Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
আমাদের ভাবনার অভ্যাসকে ভেঙে দেয় জঁ-লুক গোদারের ছবি
Jean-Luc Godard

ছবি যখন চিন্তা করে

দুনিয়া জুড়ে রাজপথে আর ক্যাম্পাসে তরুণরা তুমুল আলোড়ন তুলবে, কিছু দিনের জন্য মনে হবে সত্যি বুঝি গোটা বিশ্বে নতুন কোনও সাম্যবাদ সমাসন্ন।

চলচ্চিত্র-দার্শনিক: জঁ-লুক গোদার। ১৯৬৮ সালের ছবি।

চলচ্চিত্র-দার্শনিক: জঁ-লুক গোদার। ১৯৬৮ সালের ছবি।

মৈনাক বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:০৪
Share: Save:

তেরোটি ছবি করবার পরে ১৯৬৭ সালে জঁ-লুক গোদার লা শিনোয়াজ় তৈরি করলেন। প্যারিসের অ্যাপার্টমেন্টে ছুটি কাটাচ্ছে জনা পাঁচেক তরুণ-তরুণী। নানা দেশের মাওবাদীদের মতো এরাও নিজেদের বলে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী। মাও-এর ‘রেডবুক’-এর লাল রং দিয়ে ঘেরা এদের চার পাশ। স্লোগান উদ্ধৃতি পোস্টার ইস্তাহারে যা দেখছি শুনছি তা ওই সময়ে কলকাতা শহরেও শোনা গিয়েছে। এই ছেলেমেয়েরা সকালে উঠে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের নামে এক্সারসাইজ করে, তার পর সারা দিন চলে তর্ক, জল্পনা, বিপ্লবের রিহার্সাল। এর কিছু দিন পরেই প্যারিসে মে-৬৮’র ঘটনা ঘটবে। দুনিয়া জুড়ে রাজপথে আর ক্যাম্পাসে তরুণরা তুমুল আলোড়ন তুলবে, কিছু দিনের জন্য মনে হবে সত্যি বুঝি গোটা বিশ্বে নতুন কোনও সাম্যবাদ সমাসন্ন। অনেক সমালোচনার মুখে পড়েছিল লা শিনোয়াজ়, কিন্তু সবাই অবাক মেনেছে এর আশ্চর্য ভবিষ্যদৃষ্টি দেখে।

১৯৬৮ সাল থেকে গোদার বছর তিনেক মাওবাদী হিসেবে পরিচিত হবেন, ছবিতে স্পষ্ট করে জানাবেন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান। কিন্তু লা শিনোয়াজ় সব রকমের বামেদেরই চটিয়ে দিয়েছিল। কারণ, পরিচালক ঠিক কাদের পক্ষে কথা বলছেন তা বোঝা সহজ ছিল না। র‌্যাডিক্যাল বসন্তের ওই উদ্বেল মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পরে ক্রমশ বোঝা গেল রাজনীতিটা ভুল জায়গায় খোঁজা হচ্ছিল। ওই দশকেই যে দার্শনিকেরা নতুন করে মার্ক্সবাদ পড়ছিলেন তাঁদের এক জন জাক রঁসিয়ের। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন রিডিং ক্যাপিটাল (১৯৬৫) বইয়ের ভূমিকায় লুই আলতুসের-এর উক্তি। ওঁদের যুগ এক মহৎ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি, আলতুসের লিখছেন, দেখা শোনা বলার মতো সরলতম ক্রিয়া তখন নতুন করে শিখতে হচ্ছে। এই কথাগুলো মনে রাখলে বোঝা যায়, কেন এই ছবিতে গোদার এতখানি লাল রং রেখেছেন, কেনই বা উদ্ধৃতির মতো আওড়ে যাওয়া কথা, অনিশ্চিত ‘জেসচার’ আর থিয়েটারের উপক্রম। রেডবুক দিয়ে ঘরের দেওয়াল লাল করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই সজ্জা বইয়ের নয়, রঙের সজ্জা। রক্তের দাগ যখন দেখি, সে-ও যেন মুখের উপর লাল তুলি বুলোনো। ওই ১৯৬৭ সালেই তৈরি হয়েছিল উইকএন্ড। সেই ছবি নিয়ে এক সাংবাদিক গোদারকে প্রশ্ন করেছিলেন, এত রক্তপাত কেন? গোদার বলেছিলেন, রক্ত নয়, লাল।

রঁসিয়ের বলছেন, গোদারের ছবি চিন্তা করছে। যে সব উপাদান দিয়ে রক্তমাংসের বাস্তব গড়ে ওঠে, মানুষ আর নিসর্গ রচিত হয় পর্দায়, সেই ধ্বনি বর্ণ শব্দ অবয়ব আলাদা করে পাশাপাশি সাজিয়ে নিয়ে নতুন করে দেখতে-শুনতে-বলতে শিখছে। এটাই গোদারের রাজনৈতিক কাজ। কাজটা তিনি আগেই শুরু করেছিলেন, এই সময়টায় এসে এর একটা মার্ক্সবাদী রূপ দেখা যাচ্ছে।

যে ছবি দেখে লুই আরাগঁ লিখেছিলেন, আজ যদি বলো আর্ট কী, আমি বলবো জঁ-লুক গোদার; লিখেছিলেন, ছবিটা দেখে বেরিয়ে দেখলাম গোটা প্যারিস শহরের রং লাল, সেই পিয়েরো লো ফু-তে (১৯৬৫) দেখেছি সব দৃশ্য লাল নীল হলুদে ভাগ করা, আনা কারিনার মুখে আলপনা-আঁকা রক্ত। জঁ-পল বেলমন্দো গালে নীল রং মেখে মাথায় হলুদ ডাইনামাইট জড়ায়, তার পর লাল ডাইনামাইট। অতঃপর বিস্ফোরণ। ক্যামেরা সরে যায় নীল সমুদ্রের উপর। মৃদু হাওয়ার মতো ভেসে আসে র‌্যাঁবোর কবিতার লাইন। লিটল সোলজার-এ (১৯৬১) অ্যাকশনের মাঝখান থেকে শব্দ মুছে যায়, এক চরিত্রের সংলাপ আর এক চরিত্র স্বগতোক্তিতে বলতে থাকে। ১৯৬৭ নাগাদ তাঁর সৃষ্টির তুমুল উৎসারের প্রথম পর্ব যখন শেষ হচ্ছে, তখন গোদার গল্প বলা আরও সরিয়ে রেখে দৃশ্য-শব্দের প্রথম-পাঠের আয়োজন করলেন। বস্তু থেকে ছাড়িয়ে এনে প্রবেশিকা ক্লাসের মতো টেবিলে পাশাপাশি রেখে দেখালেন বর্ণ ধ্বনি ইমেজ। কেউ যদি বলে, ভালবাসি, আগে লক্ষ করি উচ্চারণ, প্রেমের সংবেদন পরে আসে। পর্দায় যখন লেখা ভিড় করে, লিপির ইমেজ আগে লক্ষ করি, শব্দের অর্থ পরে আসে।

পরে যখন তাঁর প্রকাণ্ড প্রকল্প হিস্ট্রি অব সিনেমা-তে (১৯৮৯-৯৮) পৌঁছবেন, তখন গোদার জানাবেন বিংশ শতাব্দীর দুর্ভাগ্য লুকিয়ে আছে এক অদর্শনে— তার ইতিহাস যে টেক্সটে ধরা হয়েছে তার সঙ্গে ইমেজের সত্যিকার সাক্ষাৎ হয়নি। ইমেজ কোনও দ্বিতীয় স্তর নয় যেখানে প্রাথমিক স্তরের, অর্থাৎ বাস্তবতার ছবি দেখি। সিনেমা-শতাব্দীর নতুন সংবাদ এই যে বাস্তবতা জিনিসটা ইমেজ ছাড়া তৈরি হয় না। কারণ, বাস্তবতা শুধু বস্তুর সমাহার নয়, সম্পর্কের মানচিত্র।

ফরাসি দার্শনিকরা অন্য রকম। চলচ্চিত্রের উপর সিরিয়াস বই লিখতে এঁরা কসুর করেন না। রঁসিয়ের ছাড়াও যে সব বড় দার্শনিক গোদারকে নিয়ে বিস্তর লেখালিখি করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন জিল দেলোজ় আর অ্যালাঁ বাদিও। দেলোজ় বলছেন, গোদার সম্পর্কের চলচ্চিত্রকার। অন্য সবাই ভাবে ‘ইজ়’ নিয়ে, গোদার ভাবেন ‘অ্যান্ড’ নিয়ে; ‘এবং’-এর ছবি তোলেন। সিনেমাতে চিন্তা দেখানো নয়, সিনেমা নিজেই চিন্তন-প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে এই ভাবে। দেলোজ়-এর মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সিনেমার সংহতি ভেঙে পড়ার এক মুহূর্ত এসেছিল। ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার বাঁধন আলগা হয়ে নতুন ইমেজ-নির্মাণের যে অবকাশ সৃষ্টি হল তাতে সাড়া দিতে পেরেছিল ফরাসি ‘নিউ ওয়েভ’। সেই আন্দোলনের শরিক গোদারের ছবিতে অসঙ্গতির কাব্য রচিত হল। ওঁর ছবিতে লোকে যাত্রা করে, কিন্তু কোথাও পৌঁছয় না। প্রশ্ন শুনি, উত্তর শুনি না, ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখি না, অভিব্যক্তি শুরু হয়ে শেষ হয় না, এগিয়ে যাওয়ার বদলে বৃত্তের মতো ঘুরে আসে ঘটনাক্রম। এই সবের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাবনার একেবারে প্রাথমিক এক অভ্যাসকে ভেঙে দেয় এই সব ছবি। আমরা ‘পারস্পেকটিভ’ রচনা করে ভাবি, পূর্বাপর দেখে, পটভূমি আর প্রসঙ্গ দেখে বুঝি। গোদারের ছবিতে এই ‘ডেপথ’-এর আদলটা সমতল করে দেওয়া হল। একে আধুনিকতার পরের পর্ব বলে চিহ্নিত করা হবে এর কিছু দিন পরেই।

ট্র্যাজেডি যদি গ্রিক চিন্তার মেটাফর হয়, সিনেমা তবে সমসাময়িক চিন্তার মেটাফর— দার্শনিক অ্যালাঁ বাদিও বলছেন। ওঁর মতে গোদারের ছবিতে দর্শনের সেই রূপ ঘনীভূত। একই দৃশ্যে পাশাপাশি সাজানো থাকছে ‘প্রকৃতির উদাসীনতা, ইতিহাসের বিচ্যুতি, মানবজীবনের অস্থিরতা, চিন্তার সৃষ্টিশক্তি’— প্যাশন (১৯৮২) আর ফিল্ম সোশ্যালিজ়ম (২০১০) প্রসঙ্গে বলছেন বাদিও। দ্বিতীয় ছবিটিতে তাঁকে এক ঝলক দেখা যায়। প্রথম ছবির সময় থেকেই বাস্তবের চরিত্ররা নিজের ভূমিকায় গল্পের মাঝে দেখা দেন। গল্পের বাঁধন ছেঁড়ার এও এক পদ্ধতি। কাহিনি আর তথ্যচিত্র একাকার হয়ে যায়, কারণ বাস্তবতা নিজেই ইমেজ ও কাহিনি দিয়ে মোড়া। প্রথম ছবি ব্রেথলেস (১৯৫৯) থেকেই দেখি পটভূমি জুড়ে চিহ্নের উৎসার— সংবাদ বিজ্ঞাপন চিত্রকলা পোস্টারে মুদ্রিত শহর। এ ভাবেই পারস্পেকটিভের অভ্যাসকে সমতল করার আয়োজন শুরু হয়েছিল। ব্রেথলেস-এর নায়ক-নায়িকা কোথা থেকে এল, এ প্রশ্ন করাই যায় না। করলে নায়ক বেলমন্দো হয়তো বলবে সে হলিউডের গ্যাংস্টার ছবি থেকে এসেছে। শেষে যখন সে পুলিশের গুলিতে মারা যায়, হাবভাব দেখে মনে হয় সে জানে না বাস্তবে মরে যাচ্ছে, না সিনেমায়।

দার্শনিকদের মতোই মৃত্যু নিয়ে আগাগোড়া ভেবেছেন গোদার। ফিকশনের সীমা মানেননি, তাই এক মজার ট্র্যাজেডির সাক্ষাৎ পেয়েছেন। লিটল সোলজার-এর সেই দৃশ্য মনে করুন। আততায়ীর মুখে শুনছি জঁ ককতোর প্রতারক টমাস উপন্যাসের শেষটুকু। বেলমন্দোর মতোই পালাতে গিয়ে গুলি খায় টমাস। ভাবে, মরার ভান করে পড়ে থাকলে বুঝি বেঁচে যাবে। কিন্তু তার কাছে কাহিনি আর বাস্তব যে-হেতু এক, উইলিয়াম টমাস মরে যায়।

ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Jean-Luc Godard cinema
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy