এই কোভিড অতিমারি আমাদের এক নিদারুণ কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সত্যটি হল আর্থিক অসাম্যের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। অসাম্য তো আগেও ছিল, বেড়েও যাচ্ছিল গত তিন দশকে— এ দেশে, এবং বিদেশেও। কিন্তু বর্তমান অসাম্যের প্রকৃতি আগের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং অভূতপূর্ব। তবে একদম নতুন হয়তো বলা যায় না। এমন অসাম্যের বাড়াবাড়ি সাধারণত ঘটে থাকে কোনও দুর্যোগের সময়েই, যেমন দুর্ভিক্ষে, বা রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল হয়ে পড়লে। অর্থাৎ, যখন এক ধাক্কায় বহু মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে, এবং রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় কাজটি করে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এটি প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই অনিবার্য। পরে আসছি সে কথায়। আগে বুঝে নেওয়া যাক, কেন বলছি এই অসাম্য অন্য রকম।
সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, বিগত ২০২০-২১ অর্থবর্ষে জাতীয় আয়ের সঙ্কোচন হয়েছে ৭.৩ শতাংশ। কিছুকাল আগে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, চলতি বছরে (অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবর্ষে) জাতীয় আয় ৯.৫ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা। এ দিকে দিনকয়েক আগে বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছে যে, তাদের অনুমান, এ বছরে ভারতের জাতীয় আয় বাড়বে ৮.৩ শতাংশ, যা রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমান থেকে বেশ কিছুটা কম। তবু ৭.৩ শতাংশ সঙ্কোচনের পরের বছরেই ৮.৩ শতাংশ বৃদ্ধির পূর্বাভাস থেকে স্বাভাবিক ভাবে মনে হতেই পারে যে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আর সরকারি ধারাভাষ্যও এই সম্ভাব্য পুনরুত্থান ঘিরে যে আশাবাদ পরিবেশন করে চলেছে, তার নীচে চাপা পড়ে গিয়েছে চরম আর্থিক অসাম্যের আখ্যানটি।
জাতীয় আয়কে সব ভারতবাসীর আয়ের যোগফল হিসেবে দেখলে অসাম্যের অঙ্কটা স্পষ্ট হয়। ধরা যাক, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে জাতীয় আয় ছিল ১০০ টাকা। সেখান থেকে পরের বছর ৭.৩ শতাংশ কমে হল ৯২ টাকা ৭০ পয়সা। এ বছর সেখান থেকে যদি তা ৮.৩ শতাংশ বাড়ে, জাতীয় আয় হবে ১০০ টাকা ৪০ পয়সা। অর্থাৎ, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে জাতীয় আয় যা ছিল, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে প্রায় তা-ই থাকবে। এর মধ্যে দু’বছর কেটে যাবে। যে হেতু মুকেশ অম্বানী থেকে সরকারি বেতনভুক আধিকারিক-শিক্ষক-অধ্যাপক, এমন অনেকেরই আয় বেড়েছে এবং বাড়বে এই দু’বছরে, তা হলে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, বহু মানুষের আয় কমেছে এবং কমবে— কারণ, সবার আয়ের যোগফলটা যে মোটামুটি একই থাকছে। কেকের মাপ বাড়ল না, অথচ আপনার টুকরোটি বড় হল, তা হলে নিশ্চিত ভাবেই অন্য কারও টুকরো ছোট হবেই। একেই বলে ‘জ়িরো-সাম’।
আয়ের এই অদ্ভুত নির্মম পুনর্বণ্টন ঘটে চলা, যা ঘটছে বহু মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং অল্প কিছু মানুষের আয় ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে, এটাই নতুন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন অসাম্য অভূতপূর্ব, অন্তত যখন থেকে ভারতীয় অর্থনীতি বৃদ্ধির মুখ দেখছে। আর ক্রমবর্ধমান আয় পকেটে আসা সেই ভাগ্যবানদের সৌভাগ্যের বহরও ধাক্কা দেওয়ার মতো। গত বছর সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের জমার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৮৩ শতাংশ! এক অতি মহার্ঘ জার্মান গাড়ি নির্মাতা সংস্থা সম্প্রতি নতুন এক এসইউভি মডেল ভারতের বাজারে আনে। ভেবেছিল গোটা বছরে খান পঞ্চাশেক বিক্রি করবে। দেখা গেল এক মাসের মধ্যেই পঞ্চাশটি বিক্রি হয়ে গেল। প্রতিটি গাড়ির দাম চার লক্ষ ডলার, ভারতীয় টাকায় তিন কোটির সামান্য কম।
যখন বৃদ্ধির ছিল সুসময়, তখন পাঁচ, সাত, বা কখনও আট শতাংশ বেড়েছে অর্থনীতি। তখন কি তা হলে সকলেরই আয় বাড়ছিল? বাড়ছিল কমবেশি অনেকের, সকলের নয় অবশ্যই। আর অসাম্যও বাড়ছিল, কারণ মধ্য-উচ্চ বা অতি-উচ্চ শ্রেণির আয় যে হারে বাড়ছিল, নীচের দিকে ততটা বাড়ছিল না। অসাম্যের প্রচলিত সূচক অনুসারে যদি দেখা যায় যে অসাম্য বেড়েছে, তা হলে বুঝতে হবে— উচ্চবিত্তের আয় যে হারে বেড়েছে, নিম্নবিত্তের বেড়েছে তার কম হারে। তা হলে অসাম্য বাড়লেও দারিদ্রের হার ধারাবাহিক ভাবে কমার কথা। কিন্তু অনেকের মনে আছে হয়তো, ২০১৭-১৮-র ‘ফাঁস’ হয়ে যাওয়া জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ফলাফল দারিদ্র হ্রাস নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। তবে গত বছরের হিসেব সব উল্টেপাল্টে দিয়েছে। সে বছরে মহার্বুদপতিদের (মনে পড়ে ‘ধারাপাত’-এর কোটি, অর্বুদ, মহার্বুদ?) আয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ, আর জাতীয় আয় কমেছে ৭.৩ শতাংশ। সমীক্ষাকারী সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি-র সাম্প্রতিক সমীক্ষাতেও দেখা যাচ্ছে যে, ২০২০-র জানুয়ারিতে ভারতীয়দের গড় আয় যা ছিল, এ বছরের জানুয়ারিতে গড় আয় তার থেকে কম। এ বার হয়তো পাঠক আন্দাজ করতে পারছেন অসাম্যের গভীরতাটি। এর জন্যে কি অতিমারিকেই পুরোপুরি দায়ী করা যায়? অতিমারি আসলে যা করছে, তা হল সমাজ-অর্থনীতির অন্তঃস্থলে যে অসাম্যের বসত, তাকেই আরও গভীর ও তীব্র করে দেওয়া। তাই চলতি বছরের জাতীয় উৎপাদনের পুনরুত্থান বাস্তবায়িত হলেও এই অসাম্যকে সামান্যই কমাতে পারবে যদি না বৈপ্লবিক পুনর্বণ্টনের কোনও নীতি গ্রহণ করা হয়।
সরকারি ভাষ্যে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা বোঝাতে ঘুরেফিরে ইংরেজি বর্ণমালার ‘ভি’ অক্ষরটি দেখা যাচ্ছে ইদানীং। ‘ভি’-র প্রথম বাহুটি ইঙ্গিত করছে পতন, আর দ্বিতীয়টি দ্রুত উত্থান। পতন শেষ হতেই উত্থান, তাই ‘ভি’-আকৃতি। ফেব্রুয়ারিতে যখন সরকারি ‘আর্থিক সমীক্ষা’ প্রকাশ পেল, সেখানেও দেখা গেল ছত্রে ছত্রে ভি-রূপ পুনরুত্থান সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বাস। কিন্তু কোভিডের এই দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর সে সম্ভাবনা যে খানিক ধাক্কা খেয়েছে, সরকারের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টার কথায় তার বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি নেই। তিনি আগের মতোই প্রত্যয়ী। বলে চলেছেন অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের কোনও প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে না, যে হেতু এ বারের লকডাউন আগের মতো সার্বিক এবং কঠোর হয়নি। তাঁর প্রত্যয়ের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক যে ক্ষীণ, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হিসেবে এই দ্বিতীয় পর্যায়ে অতিমারির তীব্রতা স্পষ্টতই অনেক বেশি। আক্রান্তদের চিকিৎসা বাবদ ব্যক্তিগত বা পারিবারিক খরচ এ বার লাগামছাড়া। অনেক পরিবারই শুধু চিকিৎসার খরচ কিংবা একমাত্র রোজগেরে মানুষকে হারিয়ে দারিদ্রসীমার নীচে চলে গিয়েছে। তা ছাড়া নতুন করে কাজ হারানো তো আছেই।
অসাম্যের কথা ভাবতেই যেখানে নীতিনির্ধারকরা রাজি নন, সেখানে কী করতে হবে বলতে যাওয়া অর্থহীন। বলছেন তো অনেকেই। আয়কর কিংবা সম্পত্তিকর বাড়ানোর কথা উঠেছে আগেই। বার বার বলার প্রয়োজন আছে। আশ্চর্যের কথা, সম্প্রতি কিছু রাজ্য থেকে জোরালো দাবি এলেও সরকার স্বাস্থ্যবিষয়ক অত্যাবশ্যক পণ্যেও জিএসটি শূন্যে নামিয়ে আনতে রাজি নয়। এখানে বলা প্রয়োজন, আয়কর বা সম্পত্তিকর না বাড়িয়ে শুধু বিক্রয় করের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতারও একটি অবাঞ্ছিত পরিণতি আছে। অসাম্য বেড়ে যায়। প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থায় বেশি আয়ের মালিককে আনুপাতিক ভাবে বেশি কর দিতে হয়। কম আয়ে যদি দিতে হয় আয়ের দশ শতাংশ, বেশি আয়ে দিতে হয় ত্রিশ শতাংশ। মাস-মাইনের চাকরি করেন যাঁরা, তাঁদের এই হারে করটুকু দিতেই হয়। কিন্তু কর্পোরেট জগতের কেষ্টবিষ্টুদের জন্যে অনেক রকমের ছাড়ের ব্যবস্থা থাকে, ফলে তাঁদের ওই ত্রিশ শতাংশেরও অনেকটা কম দিলেই হয়। কিন্তু বিক্রয় কর ধনী দরিদ্র প্রভেদ করে না। দাঁতের মাজনের উপর অম্বানী বা আদানি যতটা কর দেবেন, দরিদ্রতম মানুষটিও ততটাই দেবেন। তাই আয়কর বাবদ সংগ্রহ কমে বিক্রয়কর থেকে সংগ্রহ বাড়লে আর্থিক অসাম্য বাড়ে।
অর্থনীতিতে যাকে বলে ‘ডাউনসাইড রিস্ক’, তা থেকে সুরক্ষার জন্যে সভ্য সমাজে ভাবনাচিন্তার রেওয়াজ আছে। আচম্বিতে জীবনধারণের সম্বলটুকু হারানোর চেয়ে বড় বিপর্যয় বোধ হয় আধুনিক মানবজীবনে আর কিছু নেই। অতিমারি-কালে অধিকাংশ ভারতীয়ের এই পতন-ঝুঁকির বিপরীতে দেখছি কতিপয় মানুষের বিত্তের অস্বাভাবিক স্ফীতি। এই নিয়ে সরকারি ভাষ্যে এ পর্যন্ত সামান্য ভাবনারও ইঙ্গিত নেই। তাই আশঙ্কা হয়, অর্থনীতির পুনরুত্থান কোনও এক সময়ে বাস্তবায়িত হলেও এই অসাম্যের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজনটুকু আমাদের নীতিনির্ধারকরা দেখাবেন না।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy