১৬ সেপ্টেম্বর চলে গেল, রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা ১৯৯৪ সালে এ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক ওজ়োন স্তর সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। দিনটির গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা অনেকেই ওয়াকিবহাল নই। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবীতে জীবন সুরক্ষিত থাকার জন্য ওজ়োন স্তরের অপার গুরুত্বের কথা।
ওজ়োন একটি সক্রিয় গ্যাস অণু, তিনটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত। স্কুলে সকলেই পড়েছি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের কথা। বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। পৃথিবীর মাটি থেকে ঠিক উপরের প্রথম স্তরটি ট্রোপোস্ফিয়ার, তার উপরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, ভূস্তর থেকে যা ৫০-৬০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের একটু নীচের অংশ, যা পৃথিবীর তল থেকে আনুমানিক ১৫-৩৫ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত, তা-ই প্রধানত ওজ়োন গ্যাসের স্তর। ওজ়োন স্তরের সুরক্ষা আমাদের মাথার উপরে না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকতে পারত না। ওজ়োন স্তরের এই পর্দা ৯৭-৯৯ শতাংশ অতিবেগুনি রশ্মি (ইউ-ভি) শোষণে সক্ষম। সূর্যের এই রশ্মি পৃথিবীর ভূস্তর, আবহাওয়া ও জল স্তরে যে কোনও ধরনের প্রাণের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক। তা যত বেশি পৃথিবীর ভূস্তরে পৌঁছবে, ক্ষতি তত বেশি। মানুষের ক্ষেত্রে চামড়ার ক্যানসার, চোখ নষ্ট হওয়া ছাড়াও এর প্রভাব পড়ে উদ্ভিদ, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণী-জীবনেও।
ওজ়োন স্তর যে সূর্যের মিডিয়াম ফ্রিকোয়েন্সির অতিবেগুনি রশ্মির ৯৭-৯৯ শতাংশ শোষণ করে, তা আবিষ্কার করেন দু’জন ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী, ১৯১৩ সালে। আর কী ভাবে বায়ুমণ্ডলের ওজ়োন স্তরের পর্দার আড়াল নষ্ট হয়ে যায় ও তার ফলে ক্ষতিকারক ইউ-ভি রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারে, সেই সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রথম প্রকাশিত হয় বিখ্যাত নেচার জার্নালে, ১৯৭৪-এর জুনে। মারিয়ো জে মলিনা এবং শেরউড রোল্যান্ড, দুই রসায়নবিদের মাত্র তিন পাতার সেই গবেষণাপত্র পৃথিবীতে আনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাঁরা উল্লেখ করেন, ওজ়োন স্তরে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি), যার ফলে এই স্তরের ওজ়োন গ্যাস নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। উল্লেখ্য, সে সময় ‘সিএফসি’-কে ধরা হত বিরাট উপযোগী এক গ্যাসীয় পদার্থ হিসেবেই। স্বভাবতই বিভিন্ন মহলে হইহই পড়ে গেল, নড়েচড়ে বসলেন পরিবেশবিজ্ঞানী থেকে রাজনীতিক, পরিকল্পনাবিদ, সিএফসি ও আনুষঙ্গিক উৎপাদন সংস্থাকারীদের সকলেই। বিতর্কও উঠল তুঙ্গে।
মলিনা ও রোল্যান্ড বিষয়টির বিপুল গুরুত্বের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন, তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল শুধু বিজ্ঞানগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। তাঁরা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র ও জীবন সুরক্ষার কথা, নীতি-নিয়ামকদের কাছে তুলে ধরেছিলেন বারংবার। প্রচারমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তাঁরা, বিভিন্ন সম্মেলনে পেশ করেন তাঁদের বক্তব্য, পাশাপাশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আইনজীবীদেরও।
দুই বিজ্ঞানী আশঙ্কা করেছিলেন, বাধা আসবে। হলও তাই। রাসায়নিক প্রস্তুতকারী নামজাদা শিল্প সংস্থাগুলির কাছ থেকে সাংঘাতিক বাধার সম্মুখীন হন তাঁরা। সিএফসি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি বিজ্ঞানজগতের কিছু মানুষকেও কৌশলে হাত করে, যাতে তাঁরা মলিনাদের গবেষণার ফলাফলে অনাস্থা প্রকাশ করেন। বিজ্ঞানীদের একটি অংশ তা-ই করলেন। মলিনা ও রোল্যান্ড সব কিছুর মুখোমুখি হয়ে মোকাবিলা করেছেন। স্রেফ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেই তাঁদের কাজ শেষ, এমন কথা ভাবলে কিছুই হত না। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য করণীয় যা যা, তাঁরা তা-ই করেছেন। তাঁদের গবেষণার সূত্রেই শুরু হয় রসায়নের এক নতুন বিভাগ—‘অ্যাটমোস্ফেরিক কেমিস্ট্রি’।
এর পরে আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণা মলিনা ও রোল্যান্ডের কাজকে সমর্থন করল। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নীতি নির্ধারকরাও একজোট হলেন, ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত হল ‘মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল: আ গ্লোবাল রেসপন্স টু এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইসিস’। আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা চলল, ওজ়োন স্তর সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে সমর্থন জানালেন সকলে। মানুষের তৈরি করা রাসায়নিক ওজ়োন স্তরের আচ্ছাদন নষ্ট করে দিয়েছে ধাপে ধাপে, তা মেরামত করার ব্যাপারে সচেষ্ট হলেন তাঁরা। সতর্ক থাকার ব্যাপারে পদক্ষেপ করলেন, যাতে ভবিষ্যতে একই ভুল আর না হয়।
মলিনা ও রোল্যান্ডের যুগান্তকারী আবিষ্কারের আন্তর্জাতিক মহলে দৃষ্টি আকর্ষণ, সেই সঙ্গে ‘মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল’-এর মতো প্রচেষ্টায় ওজ়োন বিনষ্টকারী রাসায়নিকের ব্যবহার পঁচিশ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে ৯৮ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মত, ২০৭৫ সালের মধ্যে ওজ়োন স্তরের ক্ষয় সম্পূর্ণ মেরামত করা সম্ভব হবে।
১৯৯৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন মলিনা আর রোল্যান্ড। আর এক অ্যাটমোস্ফেরিক কেমিস্ট, পল জে ক্রুটজ়েনও অংশীদার হয়েছিলেন সেই পুরস্কারের। পৃথিবীর ‘উন্নততম প্রাণী’ হিসেবে আমাদের গ্রহটি পূর্বজদের কাছ থেকে পাওয়া মনে করে, সভ্যতার নামে যথেচ্ছ ধ্বংস করে চলেছি আমরা। সে বিষয়ে সজাগ সচেতন থাকা দরকার বছরভর— ১৬ সেপ্টেম্বর দিনটি তা মনে করিয়ে দেয় নিয়ম করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy