ফাইল চিত্র।
ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজ়, ২০০১। টানা ১৫টা টেস্ট ম্যাচ জিতে ভারতে এসেছে স্টিভ ওয়-র অস্ট্রেলিয়া। মুম্বইয়ের প্রথম টেস্টে ভারত হারল। ইডেনে ঐতিহাসিক টেস্টের শুরুতে অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় একটা অভাবনীয় কাণ্ড করলেন। টসের সময় স্টিভকে মাঠের মাঝখানে দীর্ঘ ক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখলেন। স্টিভ খেপে গিয়ে বলেছিলেন, সৌরভ ভদ্রতা, শিষ্টাচার জানেন না। কিন্তু তত ক্ষণে আসল খেলা শেষ। অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়া টিমের ক্যাপ্টেনকে কী ভাবে সকলের সামনে হেয় করে, পাল্টা স্নায়ুর চাপ তৈরি করা যায়, তা সৌরভের জানা হয়ে গিয়েছে। ওই এক চালেই অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে জুজুর ভয় নিমেষে ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গিয়েছিল।
বিশ বছর পরে দেশের রাজনীতির মাঠেও সেই ছবি। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সুউচ্চ ব্যক্তিত্বের সামনে কুঁকড়ে থাকা বিরোধী শিবির খোলস ছেড়ে বেরোতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রমাণিত, মোদী-শাহ অপ্রতিরোধ্য নন। এ বার বিরোধী শিবিরের মুখ্যমন্ত্রীরা মোদীকে ব্যক্তিগত স্তরে তাচ্ছিল্য করে, তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে খাটো করার চেষ্টা শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন বললেন, মোদীজি শুধুই ‘মন কি বাত’ করলেন। অন্য দিকের কথা শুনলেন না। প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক থেকে দিল্লির অরবিন্দ কেজরীবাল নিজের বক্তব্য সরাসরি টিভি-তে সম্প্রচার করে ফেললেন। তার পর কলাইকুন্ডায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে অপেক্ষা করিয়ে রাখলেন। একেবারে সৌরভের কায়দাতেই।
আপাত ভাবে তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আসলে একই রাজনৈতিক কৌশলের সূত্রে বাঁধা। ভোটে জিততে মোদী নিজেকে বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিরোধীদের কৌশল, তাঁর সেই রাজনৈতিক উচ্চতা ছেঁটে ফেলা। এতে প্রধানমন্ত্রী পদের সম্মানহানি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিরোধীদের পাখির চোখ— প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তিটির ভাবমূর্তি। ‘ইমেজ’।
কলাইকুন্ডার ঘটনা একেবারে ইডেনের টস-কেলেঙ্কারির ‘রিমেক’। প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁকে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে ঢুকেই বেরিয়ে যান। দু’দিক থেকেই নানা যুক্তি, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। স্টিভকে দাঁড় করিয়ে রাখার পরে যেমন সৌরভের যুক্তি ছিল, তিনি না কি ড্রেসিংরুমে ব্লেজ়ার খুঁজছিলেন! কলাইকুন্ডায় আসলে যা-ই হয়ে থাক, মোদী সরকারের যে স্টিভের মতোই আঁতে ঘা লেগেছে, তা স্পষ্ট। প্রথমে মুখ্যসচিবকে দিল্লিতে বদলির নির্দেশ, লাভ না হওয়ায় আরও কড়া আইন প্রয়োগের চেষ্টা— সবেতেই দাঁত কিড়মিড়ের শব্দ। যুক্তি, নিয়মের বালাই নেই।
২০১৯-এর আগে রাহুল গাঁধী ঠিক এই চেষ্টাই করেছিলেন। রাহুল যখন রাফাল-চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিতে দুর্নীতির কালি ছেটাতে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ বলছেন, তখন কংগ্রেসের বৃদ্ধতন্ত্র দ্বিধায় পড়েছিল। নরেন্দ্র মোদীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করাটা কি ঠিক হচ্ছে! রাহুল বলেছিলেন, তিনি মোদীর ওই ‘ইমেজ’-টা ছিঁড়ে ফেলতে যান। কিন্তু পারেননি। লোকসভার ভিতরেও এক বার প্রধানমন্ত্রীকে হতভম্ব করে, তাঁকে আচমকা আলিঙ্গনে রাহুলের একই চেষ্টা ছিল। সেই ‘গাঁধীগিরি’র ‘ঝাপ্পি’-ও কাজে দেয়নি। মোদীর ‘দিদি’ ওই সব গাঁধীগিরির পথে হাঁটতে নারাজ। তিনি স্রেফ ‘দাদাগিরি’-তে বিশ্বাসী।
সৌরভ যেমন স্টিভের উপরে তাঁরই তৈরি করা বিরোধীদের উপর চাপ তৈরির কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন, বিরোধীরাও এখন মোদীর বিরুদ্ধে তাঁরই ওষুধ প্রয়োগ করছেন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী যখন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরছেন, তখন ঠিক এই পথই নিতেন। মনমোহন সিংহকে হেয় করা। ২০১২-র জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠক। দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপরেখা চূড়ান্ত হবে। আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ না ৮.৫ শতাংশ রাখা হবে, তা নিয়েই চুলচেরা বিচার। সাংবাদিকদের সামনে মনমোহনকে তাচ্ছিল্য করে মোদী বললেন, মাত্র আধ শতাংশের জন্য এত আয়োজন!
এখানেই থামেননি মোদী। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়েছিল, ততই মোদী মনমোহনকে ‘মৌনমোহন’ বলতে শুরু করেন। পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বৃদ্ধির দিকে আঙুল তুলে মনমোহনের অর্থনীতির প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মনমোহন সনিয়া গাঁধীর কথায় ওঠেন-বসেন, তাঁকে মন্ত্রীদের দুর্নীতি দেখেও চুপ করে থাকতে হয়— যাবতীয় ‘স্লেজিং’-এর লক্ষ্য ছিল দশ বছর প্রধানমন্ত্রীর গদিতে থাকা মনমোহনকে দুর্বল প্রমাণ করা।
এখন দাবার ছক উল্টে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর সামনেই এখন নিজের ভাবমূর্তি বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ। উল্টো দিকে, বিরোধীদের একটাই লক্ষ্য: নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিতে ঘা দিয়ে যাওয়া। কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে বিরোধীরা এখন সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। রাহুল গাঁধী আগেভাগেই বলে দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি ভেঙে পড়েছে। তাঁর তুলনায় অনেক বেশি পোড় খাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, এই ভাবমূর্তি ভেঙে ফেলা এত সহজ নয়। তাই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
এত দিন কেন্দ্রে ও রাজ্যে আলাদা সরকার থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মেনে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে রাজনৈতিক সৌজন্য বজায় থাকত। এখন সেই সৌজন্যের গণ্ডিও ভাঙছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসা হেমন্ত সোরেনের কটাক্ষ তারই প্রমাণ। মোদীও প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এত দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে শুধুমাত্র মোদীর বক্তৃতা সম্প্রচার হত। কেজরীবাল নিজের বক্তৃতা সম্প্রচার করায় মোদী তাঁকে প্রোটোকল ভাঙতে নিষেধ করেছেন। প্যাঁচে পড়ে সেই বৈঠকে নিজের বক্তৃতাও সম্প্রচার করতে পারেননি। কেজরীবাল সে দিন দুঃখপ্রকাশ করেছেন। পরের বৈঠকে ফের মোদীর বক্তৃতা সম্প্রচার হতেই প্রশ্ন তুলেছেন, এ বেলা প্রোটোকল কোথায় গেল!
বিজেপি নেতারা জানেন, তাঁদের সঙ্গে কংগ্রেস বা বিরোধী শিবিরের মধ্যে এক জনই ফারাক গড়ে দেন। নরেন্দ্র মোদী। তাই মোদীর ভাবমূর্তিতে ঘা পড়তেই বিজেপি শিবির ‘গেল, গেল’ রব তুলে বলছে, দেশের ভাবমূর্তিতে কালি ছেটানোর চেষ্টা হচ্ছে। সাত বছরে এই প্রথম নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার গ্রাফ নিম্নমুখী। আস্থায় ঘাটতির দুশ্চিন্তা।
বিজেপির একমাত্র আশা, ছত্রভঙ্গ বিরোধী শিবির। ভাবমূর্তিতে কালি ছেটানোর এই খেলায় বিরোধী শিবিরের মুখ্যমন্ত্রীরা এককাট্টা হচ্ছেন। সকলের জন্য টিকার দাবিতেও বিরোধীরা জোট বেঁধেছিল। সেই জোট ভাঙতেই প্রধানমন্ত্রী দেরিতে হলেও, অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগে বিনামূল্যে টিকার ঘোষণা করেছেন। কিন্তু টিকার জোগান বা অর্থনীতির মন্দ দশার উন্নতি সহজে হবে না। বিরোধীদের তিরেরও অভাব হবে না।
অনেক পরে সৌরভ বলেছিলেন, প্রথম বার তিনি সত্যিই টসে যাওয়ার আগে ব্লেজ়ার ফেলে এসেছিলেন। কিন্তু অপেক্ষা করতে হয়েছে বলে স্টিভকে গজগজ করতে দেখে, বার বারই টসে দেরি করতে থাকেন। এখন বিরোধী শিবিরও একই মজা পেয়ে গিয়েছে। তাঁদের খোঁচায় প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্টতই ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীদের দাবি মেনে তিনি নিজের টিকা নীতি পাল্টাচ্ছেন বলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করছেন। কে, কত দিন এই স্নায়ুর চাপ ধরে রাখতে পারেন, এখন তারই পরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy