আর জি কর হাসপাতালে এক নারকীয় কাণ্ড দিয়ে যে ঘটনাক্রম শুরু, তার একটা পর্যায় শেষ হল জুনিয়র চিকিৎসকদের দশ দফা দাবি নিয়ে দরকষাকষি এবং শেষে অনশন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে। এই দাবিপত্রে নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচারের পাশাপাশি রয়েছে এমন কতকগুলি দাবি, যা মিটলে, তাঁদের মতে ভবিষ্যতের ‘অভয়া’দের কর্মজীবন নিরাপদ এবং ভয়মুক্ত হবে। এই দাবিগুলি সরাসরি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। তার মধ্যে কয়েকটি বহুচর্চিত, যেমন রেফারাল যোগাযোগের উন্নতি, চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে মানবসম্পদের ঘাটতি মেটানো এবং হাসপাতালগুলির সাধারণ পরিকাঠামোর উন্নয়ন। অন্য দিকে, এর মধ্যে কয়েকটি দাবি আছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও আন্দোলনের দাবি হিসাবে সাধারণ ভাবে অশ্রুতপূর্ব। যেমন— দুর্নীতি ও ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি।
বহুচর্চিত দাবিগুলি, অর্থাৎ রেফারাল সমস্যার সমাধান এবং পরিকাঠামোর ঘাটতি পূরণ নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না। গ্রামীণ বা ব্লক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ডাক্তারবাবু জটিল রোগাক্রান্তদের উপরের স্তরের হাসপাতালে পাঠাবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু, কোন হাসপাতালে গেলে এর ঠিক চিকিৎসা হবে এবং সেই হাসপাতালে তার জন্য উপযুক্ত এবং প্রস্তুত পরিকাঠামো আছে কি না, তা জানা না থাকার ফলে সাধারণ মানুষকে অসহনীয় অবস্থায় পড়তে হয়। সম্পূর্ণ পরিকল্পনাহীন এক রেফারাল ব্যবস্থার শিকার হয়ে আজ আমরা এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছি, যেখানে রোগী এবং সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও তার অধীনে থাকা চিকিৎসকদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক প্রতি মুহূর্তে আহত হয়ে চলেছে। চিকিৎসকের ঘাটতি এবং কমজোরি পরিকাঠামো এই অবস্থাকে আরও ঘোরালো করে তুলছে।
তবে, চিকিৎসকদের আন্দোলনের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান এবং দাবিগুলি নিয়ে সহমত জানিয়েও বলতে হয়— এই সমস্যাগুলির সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু বিপরীত প্রশ্নও উঠে আসছে। মূল প্রশ্ন, এই দাবিগুলি পুরোপুরি মানা হলে সরকারি তথা সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থার কি সত্যিই মৌলিক পরিবর্তন আসবে? প্রশ্নটা উঠছে কারণ, দাবিগুলির পিছনে যে দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে, তা আমার নিতান্ত একপেশে মনে হয়েছে। গোটা বিষয়টাই দেখা হয়েছে চিকিৎসকদের চোখ দিয়ে। এটা অস্বাভাবিক নয় তার কারণ তাঁরাই এই যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত। তাঁদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার লেন্সেই তো তাঁরা সমগ্র বিষয়টা দেখবেন। কিন্তু এটাও সত্যি, এই একপেশে দেখার ফলে প্রস্তাবিত সমাধানও আধখানা রয়ে গেল।
এটাও লক্ষণীয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারের নামে যে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, তা আসলে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির নিদান। বস্তুত, জনস্বাস্থ্য চর্চার প্রথম পাঠই এটা যে দ্বিতীয়টা প্রথমের একটা ক্ষুদ্র অংশ। স্বাস্থ্যব্যবস্থার গণ্ডি অনেক প্রসারিত, সেখানে চিকিৎসক, নার্স, ওষুধ, হাসপাতালের বাইরেও রয়েছে সমাজ, পরিবেশ, রাজনীতি এবং সবার উপরে মানুষের অবস্থান যা অনেকাংশে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। যেমন, সরকারি চিকিৎসায় দুর্নীতির প্রশ্ন। ক্ষমতার বৈষম্যই দুর্নীতি এবং ভয়ের সংস্কৃতির উৎস। এই বৈষম্য এবং তার কারণে দুর্নীতি যে কোনও ব্যবস্থা বা সিস্টেম-এর ফসল, এখানে ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ। কিন্তু, দুর্নীতি সংক্রান্ত দাবি নিয়ে আলোচনার সময় অবধারিত ভাবে ব্যক্তিরাই মুখ্য ভূমিকায় চলে আসছে, এবং তাও শুধু সরকারি হাসপাতালের সেই সব বিষয়ে যেগুলির সঙ্গে চিকিৎসকদের সরাসরি যোগাযোগ আছে, যেমন ওষুধ বা যন্ত্রপাতি কেনা, পরীক্ষা, রেজিস্ট্রেশন ও কর্মনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি। কে বা কারা এই দুর্নীতি করছে তা জানা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ব্যবস্থার উন্নতি করতে হলে কী ভাবে এবং কোন বিষয়গুলির প্রভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, সেটা জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং তা শুধু কয়েকটা বিশেষ ক্ষেত্রে নয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে, এমনকি হাসপাতাল, ওষুধ ব্যবসায়ী এবং চিকিৎসাপ্রার্থী মানুষদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যেও। মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি নামক রাক্ষসের অনেক মাথা, শুধু একটা বা দুটোকে স্কন্ধচ্যুত করলে আখেরে লাভ হবে না।
এটাও বলা দরকার, স্বাস্থ্য পরিষেবা যখন বাজারি পণ্য হয়, সেই বাজারে ক্ষমতার বৈষম্য আরও তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে দুর্নীতি আরও জটিল রাস্তা নেয় এবং শেষ পর্যন্ত তা আঘাত করে দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষদেরই, কেননা সরকারি ব্যবস্থা থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে যে টাকা পরগাছাদের পকেটে যাচ্ছে, তা তো সাধারণের চিকিৎসাতেই খরচ হতে পারত। এই ক্ষেত্রে কতকগুলি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, যেমন বিচারব্যবস্থা, নিয়ামক সংস্থা, নাগরিক সংগঠন, চিকিৎসকদের সংগঠন, ছাত্র ইউনিয়ন, ইত্যাদি যারা প্রাতিষ্ঠানিক অনাচারের বিরুদ্ধে সজাগ প্রহরী হয়ে থাকতে পারে। দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে এই প্রতিষ্ঠানগুলি হয় অত্যন্ত দুর্বল অথবা তারা নিজেরাই দুর্নীতির বাহক (যেমন, আন্দোলনকারীরা এই রাজ্যের মেডিক্যাল কাউন্সিলকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেছেন)। সুতরাং, ব্যক্তি নয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলির সার্বিক সংস্কার এবং কী ভাবে নতুন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান গঠন করা যায় তা চর্চার বিষয় হওয়া উচিত। রোগী, চিকিৎসক, এবং সাধারণ নাগরিক সমাজকে নিয়ে কি এমন একটা মঞ্চ গঠন করা সম্ভব, যা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্ত রকমের আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার জন্য এবং জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে সচেতন করার জন্য প্রেশার গ্রুপ হিসাবে কাজ করতে পারে? কী ভাবে চিকিৎসক সংগঠন ও ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন আরও স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক করা যায় তাও চর্চায় আসতে পারে।
দাবিতে কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে এক ক্লিকেই কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠবে হাসপাতালগুলির খালি বেডের সংখ্যা। ব্লক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি সেই অনুযায়ী চিকিৎসাপ্রার্থীদের উপযুক্ত হাসপাতালে পাঠাতে পারবে। কিন্তু এখানে একটা বড় প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে— এর ফলে কি অপ্রয়োজনীয় রেফারাল বন্ধ করা যাবে? উল্লেখ্য, নানা রকমের সরকারি নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও ব্লক স্তরের, এমনকি জেলা স্তরের চিকিৎসকরা পর্যন্ত নানা কারণে অনেক সময়ই বাধ্য হন সাধারণ রোগীকেও রেফার করতে। এর চেয়েও বড় সমস্যা হয় যখন রোগীকে নিয়ে তাঁর পরিবারই ব্লক হাসপাতাল এড়িয়ে সরাসরি জেলা বা কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে হাজির হন। রেফারাল ব্যবস্থার সংস্কারের আওতায় এই মূলগত ব্যাধির নিদান না থাকলে খুব বেশি লাভ হবে না।
এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার একটা বৃহত্তর পরিসর যেখানে আলোচনা, বিতর্ক এবং আন্দোলনের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলগত বিষয় এবং বিকল্প উন্নয়নের রাস্তাগুলি তুলে ধরা যেতে পারে। যেমন ভাবা যেতে পারে, জেলাস্তরে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চাহিদা ক্রমাগত না বাড়িয়ে যদি ব্লক স্তরে এবং তার নীচে সামগ্রিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যের উপর আরও বেশি জোর দেওয়া হয় তা হলে সীমিত সম্পদের যথার্থ ব্যবহার হতে পারে। প্রাথমিক স্তরে স্বাস্থ্য পরিষেবার সামর্থ্য এবং কার্যকারিতা বাড়লে রেফারাল ব্যবস্থায় সংস্কার আনা অনেক সহজ হয়। শুধু তা-ই নয়, এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বেশির ভাগ মানুষের কাছে ন্যূনতম খরচে পৌঁছে দেওয়ার এটাই একমাত্র রাস্তা। স্বাস্থ্যবিমার পিছনে সরকারি ভর্তুকি কমিয়ে প্রাথমিক পরিকাঠামো শক্তিশালী করার পিছনে বেশি বিনিয়োগ করাটা কি জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশি যুক্তিযুক্ত নয়, এই প্রশ্নও উঠতে পারে। এইগুলি নিয়ে খোলাখুলি বিতর্ক হোক।
কারা এই বৃহত্তর বিতর্কের পরিসর তৈরির দায়িত্ব নেবেন? এটাও একটা আন্দোলন এবং তার দায়িত্ব নাগরিক সমাজ, চিকিৎসক গোষ্ঠী, সংবাদমাধ্যম, এবং জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদেরই নিতে হবে। জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন মানুষের এই মহাসঙ্গমের রাস্তা অনেকটাই উন্মুক্ত করেছে। এর সঙ্গে অবশ্যই সরকারকেও পাশে আনার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি, আশা রাখি, ‘অভয়া’র ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন চলবে এবং শেষ পর্যন্ত আঁধার কেটে বিচারের আলো ফুটবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy