দিয়েছেন ‘উইংস অব স্কুল’। স্বল্প বেতনে স্থানীয় দু’জন শিক্ষিত যুবককে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন বিকেলে সেই চলমান স্কুল গিয়ে দাঁড়াচ্ছে বিভিন্ন গ্রামের বটতলা বা চণ্ডীমণ্ডপে। এক সময় গ্রামে-গঞ্জে যেমন মাঠে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হত, অনেকটা সেই কায়দায় কচিকাঁচাদের জড়ো করে ভিডিয়ো দেখিয়ে পঠনপাঠন চলছে। এ ভাবেই ডানা মেলে উড়তে শিখছে বিদ্যালয়— ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার বীজ।

আমাদের রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি ব্যতিক্রমী সংগঠন আছে, নাম ‘শিক্ষা আলোচনা সোসাইটি’। অতিমারির কারণে দীর্ঘ দু’বছর সারা রাজ্যের প্রাথমিক স্কুল বন্ধ ছিল। কিন্তু শিশুদের শিক্ষাদান বন্ধ থাকেনি অনেক জায়গাতেই। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বটতলায়, চণ্ডীমণ্ডপে, ক্লাবঘরে, মসজিদে নিয়মিত স্কুল বসেছে। বসিয়েছেন এক-দু’জন দরদি শিক্ষক, তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা। মুশকিল হল, শিশুদের শিক্ষাদানের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিগুলি এই যুবক-যুবতীদের জানা থাকে না। সেই অভাব পূরণের লক্ষ্যে সোসাইটির সদস্যরা নিজ উদ্যোগে বাংলা, অঙ্ক ও ইংরেজির অসংখ্য ‘লেসন প্ল্যান’ তৈরি করেছেন। সেগুলি এক সঙ্গে করে নবনির্মাণ: কমিউনিটি শিক্ষার হাতবই নামে একটি পুস্তকও ছাপিয়েছেন তাঁরা, পকেটের পয়সা দিয়েই। নিজেদের ওয়েবসাইটেও বইয়ের সফট কপি আপলোড করে দিয়েছেন। স্কুল খুলে গিয়েছে, আপাতত বন্ধ সেই স্কুলগুলি, কিন্তু চতুর্থ ঢেউ ছোবল মারতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকেই আগাম কাজ গুছিয়ে রাখছেন তাঁরা।

কোভিড-পরবর্তী বুনিয়াদি শিক্ষার পুনর্গঠন বিষয়ে সম্প্রতি আলোচনার আসর বসে শহরের এক প্রেক্ষাগৃহে। সেখানে খোঁজ পাওয়া গেল এমন অসংখ্য ব্যতিক্রমী উদ্যোগের, অতিমারির ফলে শিক্ষার ঘাটতি পূরণে রাজ্যের নানা প্রান্তে যারা বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছে। দু’বছর পর স্কুল খুলেছে বটে, কিন্তু তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে যারা এখন পড়ছে, তারা কখনও স্কুলেই আসেনি। স্বাভাবিক ভাবেই অক্ষর পরিচয় হয়নি অধিকাংশের। এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার বিপুল ঘাটতি পূরণে সরকারের তরফে কিছু বাস্তবোচিত পদক্ষেপ ও অতিরিক্ত তৎপরতা চোখে পড়ার কথা ছিল। দুঃখের কথা, তেমন কিছু এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। “উল্টে শিক্ষা দফতরের কর্তাব্যক্তিদের কাছে আমাদের শুনতে হচ্ছে যে, আমরা নাকি অতিরিক্ত চিন্তা করছি, পরিস্থিতি এমন কিছুই ভয়াবহ নয়। ঠিকঠাকই আছে সব।”— আক্ষেপ করছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ত্রী। রাষ্ট্রের তরফে সমস্যা অস্বীকার করার প্রবণতা ভয়ানক, কারণ তা বিপদ হ্রাস করার বদলে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

ধরে নেওয়া যায়, অদূর ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রের তরফে শিক্ষার এই ঘাটতি নিরাময়ে বিশেষ কিছু করা হবে না। করা হলেও সেই উদ্যোগ নেহাতই পর্যবসিত হবে দায়সারা ‘টোকেনিজ়ম’-এ। যেমনটি হয়েছে ‘মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক’ বা শিখন সেতু-র বেলা। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, স্কুল খোলার পর পরই শিক্ষা দফতরের তরফে প্রতি শ্রেণির পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য শিখন সেতু নামে বই ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল। যত দূর জানা যায়, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের কেউই সেগুলি আজ পর্যন্ত উল্টেপাল্টে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। বেশির ভাগ স্কুলেই তা ডাঁই হয়ে পড়ে আছে টিচার্স রুমের কোণে।

সরকারের উচিত ছিল এই রকম সস্তায় বাজিমাতের রাস্তা ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা। দরকার ছিল শিক্ষকদের পর্যাপ্ত কর্মশালার আয়োজন করা, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করা, শুধু বেতনভুক শিক্ষকদের (রুটিন কাজকর্মের বাইরে যাঁদের দিয়ে বেশি কিছু করানো যায় না) উপর ভরসা না করে স্থানীয় শিক্ষিত সমাজকে শামিল করা। মুশকিল হল, প্রচলিত ব্যবস্থায় বিদ্যালয়গুলো সমাজবিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। তার চার ধারে জেলখানার মতো বাউন্ডারি ওয়াল। নাম-কা-ওয়াস্তে পরিচালন সমিতি বা অভিভাবক সভা থাকলেও সেখানে মূলত ছড়ি ঘোরায় স্থানীয় রাজনীতির কারবারিরাই।

স্কুল-ক্লাসরুম-সিলেবাস-পরীক্ষা নিয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা যুগ-যুগ ধরে প্রচলিত ছিল, অতিমারি আমাদের অনেক ভাবেই তার বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিক্ষার বিপুল ঘাটতি মেটানোর কাজে নাগরিক সমাজকেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন আলোচনাসভার অন্যতম বক্তা অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী। তাঁর কথায়, “সমস্যা ভয়ঙ্কর। শিক্ষার অভাবে একাধিক প্রজন্ম ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে। ভবিষ্যতে দেশের সমাজ অর্থনীতি রাজনীতি, সর্বত্র এর গুরুতর প্রভাব পড়বে। তাই শিক্ষিত অভিভাবকদের, বেকার যুবক-যুবতীদের, অবসরপ্রাপ্তদের— এক কথায় সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ব্যাপারটাকে একটা গণ-আন্দোলনের চেহারা দিতে হবে। সরকারের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দায়মুক্তি সম্ভব নয়।” আমরা শুনছি কি?

অন্য বিষয়গুলি:

school Students West Bengal Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy