গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
টাটা গোষ্ঠী আবার সাফল্যের পথে। গত বছর টাটা মোটর্স গাড়ির বাজারে তাদের শেয়ারের দামের দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এবং টাটা স্টিলও মূল্যবৃদ্ধির সুফল ভোগ করেছে। টাটা কনসালটেন্সি এবং টাইটান তাদের গতিছন্দ অক্ষুণ্ণ রেখেছে। যদিও এই বণিকগোষ্ঠীর দেনা এখনও অনেক। তবু ভার যেন কোথাও কমছে। বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ পাচ্ছেন। গোষ্ঠীর বাজারি পুঁজির পরিমাণ বিগত সময়ের তুলনায় বেড়েছে। গোষ্ঠীর বাজারমূল্যের ৯০ শতাংশের নিরিখে টিসিএস-এর শেয়ারের দাম দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে। এ থেকে প্রমাণিত যে, শুধুমাত্র সফটঅয়্যার পরিষেবা সংস্থাটি আর এই গোষ্ঠীর বিজয়কেতনটি ধরে নেই।
এ সমস্ত কিছুই টাটা গোষ্ঠীর উচ্চতম পরিচালকবর্গের সাফল্যের দিকটিকেই তুলে ধরে। কিন্তু কেউ যদি টাটাদের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলির পর্যালোচনা করতে বসেন এবং এমন চার থেকে পাঁচটি বড় ক্ষেত্রকে বেছে নেন, যেখানে একই অভিমুখ দিয়ে একাধিক ব্যবসার সম্ভাবনা রয়েছে, তিনি দেখতে পাবেন এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা এবং বিমান নির্মাণ। যার মধ্যে মালবাহী বিমান, যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে হেলিকপ্টারের নির্মাণ পর্যন্ত যুক্ত। অস্ত্রবাহী এবং প্রতিরক্ষা-জাতীয় কাজে ব্যবহারযোগ্য গাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি অগ্রণী নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে গোষ্ঠীর ‘সুপার অ্যাপ’ সংক্রান্ত ডিজিটাল ব্যবসা আবার উপভোক্তা-নির্ভর পরিষেবা বাণিজ্য অভিমুখী। যার মধ্যে পর্যটন ও আর্থিক পরিষেবাও পড়ে (শেষেরটি অবশ্য ইতিপূর্বে ব্যর্থ হয়েছে)। সব মিলিয়ে বোঝা যায়, অধিগ্রহণ এই বিশাল লাফের পিছনে এক বড় ভূমিকা নিয়েছে। তৃতীয়ত, এই গোষ্ঠীর ইলেক্ট্রনিক হার্ডঅয়্যার নির্মাণ, হ্যান্ডসেট তৈরি ও অ্যাসেম্বলিংয়ের কারখানা, নেটওয়ার্ক ভিত্তিক কোম্পানিতে লগ্নিকরণ এবং চিপ নির্মাণের দুনিয়ায় প্রবেশের সাম্প্রতিক ঘোষণাও তাদের সাফল্যের পিছনে কাজ করেছে। টাটা গোষ্ঠীর তরফে বিদ্যুৎচালিত যান নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টাও লক্ষণীয়। এবং সর্বোপরি এয়ার ইন্ডিয়া অধিগ্রহণের চেষ্টাও মাথায় রাখতে হবে। যদিও তা ঘটলে বিষয়টি এক মিশ্র বিমান পরিবহণ সংস্থার দিকে এগোবে (ভিস্তারা এবং এয়ার ইন্ডিয়ার মিশেল)।
সব মিলিয়ে এই উদ্যোগের পরিধি তথা ব্যাপ্তি একটা দিকেই ইঙ্গিত করে— টাটা গোষ্ঠী বিশ্বের সঙ্গে কদম মেলাতে চলেছে সেই সব ক্ষেত্রে, যেখানে ইতিপূর্বে বিশ্বের প্রধান বাণিজ্যিক দানবেরা পা রেখেছে। যার মধ্যে রয়েছে ইন্টেল, স্যামসুং, টেসলা, হুয়েই, অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট ইত্যাদি। বিশ্ববাণিজ্য মঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোয় এরা সকলেই কিন্তু টাটার চেয়ে অনেক বেশি আলোকিত। এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে গেলে যে কী পরিমাণ মানসিক সামর্থ্য, আর্থিক বল এবং গবেষণা খাতে ব্যয় করার ক্ষমতা থাকা দরকার, তা ওয়াকিবহালরা ভাল জানেন। এমন ক্ষেত্রে কোথাও একটা ফারাক চোখে পড়তে বাধ্য। টাটা গোষ্ঠীর তরফ থেকে সবসময় একটি বিন্দুতে মনঃসংযোগের কথা বলা হয়। কিন্তু এখনও যেন তারা একটা সাবেকি ঘরানাতেই আবদ্ধ। প্রযুক্তি-নিবিড় বাণিজ্যের সময়ে নিজেদের বড় খেলোয়াড় হিসেবে দেখানোর পরিকল্পনা তাদের মধ্যে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সার বা সিমেন্টের মতো পণ্যের ব্যবসা থেকে সরে আসার ব্যাপারটাকেও এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু ইস্পাত ব্যবসাকে আঁকড়ে থাকার ব্যাপারটা এই ভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায় না। পাশপাশি, পুঁজি-নিবিড় বাণিজ্যে ঝুঁকির উপর ঝুঁকির সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্তত তাদের চলনের সাবেকিয়ানা দেখলে তো নয়ই। এখানে সামান্য মার্জিন এড়াতে গেলেও সূক্ষ্ম মাপজোকের প্রয়োজন রয়েছে।
টাটা গোষ্ঠীর অতীত ইতিহাস থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয়। টাইটান বা টাটা এলক্সসি-র মতো ডিজাইন বিপণির ধাঁচের উপভোক্তা-নির্ভর ব্যবসায়ে সাফল্য টাটাদের পরবর্তী সময়ের ঘটনা। টাটা এলক্সসি-র শেয়ারের দাম বছরে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তাদের পূর্বতন উদ্যোগগুলি স্থানীয় স্তরে প্রাপ্য উপাদানগুলির নির্ভর করেই বেড়েছিল। খনিজ লোহা, কয়লা, চুনাপাথর ইত্যাদি থেকে ইস্পাত নির্মাণ, কার্পাস বলয় থেকে বস্ত্রবয়ন শিল্প, জলশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন তার উদাহরণ। কিন্তু সাম্প্রতিককালের বাণিজ্য চুক্তিগুলি তেমন সাফল্য দেয়নি। ইউরোপে ইস্পাত কারখানা, ব্রিটেনে দু’টি বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণ কারখানা, বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় উঁচুদরের হোটেল ব্যবসা— সব কিছুর পরিণতিই বেশ শোকাবহ। সেখানে টেলিকম বাণিজ্যকে ক্ষতের উপর খানিকটা প্রলেপ বলা যেতে পারে। বিমান পরিবহণ ব্যবসায় টাটারা খুবই ছোট মাপের খেলোয়াড়। সে ক্ষেত্রে মারুতি বা ইন্ডিগো দু’দিক থেকে বাজার ধরে রেখেছে।
এমত পরিস্থিতিতে কোন যুক্তি কাজ করতে পারে? বিদেশি অংশীদারদের কাছ থেকে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা প্রদানের সুবিধা দিতে পারে প্রতিরক্ষা অথবা দিতে পারে সরকার। দেশের অন্তর্বাণিজ্যও সুবিধা দিতে পারে। যদি পণ্যের সরবরাহ বিশ্বমানের হয়। যেমন হ্যান্ডসেট। কিন্তু তেমন ক্ষেত্রও এখন আর ফাঁকা নেই। বাদবাকি যে সব ক্ষেত্র পড়ে রইল (কিছু ক্ষেত্র বাদে), সে সবের জন্য ঠেকনা দিতে সরকারের তরফে বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তা বা শুল্ক-সুরক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু এ ভাবে কত দিন চলবে? উদাহরণ হিসেবে যদি চিপ তৈরিকেই ধরা যায়, দেখা যাবে শুধুমাত্র কোনও একটি বিশেষ বাজারের জন্য তা উপযুক্ত। আসলে বিষয়টি এমন যে, সব ব্যবসাকে বিরাট সুযোগসম্পন্ন বলে মনে হয় অথবা সরকার সেটিকে যে ভাবে দেখিয়ে থাকে, তা সব সময় কাজে না-ও আসতে পারে। ফলদায়ী না-ও হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা পেতে হলে বাণিজ্যের যোগ্য ক্ষেত্রটিকে আগে খুঁজে বার করা দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy