Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
আমরা ব্যক্তিগত হিসাবে এতই ব্যস্ত যে ভেসে যায় মানুষের কথা
Israel Palestine war

মৃতদের ভাগ না করি যেন

উত্তর পছন্দ হোক বা না হোক, মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে, এইটুকু ভেবে নিতে অসুবিধে নেই যে পৃথিবী কেবল জীবিতের নয়, মানুষ এখানে শ্রদ্ধা আর সম্মানে মৃতদেরও আপন করে নেয়। আলো দেখায়, ‘নাই বা তোমার থাকল প্রয়োজন’।

সমানুভূতি: গাজ়ার প্যালেস্টাইনিদের প্রতি সহমর্মিতায় দেওয়ালচিত্র, ডাবলিনে।

সমানুভূতি: গাজ়ার প্যালেস্টাইনিদের প্রতি সহমর্মিতায় দেওয়ালচিত্র, ডাবলিনে। রয়টার্স।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ০৪:৩২
Share: Save:

কলকাতায় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও গ্রামেগঞ্জে গোটা কার্তিক মাস জুড়ে আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর প্রথা এখনও আছে। ঘি আর কেউ দেয় না তবে তেল দিয়ে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে, সেই প্রদীপ একটা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখতে দেখা যায় আজও হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, বীরভূমের গ্রামে। বীরভূমের সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে ‘প্রদীপ’ নামের এক জন জলজ্যান্ত ব্যক্তিই আছেন যাঁর নাম আসলে অন্য। সেই দুর্ভাগা, কোনও এক আশ্বিনের সংক্রান্তিতে আকাশপ্রদীপ লাগাতে গিয়ে উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গিয়েছিলেন আর তার পর থেকে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটেন। শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি ওই নামটিও তিনি অর্জন করেছেন, নিজের দুর্ঘটনার সূত্রে।

কী এমন জরুরি ওই প্রদীপ লাগানো যে তার জন্য আজও এমন ঝুঁকি নেয় মানুষ? গ্রামের চা-দোকানে এই প্রশ্ন ভাসিয়ে দিলে পরে প্রায় কেউই ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রা ত্যাগের সময়কাল বা লক্ষ্মী-বিষ্ণুর যুগ্ম আরাধনার নিয়মকানুনের কথা তুলবেন না, তা সে শাস্ত্রে যা-ই লেখা থাকুক। শতকরা নিরানব্বই জন যা বলবেন তা হল, মহালয়ার দিন যে পূর্বপুরুষ এবং পূর্বনারীরা পৃথিবীতে নেমে আসেন উত্তরপ্রজন্মের হাতে জল পেতে, ওই আলো আবার তাঁদের আকাশের ঠিকানায় পৌঁছে যেতে সাহায্য করে। উত্তর পছন্দ হোক বা না হোক, মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে, এইটুকু ভেবে নিতে অসুবিধে নেই যে পৃথিবী কেবল জীবিতের নয়, মানুষ এখানে শ্রদ্ধা আর সম্মানে মৃতদেরও আপন করে নেয়। আলো দেখায়, ‘নাই বা তোমার থাকল প্রয়োজন’।

সেই আলোই কি জলের চেহারা নেয় প্রত্যেকটি মহালয়ায়, বাবুঘাট কিংবা কোনও পাড়ার পুকুরে? অজস্র মানুষ, যাঁরা অনেকেই নিজের-নিজের ঠাকুরদা-ঠাকুরমার নামও স্মরণ করতে পারেন না, কী অপরিসীম শ্রদ্ধায় ‘যথা নামো’ বলে হাতের তালু দিয়ে জল গড়িয়ে দেন আর সেই ধারা একটা অদেখা সেতু তৈরি করে অন্ধকার আর আলোর, মৃত্যু আর জীবনের। বস্তুত গোটা পিতৃপক্ষ জুড়েই তর্পণ করার প্রথা। তবু তা কমতে কমতে এক দিনে এসে দাঁড়ালেও সেই দিনটা ভাস্বরতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কারণ শত শত মৃত্যুর ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই নশ্বর জীবন, মৃতকে স্মরণ করার ভিতর দিয়ে অনন্ত জীবনানন্দে উচ্চারণ করে, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’। সেই থেকে-যাওয়া কেবল স্মৃতিতে নয়, উপলব্ধিতে; বাতাসে না পেলেও নিঃশ্বাসে পাওয়ায়। ব্রেইল যে ভাবে লিখিত পৃথিবীকে স্পষ্ট করে তোলে অন্ধের কাছে, মহাজাগতিক সে ভাবেই সত্য হয়ে ওঠে সে দিন। শুধু সে দিন কেন, শরৎকাল পেরিয়ে হেমন্তে এসে পৌঁছনোর জার্নিই হয়ে ওঠে, পুরুষ এবং প্রকৃতির দ্বৈততার বিপ্রতীপে, মৃত্যু এবং জীবনের সঙ্গমে তৈরি অদ্বৈত। সেই অদ্বৈতের আয়নাতেই আমরা দেখতে পাই সৃষ্টি এবং লয়ের বিপরীত ক্রম। অনুভব করি, শরীর লীন হয় অন্নে, অন্ন লীন হয় বীজে, বীজ পৃথিবীতে। আর এ ভাবেই, বায়ু স্পর্শে, স্পর্শ আকাশে, এবং আকাশ শব্দে লীন হয়।

সেই শব্দই আকাশ জুড়ে বাজে, যখন, আত্মীয়-পরিজনের বাইরে, ‘অগ্নিদগ্ধাশ্চ যে জীবাঃ’ মন্ত্রের মাধ্যমে অপরিচিত, অপঘাতে মৃতের আত্মাকেও নিবেদন করা হয় জল। ওই একটু যব, একটু তিল আর জল দানের ভিতর দিয়েই রচিত হয় সেই কাব্য যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের শত্রুতা মৃত্যুতে ফুরিয়ে গেলেও, ভালবাসা ফুরোয় না। মনে পড়ে যায় মিলান কুন্দেরার সেই অবিস্মরণীয় আখ্যান, যেখানে কয়েক বছর পর স্বামীর কবরের সামনে এসে স্ত্রী আবিষ্কার করেন যে সেই কবরে, কালের নিয়মে, অন্য মানুষকে সমাধিস্থ করা হয়ে গেছে। সেই সত্য জানার পর থেকে এক অব্যক্ত বেদনা স্ত্রীর মনে পাক খেতে থাকে। প্রশ্ন জাগে, জীবিত যে আর নেই, মৃত হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকারও কেন কেড়ে নেওয়া হল তাঁর থেকে?

বিগত প্রায় দু’মাস ধরে যে খবর আছড়ে পড়ছে প্রতি মুহূর্তে, তাতে এই প্রশ্ন আর কোনও ব্যক্তির নয় শুধু, সমষ্টির। হবে না কেন? সঙ্গীত মেলায় অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণী কিংবা হলোকস্ট থেকে বেঁচে ফেরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নির্বিচারে খুন করা হয়েছে, আমরা দেখেছি। আবার হাজারো শিশু আর নারীর জীবনের তোয়াক্কা না করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হাসপাতাল, স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার; আমরা দেখছি। দেখতে দেখতে টের পাচ্ছি যে ‘অমানবিকতা’ শব্দটাই বড় খেলো, কারণ মানুষ যা করতে পারে কোনও পাশবিকতা তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারবে না। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা তো এক পাল চিতাবাঘ বা পাইথনরা ফেলেনি।

আজ যে আমেরিকা সর্বশক্তিমান হিসেবে স্বীকৃত, তার আবিষ্কারক হিসেবে মাল্যচন্দনে ভূষিত কলম্বাস এমনই নিষ্ঠুর এক ব্যক্তি ছিলেন যে তাঁর প্রশংসায় দরাজ ঐতিহাসিক স্যামুয়েল এলিয়ট মরিসন পর্যন্ত লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে কলম্বাস আর তাঁর অনুগামীদের নিষ্ঠুরতার পরিণাম হয়েছিল সম্পূর্ণ ‘জেনোসাইড’। অবশ্য কলম্বাসের চাইতে বড় মাপে মেক্সিকোর অ্যাজ়টেকদের গণহত্যা সংগঠিত করেছিলেন কোর্তেস, পেরুর ইনকাদের উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন করেছিলেন পিজ়ারো, ভার্জিনিয়া আর ম্যাসাচুসেটসের পাউহাটানস আর পিকটস’দের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা। এই ধারা যদি জিনে প্রবাহিত হয় তবে গাজ়াকে এক জীবন্ত কবরস্থানে পরিণত করার ইজ়রায়েলি নৃশংসতাকে আমেরিকা এবং ব্রিটেন মদত দেবেই। মদত দিতে দিতে, হামাসের সন্ত্রাসী নেতারা যে কাতারে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন, সেখানেও প্রমোদতরী ভাসাবেন। আর ও দিকে মৃতদের প্রতি সামান্য সম্মান না জানিয়ে পাশ্চাত্যের টেলিভিশনে মুখোমুখি বসে দুই পক্ষ নির্লজ্জ কাজিয়া করবে। এক জন ফোন তুলে দেখাতে চাইবে মৃত কোনও ইজ়রায়েলি নারীর শরীর ঘিরে কিছু পিশাচের নির্লজ্জ উল্লাস; অন্য জন এক বা একাধিক রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন প্যালেস্টাইনির লাশ দেখিয়ে ওই আগের পৈশাচিকতার পক্ষে যুক্তি খাড়া করবে। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, “বড় বেশি দেখা হল ধর্মত যা দেখা অপরাধ।” আমরা আজ অপরাধী হয়তো কারণ আমরা দেখছি কী ভাবে, সব ইহুদিদের আগ্রাসনকারী হিসাবে চিহ্নিত করে, “গ্যাস দ্য জ্যুস, কিল দ্য জ্যুস” ধ্বনি উঠছে, হিটলারি ঢঙে। আবার দেখছি, সমস্ত প্যালেস্টাইনিকে জঙ্গি হিসাবে চিহ্নিত করে তাঁদের শৌচালয় ব্যবহার করার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে দান্তের ইনফার্নো-র থেকেও কঠোর এক নরকাগ্নিতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আমরা এ-ও দেখছি যে এই হত্যালীলা বন্ধ করতে আমেরিকা, রাশিয়া বা চিন কেউ তাঁদের বিপুল ভূখণ্ডের কিয়দংশে ইজ়রায়েলকে খানিক জমি দিয়ে প্যালেস্টাইনের জমি দখল করার থেকে বিরত করছে না। আর এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে, আমরা মরতে দেখছি মানুষকে। আর মরে যাওয়ার পর, তাঁরা কোন বৃত্তের, তাই নিয়ে তরজাও দেখছি।

অন্তত মৃতদের যে এ ভাবে ভাগ করা যায় না, মৃত্যুর পর স্মরণে-মননে তাঁদের যে অবস্থান তাকে কলুষিত করা যায় না এমন করে, সেই কথা কোনও রাষ্ট্রনায়ক এক বার বলবেন না? বলবে না, পৃথিবীর মানুষ, সমবেত হয়ে? না কি আমরা সবাই ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে এত ব্যস্ত যে ইউক্রেনের উপর নৃশংস আক্রমণ নামিয়ে আনা রাশিয়ার থেকে সস্তায় পেট্রল কেনা নিয়েও উল্লসিত? তেলের দাম বাড়লে কেবল ধনীদের অসুবিধে হয় না, গরিবদের অসুবিধে হয় দশ গুণ। আনাজ আর মাছের দাম নাগালের বাইরে চলে যায়। কিন্তু সেটা মাথায় রেখেও আমরা এই অভ্যাসের দাস হতে পারি না যে, তুমি খুনি হলেও তোমার সঙ্গে বাণিজ্য করব, যদি লাভ হয়। জীবনের সুতো লাভ-লোকসানের সঙ্গে বাঁধা থাকে না, অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের দোলনায় তা দোলে। তাই আড়াই হাজার বছর আগে সোফোক্লিসের আন্তিগোনে, ক্রেয়ন রাজার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের ভাইকে সমাধিস্থ করার যুদ্ধে নামে কারণ মাটির তলায় শয্যা পাওয়া, এক জন মৃতের অধিকার। আর একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী, রঞ্জনের হত্যাকারী রাজাকে জানিয়েছিল, “মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।”

যে পৃথিবীতে জল, মাটি, আকাশ সব ভাগ হয়ে গেছে, সেই পৃথিবীতে আমরা যেন মৃতদের ভাগ করার দুঃসাহস না দেখাই। আন্তিগোনে বা নন্দিনীর স্পর্ধার স্পর্শে, আমাদের চৈতন্য হোক।

অন্য বিষয়গুলি:

israel gaza palestine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy