Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Climate Change

প্রকৃতিকে অতিশাসনের ফল

খাল ও তার বাস্তুতন্ত্রের বিকল্প কি লোহার পাইপ হতে পারে? কিন্তু শুনছে কে?

সুপ্রতিম কর্মকার
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:০০
Share: Save:

চাষির ফসল নষ্ট হয় কি বন্যা বা অতিবৃষ্টিতে? চাষির সঙ্গে কথা বললেই স্পষ্ট হয়, যে সব এলাকায় জল তাড়াতাড়ি সরে যায়, সেখানে বন্যার পরেও বেঁচে যায় ফসল। যেখানে দিনের পর দিন খেতে জল দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানেই ফসল পচে নষ্ট হয়। বাংলার বুক জুড়ে নদীনালা, খালবিল থাকতেও নিকাশি সমস্যায় জর্জরিত গোটা রাজ্য। বাঙালির ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে নীহাররঞ্জন রায় ‘ধনসম্বল’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন বাংলার নদীকে। সেই মূল্যবোধকে আঘাত করা শুরু হয় ঔপনিবেশিক আমলেই। রাজস্ব আদায়কে সামনে রেখে ১৭৯৩ সাল থেকেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হল। নির্মাণ হল নদীর ধারে ‘পারবাঁধ’ বা ‘এমব্যাঙ্কমেন্ট’। বন্যা নিয়ন্ত্রণ হল ঠিকই, তবে বিনষ্ট হল নদীর স্বাভাবিক জীবনপ্রক্রিয়া। বন্যা হলে নদী প্লাবনভূমিতে পলি বিছিয়ে দিত, বন্যার তোড় নদী খাতকে গভীর ভাবে ‘ড্রেজিং’ করে দিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে সেচবিজ্ঞানী উইলিয়ম উইলকক্স সাহেব বলেছিলেন, পারবাঁধ আসলে ‘শয়তানের শৃঙ্খল’। শৃঙ্খলিত নদীতে পলি জমে আজ নদীখাত হয়েছে উঁচু, আর প্লাবনভূমি অনেক নীচে। দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকছে বৃষ্টির জল, বেরোনোর পথ পাচ্ছে না। কান্দি, ঘাটাল, সুন্দরবন-সহ নানা জায়গায় বৃষ্টির পর জলযন্ত্রণা সহ্য করছেন মানুষ। সুন্দরবনের সমস্যাটা আরও জটিল, কারণ সেখানে নদীর বুকে জোয়ার-ভাটা খেলা করে।

সিপাইবিদ্রোহ দমনের জন্য ভারতে রেলপথের প্রসার ত্বরান্বিত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তার বিরোধিতা করেছিলেন আর্থার কটন। তাঁর যুক্তি ছিল, রেলপথ পাতলে সব থেকে বেশি ক্ষতি হবে নদীগুলোর। নষ্ট হবে স্বাভাবিক নিকাশি ব্যবস্থা। এ দিকে স্বাধীনতার পর দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা ভাবলেন, বড় বাঁধগুলো হবে আধুনিক ভারতের ‘মন্দির’। বড় বাঁধ নির্মাণের পর থেকে দেখা গেল নিকাশি জটিলতা। বড় বাঁধের সঙ্গে নিকাশি ব্যবস্থা যুক্ত করা গেল না। উদাহরণ চোখের সামনেই। দামোদর নদী পরিকল্পনায় নিকাশি ব্যবস্থা এতটাই ভেঙে পড়ল যে, দামোদরের নিম্ন অববাহিকায় বৃষ্টির জল বার করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠল। ময়ূরাক্ষীর উপর ম্যাসাঞ্জোর বাঁধ তৈরির পর নদীর নিম্ন অববাহিকাতে অবস্থিত কান্দিতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হল, যে জল নিকাশির জন্য ‘কান্দি মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করা হল। ফরাক্কা ব্যারাজ তৈরির পর জল বেরোতে না পারার জন্য জঙ্গিপুরের কাছে তৈরি হল বংশীবাটীর বিল।

জন্মলগ্ন থেকে পাগলা, বাঁশলোই, গুমানি নদীরা ভাগীরথীতে জল ফেলত। এই নদীগুলোকে অতিক্রম করে ‘ফিডার ক্যানাল’ তৈরির পর থেকে স্বাভাবিক নিকাশি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়ল। প্রতিটি নদীর জন্য নির্মাণ হল ‘ড্রেনেজ স্কিম’। তা খাতায় কলমে যতটা রইল, ততটা রূপায়িত হল না। ক্রমে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বাঁধের সঙ্গে নিকাশি ব্যবস্থা যুক্ত করা এতটাই ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াল যে, দুটোকে বিচ্ছিন্নই রাখা হল। বিশ্ব ব্যাঙ্কও এ কথা স্বীকার করে নেয়। যদিও নর্মদার উপর সর্দার সরোবরের মতো বড় বাঁধ তৈরির সময় বিশ্ব ব্যাঙ্ক টাকার জোগান দেয়।

বাংলার মফস্সলের ছোট শহরগুলো কোনও না কোনও নদীর ধারে। বন্যার জল নিকাশির জন্য এই ছোট নদীগুলোর গুরুত্ব অনেক। অথচ, শহরতলির মধ্যে নদীর যে অংশ পড়ছে, তা দিনের আলোতেই জবরদখল হয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণনগরের অঞ্জনা, মালদহের মহানন্দা, বালুরঘাটের কাশিয়াখাড়ি, জলপাইগুড়ির করোলা, চাকদহের বুড়ি গঙ্গা, কল্যাণীর যমুনা— এমন সব নদী আজ যেন পূর্বের স্মৃতিচিহ্ন কেবল। কাজেই বৃষ্টির জল নিকাশিপথ নেই। পরিবেশকর্মীদের দাবি, বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন নদী সংস্কারের কাজ করতে চাইলেও, রাজ্য সেচ ও জলপথ দফতর থেকে তার অনুমোদন দিতে গড়িমসি চলে। বাংলার নদীগুলোকে রাজ্য সরকারের তিনটি দফতর দেখে। সেচ ও জলপথ, ভূমি ও ভূমি সংস্কার এবং মৎস্য। কিন্তু এই তিন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব। সত্তরের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামী পান্নালাল দাশগুপ্ত নদীর জন্য একটা পৃথক দফতরের দাবি তুলেছিলেন। পরিবেশ কর্মীদের একাংশ এখন দাবি তুলছেন, যাতে ফাইলের ফাঁসে রুদ্ধ হয়ে জেলার নদীগুলো না মরে যায়।

কলকাতায় তো জলজ্যান্ত খাল সরকারি ন‌থিতে ‘নালা’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। কলকাতা এনভায়রনমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (কেইআইআইপি) নিকাশি ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছে— বেহালা এলাকায় সেচ দফতরের অধীন চড়িয়াল খাল ও তার সংযোজিত অংশকে বড় পাইপের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আর খালের উপর দিয়ে তৈরি হবে পাকা রাস্তা। শুনে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, খাল বোজানো রুখতে শক্তিশালী আইন রয়েছে, তাই খাল সংস্কার না করে ‘নালা’ বলে দেখানো হচ্ছে। এই কাজে টাকা ঢালছে একটি ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক। খাল ও তার বাস্তুতন্ত্রের বিকল্প কি লোহার পাইপ হতে পারে? কিন্তু শুনছে কে? নদী-খালের মতো প্রাকৃতিক জলবাহিকাকে ‘শাসন’ করা আজও আমাদের অভ্যাস।

অন্য বিষয়গুলি:

Climate Change
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy