কেন্দ্রের টিকা নীতি বিষয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় কিছু পরিবর্তনের কথা শোনা গেল। জানা গেল, শেষ পর্যন্ত রাজ্যগুলিকে টিকা সরবরাহ করতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। আশ্চর্য যে এই সিদ্ধান্ত নিতে মোদী সরকারের এত দিন লাগল, এতটা পথ হাঁটতে হল। বলা বাহুল্য, সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনা, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ক্ষোভ প্রকাশের পর এই পদক্ষেপ। তিতিবিরক্ত দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল কিছু দিন আগেই বলেছেন, কেন্দ্রের হাবভাব দেখে মনে হয়, বোধ হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ার জন্যও কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকেই নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র কিনে নিতে বলবে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তির্যক সুরে বললেও সত্যিই প্রায় তেমন পরিস্থিতি দেশের ছোট শহর বা গ্রামগুলিতে। কেবল টিকা কে দেবেন, এটাই প্রশ্ন নয়, কী করে তা পাওয়া যাবে এটাও তো একটা বিরাট ধাঁধা। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়তে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে সম্প্রতি ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার মন কি বাত শুনিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। জাতীয় পঞ্চায়েতি রাজ দিবস পালনের বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন, অতিমারির সঙ্গে লড়াইয়ে গ্রামের স্থানীয় নেতাদেরই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
কাজটা বোধ হয় বাজার থেকে অস্ত্রশস্ত্র কিনে বিদেশি শক্তির সঙ্গে লড়াই করার চেয়েও কঠিন! মনে রাখতে হবে যে, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ খানিকটা কমার লক্ষণ দেখালেও সরকারি ভাবেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, অদূর ভবিষ্যতে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ অবশ্যম্ভাবী; এবং অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে প্রায় না-থাকা গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে সেই ঢেউয়ের সামনে দাঁড়ানো আর প্যাড, গার্ড, হেলমেট ছাড়া শোয়েব আখতারকে পার্থ-এর পিচে খেলা যে প্রায় সমান কঠিন, তা বুঝতে বিজ্ঞানী হতে হয় না।
আসলে কখনও টিকা জাতীয়তাবাদ, কখনও টিকা কূটনীতি, আর বাকি সময়টা টিকা নাটকে আটকে থাকা কেন্দ্রীয় সরকার করোনা সামলাতে কখনও বিজ্ঞানকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। দিলে, বিশেষজ্ঞদের সাবধানবাণী ছুড়ে ফেলে ঘোর অতিমারি কালে বাংলায় এক মাস ব্যাপী নির্বাচন থেকে শুরু করে কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে জড়ো হতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিত না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে আমল না দেওয়ার স্পর্ধা দেখাত না।
কয়েক মাস পিছনের দিকে তাকানো যাক। এখন নরেন্দ্র মোদী গ্রামগুলিতে কোভিড ঢোকার সাবধানবাণী শোনালেও, দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কয়েক মাস আগে সদর্পে বলেছিলেন, দেশে করোনার খেলা প্রায় শেষ। দাবি করেছিলেন— শুধু দেশকে বাঁচানোই নয়, পৃথিবীর ৬২টি দেশে সাড়ে পাঁচ কোটি টিকা সরবরাহ করে ভারত পৃথিবীর ওষুধের দোকানে পরিণত হয়েছে। মার্চ মাসে যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই দাবি করছেন, তখনই কিন্তু মূলত পরিযায়ী শ্রমিকদের হাত ধরে বিপদ বাড়ছে, বা বলা ভাল, বেড়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যই বলছে, ২০২০ সালের অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসেই দেশের গ্রামগুলিতে কোভিড সংক্রমণ ও সেই সংক্রমণ থেকে মৃত্যুর সংখ্যা শহরাঞ্চলকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। আর যদি ২০২০ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর ধরা যায়, তবে প্রায় ৯০ লক্ষ মোট কোভিড আক্রান্তের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ ছিল গ্রামে। মৃত্যুর হিসাবেও গ্রাম ও শহরের মধ্যে বেশি তফাত ছিল না। এ বছরের মার্চ মাসে গ্রামে কোভিড সংক্রমণ কমলেও, তা মে মাসে শহরে আক্রান্তের প্রায় সমান হয়ে গিয়েছে।
মনে রাখতে হবে, এই হিসাবগুলি সরকারি। এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যুর আসল সংখ্যাটা সরকারি হিসাবের বহু গুণ বেশি। হিসাবের গোঁজামিলের বেশির ভাগটাই গ্রামাঞ্চলে ঘটতে বাধ্য। কেননা শহরের তুলনায় নজরদারি, সঠিক হিসাব রাখা— সব কিছুতেই গ্রাম পিছিয়ে। নেই মিডিয়ার চোখও। তাই দিল্লিতে অক্সিজেনের অভাবে এক জন রোগীর মৃত্যু-মুহূর্ত ব্রেকিং নিউজ় হয়, গ্রামে শয়ে শয়ে কোভিড-আক্রান্ত মানুষ মারা গিয়ে গঙ্গায় ভাসমান লাশ না হলে কারও হেলদোল হয় না।
এক সরকারি স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছ থেকে শুনছিলাম, কী ভাবে তাঁর জেলায় লাফিয়ে লাফিয়ে করোনা সংক্রমণ গত এপ্রিল মাস থেকে বাড়ছে। তিনি বলছিলেন, “এটা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। কেননা গ্রামাঞ্চলে কত জন যে করোনার পরীক্ষা করাচ্ছে, তা বলা মুশকিল। প্রথমত, গ্রামের মানুষ অতটা সচেতন নন, আর সচেতন হলেও পরীক্ষা করানোর জায়গার অভাব।” ছবিটা সারা দেশে প্রায় একই রকম।
যদি সময়মতো করোনা পরীক্ষা এই মারণরোগের সঙ্গে লড়ার প্রাথমিক শর্ত হয়, তবে রোগের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি টক্কর দেওয়ার উপায় হল টিকাকরণ। গোটা দেশের যখন প্রয়োজন কোভিড টিকাকরণ নিয়ে একটা সার্বিক পরিকল্পনা, তখন মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট-এর ভাষায়: ভারত সরকার স্রেফ পালিয়ে গেল দায়িত্ব ছেড়ে। পৃথিবীর যে দেশ সবচেয়ে বেশি টিকা তৈরি করতে সক্ষম, তারই রাজ্যগুলি বিদেশের বাজারে থলি হাতে বেরিয়ে পড়ল একে অন্যের সঙ্গে লড়ে টিকা জোগাড় করতে। এর ধাক্কাও বেশি পড়ছে গ্রামের মানুষদের উপর। এখন ভুল শুধরানোর চেষ্টা হলেও অনেক ক্ষতি যে ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে, তা বলা বাহুল্য।
পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। কোউইন অ্যাপের তথ্য অনুযায়ী, এ রাজ্যের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের টিকাকরণ হলেও গ্রামাঞ্চলে দশ শতাংশ মানুষেরও এখনও টিকাকরণ হয়নি। কোভিডের সঙ্গে লড়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বানানোর কথা বললেও, গত এক বছরে যে পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি, তা স্পষ্ট। শহরেই যেখানে রোগীরা আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেনের অভাবে খাবি খাচ্ছেন, সেখানে গ্রামের রোগীরা কতটা অসহায়, বুঝতে অসুবিধে হয় না। আসন্ন তৃতীয় ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কেন কেন্দ্রীয় সরকারের এই আধখ্যাঁচড়া নীতি, দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy