স্মৃতি-কথা: ফোর্ট উইলিয়ামে বিজয় দিবস উদযাপনের সূচনা। উপস্থিত বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস। ৬ ডিসেম্বর ২০২২।
যাকে বিজয়ের মাস বলে জেনে এসেছি, সেই ডিসেম্বর যে বাঙালিকে এতটা বেদনাক্রান্ত করবে তা জানা ছিল না। বোর্হেসের লেখায় পড়েছি যে স্বর্গ আসলে একটি লাইব্রেরি। সেই লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান যদি বিদ্যাসাগরহয়ে থাকেন তবে তাঁর সামনে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধী, দু’জনেই, হয়তো একটি বইয়ের খোঁজ করছেন এখন, ‘বিস্মৃতি প্রতিরোধের সহজ উপায়’।
স্মৃতিকে মুছে দিতে পারলে, বিস্মৃতিকে আর নিজ নামে চিনতেই পারবে না কেউ। সে রকমই স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা চলছে— বিপুল সংখ্যক মানুষের ‘দুর্গাপূজা হতে দেব না’ বলতে বলতে মিছিলে হাঁটা, কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিষ্ঠানগুলিকে বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা। বাতিলের খাতায় নাম তুলে দেওয়া হচ্ছে সেই সমস্ত রীতি বা অভ্যাসের যা ধর্মের ভিন্নতা ডিঙিয়ে বাঙালিকে একসূত্রে বাঁধতে পারত।শঙ্খ ঘোষের একটি লেখার কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে, ‘বাংলাদেশ’-এর আবির্ভাব’-এর পর পরই কবি তাঁর জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে শৈশবের ফেলে আসা গাছগুলোকে আলিঙ্গন করতে ছুটে যান আর তাঁর সঙ্গীদের কারও-কারও মনে হয়, তিনি পর্দাপ্রথার কথা ভুলে গিয়ে কোনও ঘরে ঢুকেপড়তে যাচ্ছেন। ভুল বুঝতে পেরে, পরে লজ্জিত হন তাঁরা; কবির পঙ্ক্তিই হয়তো তাঁদের অনুভব করায় যে গাছের কোনও ধর্ম নেই; ‘বুকে কুঠার সইতেপারা ছাড়া।’
গাছের যেমন ধর্ম নেই, জলেরও তো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হয় না। কিন্তু কত বাঙালির বুকে যে নদী হারানোর বেদনা দগদগে ক্ষত হয়ে আছে, কে খবর রাখে তার। সত্তরের দশকের গোড়ায় তখন দক্ষিণ কলকাতার শহরতলি সিআরপিএফ’এ ছয়লাপ। সেই উর্দিধারীদের অনেকেরই আশ্চর্য লাগত রাত এগারোটার সময় বালতি হাতে প্রায় প্রত্যেকটি পাড়ার ‘টিউকল’-এ অত মহিলাকে এক সঙ্গে স্নান করতে আসতে দেখে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে এক পিসি বলে ওঠেন, “আমরা দিনে-রাতে তিন বার সাঁতার দিয়া খাল-বিল-পুষ্করিণী পার হইতাম। জলের লাইগ্যা আমাগো ছটফটানি তোমাগো বুঝাইতে পারুম না।”
বোঝাতে কি তাঁরা, কাউকেই কখনও পেরেছিলেন? পৃথিবীর বৃহত্তম গণ-উদ্বাসনের শিকার ঢাকা-ফরিদপুর-সিলেট-খুলনা-রাজশাহির মানুষদের ‘মাস-এক্সোডাস’এর বিবরণ হয়তো ইতিহাসের কোনও কোণে মিলবে। কিন্তু তাঁরা যে কখনও কোনও ‘প্রমিসড ল্যান্ড’ পেলেন না আর, কোথায় সেই খতিয়ান? ‘মাসিমা মালপো খামু’ বলে এক দিকে যখন ট্র্যাজেডিকে ফার্স-এর চেহারা দেওয়া হচ্ছে, হাজার-হাজার ধীবরকে স্টেশন কিংবা ক্যাম্প থেকে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে দণ্ডকারণ্যের পাথুরে শুষ্কতায়। ইতিহাসের কী নির্মম বিদ্রুপ, পদ্মা-মেঘনার অনন্ত দরিয়া যাদের ডোবাত-ভাসাত, তাদেরই ঠাঁই হল কি না পাথুরে মালকানগিরিতে।
চোখের জলেরই অভাব ছিল না কেবল। সলিল সেন-এর নাটক নতুন ইহুদী-তে পূর্ববঙ্গের সংস্কৃত পণ্ডিতকে কলকাতায় এসে জোগাড়ে হালুইকরের কাজ নিতে হয়। তাঁর ছেলে পেটের জ্বালায় ডাকাতি করতে গিয়ে ট্রামে কাটা পড়ে, মেয়ে পাচার হয়ে যায় অন্ধকার জগতে। পণ্ডিত মনমোহন-এর আর্তনাদ কান ছাপিয়ে মনে বাজে, “কত দিন কত লোকের আনন্দ কইরা খাওয়াইছি/… কিন্তু সেই অন্ন যে এত চোখের জলে কিনতে লাগবো ভাবতেও পারি নাই/… সেই ভাতে যে এত জ্বালা।” প্রায় পঁচাত্তর বছর আগের নাটক এখনও কত সত্যি! আজও সুনামগঞ্জের নমশূদ্র পাড়া কিংবা চট্টগ্রামের হরিজন পল্লিতে আগুন লাগিয়ে আবার অসংখ্য ঘর থেকে খাবার চালটুকু পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই নারকীয়তা লাইভ স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে পৃথিবীকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে বিপ্র দাসকে। আজকের পদ্মা-মেঘনা অববাহিকায়, কোথায় নতুন ইহুদী নাটকের সেই মৌলভী মির্জা যিনি গলা তুলে বলবেন, ‘কথায় কথায়… বেহেস্ত দেখাস মাইনসেরে/ আর নিজেরা চাউল, চিনি, কেরোসিন চোরাই বাজারে বিক্রি করস।/ মাইনষে জবাই কইরা সুদ খাস।’
অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে? না, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত যে মানুষেরা শিয়ালদহ স্টেশনের নারকীয় পরিস্থিতির মধ্যে বাস করেও নিজেদের ‘হিন্দু’ বা ‘বৌদ্ধ’ না বলে বলতেন যে তাঁরা, ‘বরিশাইল্যা’, ‘নোয়াখাইল্যা’, ‘ময়মনসিঙ্ঘিয়া’, তাঁরা বোধ হয় ইহুদিদের থেকেও দুর্ভাগা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে, ১৯৫১ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর কনরাড অ্যাডেনাওয়ার ঘোষণা করেন যে হলোকস্টের প্রায়শ্চিত্ত করতে ইজ়রায়েলকে উদ্বাস্তু সমস্যার নিরসনে বিপুল অর্থ দেবে জার্মানি। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড-বেন-গুরিয়ন সেই অর্থের দ্বারা রাস্তা ও আবাস নির্মাণের পাশাপাশি, মরুভূমির বুকে ঠাঁই নেওয়া মানুষের ঘরে ঘরে বহু কাঙ্ক্ষিত পানীয় জল পৌঁছে দেন। উল্টো দিকে পাকিস্তানি চিন্তাধারা, পাকিস্তান আমলে এবং তার পরেও, হিন্দু-বৌদ্ধর ছেড়ে আসা জমিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে।
কে শত্রু? কেন শত্রু? জাতীয় সঙ্গীতের রচনাকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? জাতীয় পতাকার নকশা আঁকা শিবনারায়ণ দাস? বাংলাভাষার অধিকারের সৈনিক, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত? যাঁরা এঁদের শত্রু বলেন, কাজী নজরুল ইসলামের নাম কিংবা তাঁর একটিও শ্যামাসঙ্গীত কি তাঁরা শোনেননি কখনও? তাঁরাকি জানেন না যে ধর্ম-নির্বিশেষে, বাঙালি শিশুর প্রথম আবৃত্তি বা গান পূজামণ্ডপ থেকেই মানুষের কাছে পৌঁছয়?
উত্তর মিলবে না। তাই, আবার জেনে নেওয়া জরুরি যে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির খুনের দায়ভার মাথা থেকে সরাবার জন্য পাকিস্তান নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছে বাংলাদেশকে সংস্কৃতির বদলে কৌম-পরিচয়ের ঘেরাটোপে আটকানোর। দু’হাজার একুশে, মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সিনেমা খেল খেল মে দেখলে স্পষ্ট হবে কেমন ভাবে ন্যারেটিভ বদলে এক অখণ্ড পাকিস্তানের ‘ধূসর স্বপ্ন’ হাওয়ায় ভাসানো হচ্ছে, ভারতকে ভিলেন বানিয়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অপসারিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রাক্তন সেনাকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন সরেজমিন তদন্তের পরে বলেছিলেন যে, নিহতদের অধিকাংশের দেহ থেকে যে বিশেষ ধরনের বুলেট মিলেছে, তা পুলিশ ব্যবহার করে না। কারা তবে সেই বুলেট ব্যবহার করে এত খুন করল? কারা রাজাকারদের ভৌতিক অবয়বে এত শক্তিসঞ্চার করছে যে ‘জয় বাংলা’র মতো পবিত্র শব্দবন্ধের থেকে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া যাচ্ছে?
মুনতাসীর মামুন লিখিত গণহত্যার ইতিহাসে পাই, পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী আল বদরদের হেডকোয়ার্টারে এক বস্তা ভর্তি মানুষের উৎপাটিত চোখ মিলেছিল, মুক্তিযুদ্ধের শেষে। পাকিস্তান আর তার সহযোগীরা, বাঙালির ‘দেখার চোখ’ উপড়ে নিতে চাইছে আবারও। এ বারের ডিসেম্বর তাই বিজয়ের নয়, সংগ্রামের মাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy