সেটা ১৮৯৯ সাল। থরস্টাইন ভেবলেন, বিয়াল্লিশ বছর বয়সি এক নরওয়েজিয়ান-আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো-তে ‘ফেলো’ হিসেবে নিযুক্ত থাকাকালীন প্রকাশ করলেন এক অসামান্য গ্রন্থ, যেটির শিরোনাম দ্য থিয়োরি অব দ্য লেজার ক্লাস। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু— প্রকাশ্যে সম্পদ প্রদর্শনের উদ্দেশে দৃশ্যমান বিলাসবহুল পণ্য ও সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডে বিপুল ব্যয়ের রীতি, যাকে ভেবলেন তাঁর গ্রন্থে ‘কনস্পিকিউয়াস কনজ়াম্পশন’ বলে উল্লেখ করেন— তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎস, ফলাফল এবং অর্থনৈতিক তাৎপর্য। সমাজবিজ্ঞানের ‘ক্লাসিক’ হিসেবে ধরা হয় যে গ্রন্থগুলিকে, ভেবলেনের এই বই সেগুলির অন্যতম, এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।
সম্প্রতি ভেবলেনের একটি জীবনীগ্রন্থ (ভেবলেন— দ্য মেকিং অব অ্যান ইকনমিস্ট হু আনমেড ইকনমিক্স) প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকায়। গ্রন্থটির প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত একটি সভা দেখার সুযোগ হল কিছু দিন আগে ইন্টারনেটের কল্যাণে। সেখানে ভেবলেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর জীবনীলেখক বললেন, ভেবলেন যখন ‘কনস্পিকিউয়াস কনজ়াম্পশন’ নিয়ে ভাবছিলেন, তখন এটা যে আদৌ ভাবনাচিন্তা করার মতো একটা বিষয়, সেটা এই পৃথিবীতে আর কেউ মনে করেননি। তাই এ কথা বলাই যায়, ভেবলেন তাঁর সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন।
ভেবলেনের কাজের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা প্রায় সবাই উপরোক্ত মন্তব্যটির সঙ্গে সহমত হবেন। সহমত ছিলাম আমিও, তবে কিছু দিন আগে পর্যন্ত। ভুলটা ভাঙল অতি সম্প্রতি, যখন হঠাৎ করেই চোখে পড়ল বিশ শতাব্দীর গোড়ায় বাংলা ভাষায় রচিত একটি অসামান্য প্রবন্ধ। প্রবন্ধটি পড়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ভেবলেন যখন শিকাগো শহরে বসে ‘কনস্পিকিউয়াস কনজ়াম্পশন’ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিলেন, প্রায় একই সময়ে আমাদের এই বাংলায় বসে সেই একই বিষয় নিয়ে প্রায় একই রকম কিছু কথা ভাবছিলেন প্রবন্ধটির লেখক। বাংলা প্রবন্ধটির শিরোনাম—‘বিলাসের ফাঁস’। লেখকের নাম— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ভাণ্ডার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এই প্রবন্ধ। ‘কনস্পিকিউয়াস কনজ়াম্পশন’ সংক্রান্ত যে সমস্ত তত্ত্ব পাই আমরা ভেবলেন ও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অর্থনীতিবিদদের রচনায়, প্রায় সেই তত্ত্বগুলিই রবীন্দ্রনাথ বিশ্লেষণ করেছেন অত্যন্ত গভীর এবং তীক্ষ্ণ ভাবে, অথচ আশ্চর্য সহজ ভাষায়, একেবারে আমাদের দেশের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে। ‘বিলাসের ফাঁস’ রবীন্দ্রনাথের বহুলপঠিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে একটি কি না জানি না, কিন্তু প্রবন্ধটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দু’টি কারণে। প্রথমত, প্রবন্ধটির বিষয় আজও কেবল প্রাসঙ্গিকই নয়, আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে যে বিষয়গুলিকে ‘হট টপিক’ বলা হয়, সেগুলির মধ্যে অন্যতম। দ্বিতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানে রবীন্দ্রনাথের কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছিল না, তিনি এ বিষয়ে কুণ্ঠা প্রকাশও করেছেন। এই ধরনের লেখার সংবাদ তাঁর বলয়ে পৌঁছনোরও পরিস্থিতি ছিল না সে দিন। তবুও সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই তিনি যে এক ধরনের উপলব্ধি এবং ব্যুৎপত্তিতে পৌঁছতে পারতেন, এমনকি এক জন প্রশিক্ষিত পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞানীর লেখার সমতুল্য লেখা লিখতে পারতেন— এই কথাটা নতুন করে আমাদের অবাক করে দিতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি নিয়ে আলোচনা করার আগে, ভেবলেনের বইয়ের নির্যাসটুকু বলে নিই। ভেবলেন লিখছেন, পশ্চিমের বিত্তশালীরা (‘লর্ডস অব ম্যানর’) তাঁদের ‘সোশ্যাল স্টেটাস’ বা সামাজিক মর্যাদা প্রদর্শন করতে সদা উদ্গ্রীব। এর ফলে ‘কনস্পিকিউয়াস কনজ়াম্পশন’-এ তাঁরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। তার কারণ, মানুষের ‘সোশ্যাল স্টেটাস’ নির্ধারিত হয় তাঁর প্রদর্শিত সম্পদের দ্বারা, এবং আগেই বলেছি, সম্পদ প্রদর্শন করা যায় ‘কনস্পিকিউয়াস কনজ়াম্পশন’-এ অর্থ ব্যয় করে। বিত্তশালীদের এই আচরণের ফলে সমাজে ‘কনস্পিকিউয়াস’ বা দৃশ্যমান বিলাসবহুল পণ্য-পরিষেবার চাহিদা বৃদ্ধি পায় বলে এই ধরনের পণ্য-পরিষেবার উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ‘কনস্পিকিউয়াস’ পণ্য-পরিষেবাগুলি প্রকৃতপক্ষে অপ্রয়োজনীয়, অনাবশ্যক— সমাজের কার্যকারিতা বা সুস্থতার জন্য এই ধরনের পণ্য-পরিষেবার কোনও ভূমিকা নেই। অতএব পশ্চিমের বিত্তশালীদের ‘কনস্পিকিউয়াস কনজ়াম্পশন’-এ অর্থ ব্যয় করার ফলে প্রকৃতপক্ষে যেটা হয়, সেটা হল প্রয়োজনীয় পণ্য-পরিষেবার পরিবর্তে সমাজে অপ্রয়োজনীয় পণ্য-পরিষেবার ভোগ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সমাজ ‘ভাল’ সাম্যাবস্থা থেকে ‘মন্দ’ সাম্যাবস্থার দিকে এগোতে থাকে।
কাছাকাছি সময়ে লিখতে বসে রবীন্দ্রনাথও তাঁর প্রবন্ধের শুরুতেই জানিয়ে দেন, আড়ম্বর বা বিলাসের প্রতি মোহ একদা পশ্চিমি সংস্কৃতি এবং সমাজের অঙ্গ হলেও, ইদানীং (অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়) আমাদের দেশেও এর বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা যথেষ্টই চিন্তার, কারণ রবীন্দ্রনাথের মতে, “আমাদের দেশে আয়ের পথ বিলাতের অপেক্ষা সংকীর্ণ। শুধু তাই নয়। দেশের উন্নতির উদ্দেশ্যে যে-সকল আয়োজন আবশ্যক, অর্থাভাবে আমাদের দেশে তাহা সমস্তই অসম্পূর্ণ।”
কেন আমাদের দেশে আড়ম্বরের বাড়বাড়ন্ত? রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আড়ম্বরের একটা উদ্দেশ্য লোকের কাছে বাহবা পাওয়া। এই বাহবা পাইবার প্রবৃত্তি এখনকার চেয়ে পূর্বকালে অল্প ছিল সে কথা মানিতে পারি না। তখনো লোকসমাজে খ্যাত হইবার ইচ্ছা নিঃসন্দেহ এখনকার মতোই প্রবল ছিল। তবে প্রভেদ এই, তখন খ্যাতির পথ এক দিকে ছিল, এখন খ্যাতির পথ অন্য দিকে হইয়াছে।”
এই খ্যাতির পথ বদলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, “তখনকার দিনে দানধ্যান, ক্রিয়াকর্ম, পূজাপার্বণ ও পূর্তকার্যে ধনী ব্যক্তিরা খ্যাতি লাভ করিতেন।… এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে, এইজন্য বাহবার স্রোত সেই মুখেই ফিরিয়াছে। এখন আহার পরিচ্ছদ, বাড়ি গাড়ি জুড়ি, আসবাবপত্র দ্বারা লোকে আপন মাহাত্ম্য ঘোষণা করিতেছে।” শুধু তা-ই নয়, “এখন টাকা সম্বন্ধে সমাজস্থ সকলেই অত্যন্ত বেশি সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। সেইজন্য আমাদের সমাজেও এমন-একটা দীনতা আসিয়াছে যে টাকা নাই ইহাই স্বীকার করা আমাদের পক্ষে সকলের চেয়ে লজ্জাকর হইয়া উঠিতেছে। ইহাতে ধনাড়ম্বরের প্রবৃত্তি বাড়িয়া উঠে… সকলেই প্রমাণ করিতে বসে যে আমি ধনী।” কথাগুলি পড়ে ভেবলেনের ‘কনস্পিকিউয়াস কনজ়াম্পশন’-এর মাধ্যমে ‘সোশ্যাল স্টেটাস’ বা সম্পদ প্রদর্শন করার তত্ত্বের কথা মনে না পড়া অসম্ভব।
অনেক পরবর্তী কালের চলচ্চিত্র জলসাঘর দেখা থাকলে মনে হতেই পারে ‘মাহাত্ম্য ঘোষণা’-র এই প্রতিযোগিতার ফলে, পশ্চিমের মতো আমাদের দেশেও কেবল বিত্তশালীরাই অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করেন। আসলে যে তা নয়, স্পষ্ট করে দেন রবীন্দ্রনাথ, “ধনীতে ধনীতে এখন এই লইয়া প্রতিযোগিতা। ইহাতে যে কেবল তাহাদেরই চাল বাড়িয়া যাইতেছে তাহা নহে, যাহারা অশক্ত তাহাদেরও বাড়িতেছে।” ‘অশক্ত’-দের ‘চাল’ বৃদ্ধির একটি মোক্ষম উদাহরণ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, “আমরা বীরভূম জেলায় একজন কৃষিজীবী গৃহস্থের বাড়ি বেড়াইতে গিয়াছিলাম। গৃহস্বামী তাহার ছেলেকে চাকরি দিবার জন্য আমাকে অনুরোধ করাতে আমি বলিলাম, “কেন রে, ছেলেকে চাষবাস ছাড়াইয়া পরের অধীন করিবার চেষ্টা করিস কেন।” সে কহিল, “বাবু, একদিন ছিল যখন জমিজমা লইয়া আমরা সুখেই ছিলাম। এখন শুধু জমিজমা হইতে আর দিন চলিবার উপায় নাই।… আমাদের চাল বাড়িয়া গেছে। পূর্বে বাড়িতে কুটুম্ব আসিলে চিঁড়াগুড়েই সন্তুষ্ট হইত, এখন সন্দেশ না পাইলে নিন্দা করে। আমরা শীতের দিনে দোলাই গায়ে দিয়া কাটাইয়াছি, এখন ছেলেরা বিলাতি রাপার না পাইলে মুখ ভারী করে। আমরা জুতা পায়ে না দিয়াই শ্বশুরবাড়ি গেছি, ছেলেরা বিলাতি জুতা না পরিলে লজ্জায় মাথা হেঁট করে।”
এর অর্থনৈতিক পরিণাম কী? রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ইহাতে ফল হইতেছে দেশের ভোগবিলাসের স্থানগুলি সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিতেছে, শহরগুলি ফাঁপিয়া উঠিতেছে, কিন্তু পল্লীগুলিতে দারিদ্র্যের অবধি নাই।… দেশের অধিকাংশ অর্থ শহরে আকৃষ্ট হইয়া, কোঠাবাড়ি গাড়িঘোড়া সাজসরঞ্জাম আহারবিহারেই উড়িয়া যাইতেছে। অথচ যাঁহারা এইরূপ ভোগবিলাসে ও আড়ম্বরে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, তাঁহারা প্রায় কেহই সুখে স্বচ্ছন্দে নাই; তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি, অনেকেরই ঋণ, অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি মহাজনের দায়মুক্ত করিবার জন্য চিরজীবন নষ্ট হইতেছে…।”
পরিত্রাণের উপায়ও ওই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, “প্রত্যেকে জীবনযাত্রাকে সরল করুন, সংসারভারকে লঘু করুন, ভোগের আড়ম্বরকে খর্ব করুন, তবে লোকের পক্ষে গৃহী হওয়া সহজ হইবে…। গৃহই আমাদের দেশের সমাজের ভিত্তি…তাহাকে ত্যাগের দ্বারা [যদি] নির্মল না করি, তবে অর্থোপার্জনের সহস্র নূতন পথ আবিষ্কৃত হইলেও দুর্গতি হইতে আমাদের নিষ্কৃতি নাই।”
একুশ শতকের পৃথিবীতে, ‘সোশ্যাল স্টেটাস’ প্রদর্শন করতে গিয়ে যখন আমরা ভোগবাদের চোরাস্রোতে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছি, মানবসভ্যতার প্রাচুর্যের স্পর্ধা যখন প্রকৃতিরও রোষের কারণ হয়ে উঠছে বলে দেখতে পাচ্ছি— তখন শতকাধিক কাল আগে রবীন্দ্রনাথের লিখে-যাওয়া এই অমোঘ কথাগুলিকে ফিরে ফিরে পড়া জরুরি, যথাসম্ভব ছড়িয়ে দেওয়াও জরুরি।
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy