প্রিয়: শ্রী ৪২০ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় রাজ কপূর।
দেশ তখন সদ্য স্বাধীন— ১৯৫১ সাল। এক জমকালো পার্টি আয়োজিত হয়েছে দিল্লির তিনমূর্তি ভবনে। নিমন্ত্রণকর্তা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কিছু দিন আগেই সোভিয়েট ইউনিয়ন সফর শেষ করে দেশে ফিরেছেন তিনি। পার্টিতে অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কপূরও। তাঁর সঙ্গে প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর প্রধানমন্ত্রী বললেন, “জোসেফ স্ট্যালিনের কাছে শুনলাম, আপনার পুত্র নাকি একটা দারুণ ছবি বানিয়েছে! কোন ছবি এটা?”
পৃথ্বীরাজ কপূরের এই পুত্রের নাম রাজ কপূর। তাঁর পরিচালিত ছবিটি আওয়ারা (১৯৫১)। আগের দু’টি ছবি, আগ (১৯৪৮) এবং বরসাত (১৯৪৯) দর্শকমহলে যথেষ্ট সমাদর পেলেও আওয়ারা-ই ভারতীয় সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক হিসাবে রাজকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ছবিটি দেশে তুমুল সাফল্য পেয়েছিল তো বটেই, বিদেশেও— বিশেষ করে সোভিয়েট ইউনিয়নে— যে ছবিটি আলোড়ন তুলেছিল, তা প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কথা থেকেই স্পষ্ট!
পৃথ্বীরাজ-নার্গিস-রাজ অভিনীত আওয়ারা আপাতভাবে প্রেমের ছবি হলেও প্রকৃতপক্ষে তা যে একটি সদ্যোজাত রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ দলিল, এ কথা অনস্বীকার্য। ছবিটির প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাজ বলেছিলেন, “বিনোদন এবং সমাজ সম্পর্কে মানুষের কাছে আমার বক্তব্য— এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা করেছিলাম আমি... আওয়ারা-য় দারিদ্রের মোড়কে একটি দুর্দান্ত রোমান্টিক গল্প ছিল, যে দারিদ্র স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল আমাদের দেশ।”
ছবিটিতে এক দিকে দেখি ভারতের সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতীক হিসাবে প্রৌঢ় বিচারক রঘুনাথকে (অভিনয়ে পৃথ্বীরাজ কপূর)। তিনি প্রাচীনপন্থী, গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজনে। অন্য দিকে দেখি, নবীন অথচ দরিদ্র ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে যুবক রাজকে (রাজ কপূর)। চরিত্রগত ভাবে রাজ সরল ও নিরীহ হলেও, পরিস্থিতির কারণে সে পৌঁছে গিয়েছে অপরাধ জগতে। এই দুই চরিত্রের পাশাপাশি ছবি জুড়ে উজ্জ্বল উপস্থিতি রাজের প্রণয়ী এবং উকিল রীতার (নার্গিস)। সে প্রবল ভাবে সামন্ততন্ত্রের বিরোধী এবং স্বপ্ন দেখে শ্রেণিহীন সমাজের। তাই রাজ যখন এক দুষ্কৃতীকে খুন এবং রঘুনাথকে খুনের চেষ্টার অপরাধে অভিযুক্ত হয়, সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা হয়েও সে রাজের হয়ে সওয়াল করে আদালতে; ধর্মাবতারের উদ্দেশে রাজকে এ কথা বলার শক্তি জোগায় যে, তার মধ্যে যে অপরাধপ্রবণতা, সেটা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নয়; তাকে এবং তার মতো আরও অনেককে অপরাধী তৈরি করেছে বৈষম্যমূলক সামন্ততান্ত্রিক এই সমাজ। ছবির শেষে বিপর্যস্ত রঘুনাথকে দেখে দর্শকের মনে এই বিশ্বাস জাগ্রত হয়— সামন্ততন্ত্র পরাজিত হবে, সৎ সাধারণ মানুষের জিত হবে।
আওয়ারা ছবিটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নেহরুর সমাজতান্ত্রিক ভাবনা— বিশেষ করে তাঁর শ্রেণিহীন ধর্মনিরপেক্ষ যুবরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন, সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা এবং সরকারের নেতৃত্বে উন্নয়নের পরিকল্পনা— রাজ কপূর এবং চিত্রনাট্যকার খোয়াজা আহমেদ আব্বাসের ভাবনাচিন্তাকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৯২৯-এর লাহোর কংগ্রেসে নেহরু বলেছিলেন যে, “সামাজিক স্বাধীনতা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ছাড়া, দেশ এবং ব্যক্তি খুব বেশি বিকশিত হতে পারে না।” ভারতের জনসাধারণের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির জন্য জোর দেওয়ার কথা বলেছিলেন সম্পূর্ণ সমাজ পুনর্গঠনে— যার শুরু হওয়া উচিত মুনাফা এবং সম্পদের অভিমুখ ধনীদের থেকে দরিদ্রদের দিকে পরিবর্তনের মাধ্যমে। নেহরুর দর্শন যে তাঁকে প্রভাবিত করেছিল, রাজ কপূর সেটা স্বীকারও করেছিলেন একটি সাক্ষাৎকারে, “পণ্ডিতজি বলেছিলেন যে, তিনি চান প্রত্যেক ভারতবাসী দেশের জন্য কিছু করুন, যাতে ভারতকে নিয়ে তাঁর যে স্বপ্ন তা সত্যি হয়। তিনি এক জন স্বপ্নদর্শী ছিলেন এবং আমি তাঁর কথা অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলাম চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে।”
রাজ একাধিক বার বলেছেন, তিনি প্রথম থেকেই জনপ্রিয় ছবিই তৈরি করতে চেয়েছেন— এমন ছবি যা ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিনোদন দেবে। তা হলেও, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং জওহরলালের রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা, আওয়ারা-র পরও, প্রচ্ছন্ন ভাবে বার বার ফিরে এসেছে রাজ কপূরের ছবিতে, গোটা পঞ্চাশ দশক জুড়ে। কারণটা জানিয়েছিলেন রাজ, “আমরা একটি সংস্কারিত সামাজিক ব্যবস্থা, একটি নির্দিষ্ট ধরনের শৃঙ্খলা, দারিদ্র দূরীকরণের জন্য শিক্ষা ইত্যাদি চেয়েছিলাম। তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতি এবং তা মানুষকে কী ভাবে প্রভাবিত করছে, তা সতর্ক ভাবে লক্ষ করেছিলাম আমি। এবং সেটাই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলাম আমার কাজে— প্রেম, রোমান্টিকতা এবং মানবতাবাদের মোড়কে।”
এই ভাবনারই স্পষ্ট প্রতিফলন দেখি শ্রী ৪২০-এ (১৯৫৫)— সত্যজিৎ রায়ের মতে যা রাজ কপূরের পরিচালিত ছবিগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বিপুল জনপ্রিয় হওয়া সামাজিক স্যাট্যায়ারধর্মী এই ছবিতে প্রত্যাবর্তন ঘটে আওয়ারা-র রাজ কপূর-অভিনীত চরিত্রটির। এখানেও রাজ সরল ও দরিদ্র এক যুবক, যাকে দেখে বার বার মনে পড়ে যায় চার্লি চ্যাপলিনের দ্য ট্র্যাম্প-কে। আজও জনপ্রিয় ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ গানটা গাইতে গাইতে রাজ গ্রাম থেকে বম্বে শহরে আসে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশায়। সেখানে পৌঁছে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যে দুর্নীতি দেখে পদে পদে বিস্মিত হয় রাজ। আরও বহু মানুষের মতো প্রাথমিক ভাবে ফুটপাতই ঠিকানা হয় তার। এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও সে এবং তার সঙ্গীরা নাচগানে মেতে থাকে— ‘একদিন সবার মাথার উপর ছাদ হবে’, এই আশা বুকে নিয়ে। কিন্তু এক সময় লোভের বশবর্তী হয়ে রাজ জড়িয়ে পড়ে দুর্নীতিতে। এর ফলে সে আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করে ঠিকই, কিন্তু হারায় আরও অনেক কিছুর সঙ্গে তার সৎ ও আদর্শবাদী প্রেমিকা বিদ্যাকে (নার্গিস)। ছবির শেষে বোধোদয় ঘটে রাজের, দুর্নীতির পথ ত্যাগ করে সে ফিরে যায় গৃহহীন অথচ সৎ মানুষের দলে। তাঁদের জানায় তার উপলব্ধির কথা, “দারিদ্র ও বেকারত্বের ওষুধ দুর্নীতি নয়। এগুলির ওষুধ সাহস ও পরিশ্রম, এগুলির ওষুধ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও মানুষের ঐক্য।” আওয়ারা-র পর শ্রী ৪২০-এ ফের সামন্ততন্ত্র এবং পুঁজিবাদকে কাঠগড়ায় তোলেন পরিচালক রাজ। পাশাপাশি সরকারের নেতৃত্বে উন্নয়নই যে প্রগতির যথার্থ পথ, এই সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি তাঁর বিশ্বাসও ব্যক্ত করেন তিনি।
আওয়ারা এবং শ্রী ৪২০-এর মতো, রাজ কপূর প্রযোজিত বুট পলিশ (১৯৫৪), জাগতে রহো (১৯৫৬) এবং অব দিল্লি দূর নহি-তেও (১৯৫৭) উঠে এসেছিল তৎকালীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের করুণ আলেখ্য এবং দেশের সরকার এর সুরাহা করবে— অবশ্যই এই আশাবাদের চিত্র। উল্লেখ্য, অব দিল্লি দূর নহি-তে প্রথমে স্বভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল জওহরলাল নেহরুর, যদিও পরে সে পরিকল্পনা বাতিল হয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে।
রাজ যাকে ‘সোশ্যালি কমিটেড সিনেমা’ বলতেন, সেই রকম ছবি নির্মাণ থেকে তিনি ক্রমেই সরে আসতে থাকেন ষাটের দশকের শুরু থেকে। স্বাধীনতার প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে গিয়েছে তত দিনে। বিস্তর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সরকারের উন্নয়নের পদ্ধতি নিয়ে। প্রবল দুর্নীতি এবং ভয়ঙ্কর আমলাতন্ত্র দারিদ্র, বেকারত্ব এবং খাদ্যাভাব বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, স্বভাবতই সরকারের উপর আস্থা কমতে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের, সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করেন তাঁরা। জন্ম হয় শ্রমিক আন্দোলনের, ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এটাই হওয়ার ছিল। ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাশ লিখছেন, “সমাজতন্ত্রের প্রতি তাত্ত্বিক আনুগত্য সত্ত্বেও, কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ চাপেই, জওহরলাল মেনে নিয়েছিলেন ১৯৫৬-র শিল্পনীতির খসড়াটি, যেখানে ‘সমাজতন্ত্র’র বদলে গৃহীত হয়েছিল ‘সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক’। এর ফলে, অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারি রয়ে গিয়েছিল বেসরকারি ক্ষেত্রের।” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২/০৭/২০২২)। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা-পর্বের শেষ দিকে ভারতের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাতে, যা পুঁজিবাদী শক্তির উত্থানকে সাহায্য করেছিল।
সমাজতন্ত্রকে হাতিয়ার করে সমাজে বদল আনা যায়— রাজের এই বিশ্বাসও কি পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে ধাক্কা খেয়েছিল? সম্ভবত। যে সমাজের স্বপ্ন রাজ দেখেছিলেন পঞ্চাশের দশকের গোড়ায়, তাঁর যে মনে হয়েছিল সে স্বপ্ন আদৌ বাস্তবায়িত হয়নি, সেটা পরিষ্কার পরবর্তী কালে করা তাঁর এই মন্তব্য থেকে, “আজ যখন আশেপাশে তাকাই তখন আমি প্রবল দুর্নীতি দেখতে পাই। ...কোনও মূল্যবোধ নেই বলে মনে হয়। যাকে মানবিক গুণ বলে মনে করতাম, তার কোনও অস্তিত্ব নেই আর। গোটা সমাজব্যবস্থাতেই গোলমেলে হয়ে উঠেছে।” উল্লেখ্য, সত্তরের দশকে বিষয় হিসাবে এই ‘গোলমেলে’ সমাজ মূলধারার হিন্দি ছবিতে বার বার উঠে এলেও, রাজের সেই সময়ের কাজের মধ্যে তার ছাপ উল্লেখযোগ্য ভাবে অনুপস্থিত।
রাজ কপূরের কাজ ফিরে দেখলে মনে হয়— তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন আজও করতে পারিনি আমরা। দিনবদলের যে স্বপ্ন তিনি বুনেছিলেন তাঁর একাধিক ছবিতে খুব যত্ন করে, সেগুলি নিয়ে বৌদ্ধিক চর্চা হয় না কোনও, সম্ভবত সেগুলিকে তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্ম’-এর পর্যায় ফেলা যায় না বলেই। তাই রাজ কপূরকে আমরা মনে রেখে দিয়েছি কেবল রোমান্টিক ছবির নির্মাতা এবং নায়ক হিসাবে, তার বেশি কিছু নয়। আশা, রাজ কপূরের শতবর্ষে (জন্ম ১৪.১২.১৯২৪ — মৃত্যু ২.৬.১৯৮৮) এই ভুল শুধরে তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করব।
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy