ওই চলেছেন তিনি। পাশাপাশি হাঁটছে তাঁর বয়স। হাঁটছে নীরব ক্রিকেটীয় বিবৃতি। ফাইল ছবি
ওই চলেছেন তিনি। এক আনখশির পেশাদার। গোটা টিম উইকেটের উপর ট্রফি-জয়ের হিল্লোল তুলছে। তিনি খানিক সরে দাঁড়ালেন সেই হুল্লোড় থেকে। আপাত-নির্লিপ্ত ভাবে গাঢ় সবুজ চামড়ার কিপিং গ্লাভসটা খুলে হাতে নিলেন। সে দিনের মতো অফিস হয়ে গিয়েছে। এর পর তিনি আবার ঢুকে পড়বেন নিজস্ব বুদ্বুদে। মাঠ ছাড়ার আগে ইনার গ্লাভস-পরা বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলটা তুলে গলায় জল ঢালার মুদ্রায় সতীর্থদের দেখালেন, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। তার পর ধীর পদক্ষেপে রওনা দিলেন প্যাভিলিয়নের দিকে।
ওই চলেছেন তিনি। চলেছে চল্লিশ বছরের আপাত-ধ্বস্ত এক শরীর। সুঠাম দেহে লেপ্টে আছে ঘামে জ্যাবজ্যাবে হলুদ জার্সি। টুপির তলায় কপাল থেকে চুঁইয়ে পড়ছে সাফল্যের স্বেদবিন্দু। বাউন্ডারির দড়ির সামনে অপেক্ষা করছে অভিনন্দনের জন্য বাড়ানো সারি সারি হাত। অপেক্ষা করছেন বিপক্ষের অধিনায়ক, কোচ। তাঁর নামে জয়ধ্বনি উঠছে গ্যালারি থেকে। মরুশহরের স্টেডিয়ামে হলদে রংয়ের ঝিলমিল লেগে গিয়েছে।
ওই চলেছেন তিনি। পাশাপাশি হাঁটছে তাঁর বয়স। হাঁটছে নীরব ক্রিকেটীয় বিবৃতি। তুঙ্গ স্নায়বিক চাপ জীবন থেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে যৌবনকে। মাথার দু’পাশে সাদা কদমফুলের মতো বিন্দু বিন্দু পাকা চুল। ক্লিপার দিয়ে আর কত যত্ন করা যায়! উপরের চুলগুলোর কালো রং পাশের সেই বুড়োটে পক্বকেশকে আরও বেশি বেশি করে বিজ্ঞাপিত করছে। থুতনির কাছে ছুঁচলো হয়ে আসা দাড়িতে কৃত্রিম কালো রংয়ের গোড়ায় জন্মেছে গত কয়েকদিনে গজানো গুঁড়ো গুঁড়ো সাদা দাড়ি। বিজবিজ করছে। চোখের তলায় কালি। বিচ্ছিরি দেখতে হয়ে গিয়েছে।
খানিক ক্লান্তও কি দেখায় তাঁকে আজকাল? কী জানি! শুধু মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে হয়, ইফ ইউ আর টু টায়ার্ড টু স্পিক, সিট নেক্সট টু মি। আই, টু, অ্যাম ফ্লুয়েন্ট ইন সায়লেন্স। কথা বলতে ইচ্ছে না-করলে আমার পাশে দু’দণ্ড বসুন না হয়। আমিও গড়গড় করে নীরবতার ভাষা বলতে পারি।
ওই চলেছেন তাঁর স্বআরোপিত বুদ্বুদের গৃহকর্তা। দায়িত্বশীল স্বামী এবং স্নেহময় পিতা। মাঠে নেমে যাঁকে জড়িয়ে ধরলেন আবেগাপ্লুত স্ত্রী। ছুটে এল কিশোরী কন্যা। তিনি ডানহাতের বেড় দিয়ে বুকে টেনে নিলেন স্ত্রী-কে। স্ত্রী-র ডানহাত আঁকড়ে রইল আত্মজাকে। তিনি আবার নিজের চারদিকে টেনে দিলেন স্বেচ্ছা-আরোপিত লক্ষ্মণরেখা।
শুক্রবার বিকেলে আনন্দবাজার অনলাইনের সহকর্মীদের বলছিলাম, মস্তিষ্ক চাইছে কলকাতা আইপিএল ট্রফিটা জিতুক। হৃদয় আর আবেগ চাইছে চেন্নাই। ভুল বলেছিলাম। ডাহা ভুল! মস্তিষ্ক-হৃদয়-আবেগ— সব প্রাণপণে বলছিল, ওই লোকটা এই ফাইনালের পরে আর পেশাদার ক্রিকেট না-ও খেলতে পারে। চুলোয় যাক প্রাদেশিক গর্ব। গোল্লায় যাক কলকাতা। ফাইনালটা ওই লোকটাই জিতুক!
ওই লোকটা। পেশাদার শল্যচিকিৎসকের মতো ‘ক্লিনিক্যাল’ দক্ষতায় ফাইনাল জিতে উঠে যে লোকটা সম্পর্কে তাঁর এক টিমমেট বললেন, ‘‘আমরা ওই একটা লোকের জন্যই এই টুর্নামেন্টটা খেলছিলাম। জান দিয়ে দিয়েছি!’’ ঠিকই। ফ্র্যাঞ্চাইজির মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য তো লোকে চাকরি করে। প্রতিষ্ঠানের তো কোনও অবয়ব নেই। নেহাতই বায়বীয় একটা অস্তিত্ব নিয়ে সে টিকে থাকে। তার ভিতরে প্রাণবায়ু পুরে দেয় কিছু চরিত্র। কিছু যোদ্ধা। চেন্নাই টিমটা যেমন। যার যোদ্ধারা খেলছিল একটিই লোকের সম্মানরক্ষার জন্য। প্রতিষ্ঠানে লোকে ঘড়ি দেখে। সময় মাপে। কিন্তু ব্যক্তির জন্য লোকে জানকবুল করে। ওই লোকটাই সেই ‘ব্যক্তি’। একমেবাদ্বিতীয়ম! এক এবং অদ্বিতীয় যে লোকটা ম্যাচের শেষে বলছিল, ‘‘টিম স্পোর্ট অনেক সময় ইন্ডিভিজুয়্যাল স্পোর্ট হয়ে যায়। যেখানে নক-আউট পর্যায়ে কারও একটা ১০ মিনিটের পারফরম্যান্সও খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে। ক্রিকেট টিম গেম তো বটেই। কিন্তু ব্যক্তির পারফরম্যান্সও জরুরি।’’
ওই চলেছেন এক ক্ষত্রিয়। হাতে আলগোছে ঝুলছে ঘামে-ভেজা সূর্যমুখী রংয়ের হেলমেট। সেই শিরস্ত্রাণ ঝিকিয়ে উঠছে স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে আসা হাজার হাজার ওয়াটের আলোয়। ওই আলো কি তাঁর মস্তিষ্ক থেকে গত মরসুমের আঁধারকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিচ্ছে? মনে পড়াচ্ছে যে, গতবার এই আইপিএলের প্লে-অফ থেকে তাঁর টিম এমন এক মরুশহরেই সকলের আগে ছিটকে গিয়ে অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল? তিনি নিজেও চকিতে রান নিতে গিয়ে হাঁফাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল, দমে টান পড়ছে। মনে হয়েছিল, ইঞ্জিনে জ্বালানি কি শেষ হয়ে গেল! আইপিএল থেকে অসম্মানের অকাল-বিদায় নেওয়ার আগে তিনি বেদনাবিদ্ধ ভক্তদের কথা দিয়েছিলেন, ‘‘পরের বার হতাশ করব না।’’
ওই চলেছেন জবাব-দেওয়া জয়ে মহীয়ান। সঞ্চালক যখন তাঁকে প্রশ্ন করছেন এই অবিশ্বাস্য ‘টার্ন অ্যারাউন্ড’ নিয়ে, তখন যিনি বলছেন, ‘‘সিএসকে-র কথা বলছি। কিন্তু তার আগে একটু কেকেআরের কথা বলতে চাই। ওরা অবিশ্বাস্য ক্রিকেট খেলেছে! এই টুর্নামেন্ট কোনও একটা টিমের জেতা উচিত হলে সেটা কেকেআর হওয়া উচিত ছিল। যে পরিস্থিতি থেকে ওরা ফাইনালে পৌঁছেছে, অবিশ্বাস্য!’’
ওই চলেছেন আইপিএলে ‘ড্যাডি’জ আর্মি’র গ্র্যান্ড ড্যাডি। যিনি এক বছর আগে ভক্তদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রেখে চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা হাতে নেওয়ার আগে বলবেন, ‘‘আমাদের টিমের ভিতরের পরিবেশটা খুব খোলামেলা। রিল্যাক্সড। আমাদের টিমে প্র্যাকটিস সেশন হয় না। মিটিং সেশন হয়। সেখানে আমরা একে অপরের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলি। ওয়ান-টু-ওয়ান। আমার মনে হয়, ওই পদ্ধতিটা তুলনায় ভাল। ক্রিকেটারদের মিটিং রুমের ভিতরে বসিয়ে খাতায়কলমে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করলে ওদের উপর চাপটা অনেক বেশি পড়ে।’’
ওই চলেছেন ক্রিকেট-পরিসংখ্যানবিদ। যিনি বলছেন, ‘‘প্রতিটা ফাইনালই আমার কাছে স্পেশাল। কিন্তু পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, আমরাই সেই টিম, যারা অনেকগুলো ফাইনাল হেরেও গিয়েছে।’’
ওই চলেছেন একলব্যের দ্রোণাচার্য। কয়েক’শ গজ দূরে স্টার স্পোর্টসের ম্যাচ-পরবর্তী আলোচনায় কিংবদন্তি সুনীল গাওস্কর যাঁর সম্পর্কে বলছেন, ‘‘আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি ওর সঙ্গে একই ড্রেসিংরুমে কখনও ছিলাম না। আমি নিশ্চিত, বিশ্বকাপেও মেন্টর হিসেবে ও ড্রেসিংরুম থেকে এমন অনেক নির্দেশ দিতে থাকবে, যা সময়ে সময়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।’’
ওই চলেছেন এক ক্রিকেটসাধক। যিনি টি-২০ বিশ্বকাপে জাতীয় দলের মেন্টর হওয়ার জন্য একটি পয়সাও পারিশ্রমিক নেননি। যেমন সন্তানের জন্মের সময় বিদেশ সফর মাঝপথে ছেড়ে ফিরে আসেননি। বলেছিলেন, ‘‘আই অ্যাম অন ন্যাশনাল ডিউটি। এভরিথিং এল্স ক্যান ওয়েট।’’
ওই চলেছেন এক ক্রিকেট-অভিভাবক। আইপিএল ফাইনালটা জিতে উঠেই যিনি ক্রিকেটারের জার্সি খুলে ফেলে পরে নেবেন মেন্টরের জোব্বা। ঢুকে পড়বেন টি২০ বিশ্বকাপের জন্য ভারতীয় দলের বায়ো বাব্লে। আইপিএল জয়ের সেলিব্রেশনের নিকুচি করেছে! সে সবের জন্য অনেক সময় পড়ে রয়েছে। তাঁর নিজস্ব গরিমা এখন ইতিহাস। এখন তাঁর লক্ষ্য বিরাট কোহলী এবং তাঁর ছেলেপুলেদের ঠিকঠাক চালনা করে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটার অথচ পুরস্কার-হীন অধিনায়ককে তাঁর জীবনের প্রথম আইসিসি ট্রফিটা এনে দেওয়া।
ওই চলেছেন ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট অধিনায়ক। যাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটে দু’টি বিশ্বকাপ, একটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবং চার-চারটি আইপিএল। যাঁর আমলে ভারত টেস্ট ক্রমপর্যায়ে প্রথম পৌঁছেছিল এক নম্বরে।
ওই চলেছেন এক ক্রিকেট-শ্রমিক। যিনি চপল গ্যালারি-শো, অতিনাটকীয়তা বা আরোপিত অতি-আগ্রাসনে বিশ্বাসী নন। যিনি উচ্চিংড়ের মতো লাফঝাঁপ করেন না। ফালতু লপচপানি দেখান না। যিনি নিজের পেশাকে অনাবশ্যক গ্লোরিফাই করায় বিশ্বাসী নন। যিনি নিজেকে অতিমানবীয় অভিধায় ভূষিত করতে তীব্র অনিচ্ছুক। যিনি টুর্নামেন্টের মধ্যে অমিতাভ বচ্চনের ফোনও রিসিভ করেন না। যিনি স্থিতধী। যিনি ধ্যানমগ্ন। যিনি প্রবল একমুখিতা নিয়ে পাখির চোখটুকু দেখেন তাঁর তিরের অগ্রভাগে।
ওই চলেছেন এক পক্ষপাতশূন্য নেতা। যাঁর কোনও ‘কাছের লোক’ নেই। শুধু ‘কাজের লোক’ আছে। দলীয় সাফল্যের কারণে যিনি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে কৌটোয় ভরে রাখেন। ফিল্ডিংয়ে শ্লথতার জন্য তথাকথিত ‘গ্রেট’-দেরও টিম থেকে ছেঁটে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেন না।
ওই চলেছেন স্নেহশীল সান্তাক্লজ। যিনি দুটো ম্যাচ আগে অবিশ্বাস্য ফিনিশ করে ফিরে এসে শুনেছিলেন, দুই টেনশনাক্রান্ত খুদে ভক্ত জয়ের ইচ্ছেপূরণে হাপুসনয়নে কেঁদে ভাসিয়েছিল গ্যালারি। খানিকক্ষণ পর সেই গ্যালারির নীচে খানিক আবডালে দাঁড়িয়ে তিনি বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে আলতো প্যারাবোলিক কার্ভে ম্যাচের বলটা ছুড়ে দিলেন দুই কচি মুখের জন্য। হুড়মুড়িয়ে বল কুড়িয়ে নিতে নিতে দুই শিশু কি ভাবল, কে দিল? কে দিল? আকাশ থেকে কোন জাদুবলে খসে পড়ল উপহার? কে জানে!
ওই চলেছেন নতুন ভারতের প্রতিভূ। নব্য ভারতের মুখ। নিজ বলে বলীয়ান ভারতের অভিজ্ঞান। রাঁচির মেকন কলোনির সামান্য চাকুরে পান সিংহের পুত্র। যিনি খড়্গপুর স্টেশনের টিকিট পরীক্ষকের নিশ্চিত এবং নিরাপদ সরকারি চাকরি ছেড়ে দেবেন দে-ছুট! স্বপ্ন ধরতে হবে।
ওই চলেছেন নেতা। ঝকমকে ট্রফিটা নেওয়ার ঔপচারিকতাটা সেরে নিয়েই যিনি সেটা বাড়িয়ে দিলেন অপেক্ষমান সতীর্থদের দিকে। তার পর অনর্গল কনফেটি বিস্ফোরণের মধ্যে নিজেকে গুঁজে দিলেন ফ্রেমের একেবারে কোনায়। যেমন করে থাকেন আরও অনেক ট্রফিজয়ের মুহূর্তে। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, যে নেতা দলগত সাফল্য একা চেটেপুটে খান, তিনি আদর্শ নেতা নন। আদর্শ নেতাকে সাফল্যের সময় আলোর বৃত্ত থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। সামনে এগিয়ে দিতে হয় সেনানীদের। যেমন ব্যর্থতার সময় সকলের সামনে এসে দাঁড়াতে হয় বুক চিতিয়ে। পক্ষপুটে নিতে হয় সতীর্থদের। যাতে অসাফল্যের ছায়া লম্বা হতে হতে তাদের গিলে না ফেলে।
ওই চলেছেন এক ক্রিকেট-নেশাড়ু। চতুর সঞ্চালক যাঁকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, চেন্নাইয়ের হয়ে এটাই তো তাঁর শেষ অভিযান। তা, তিনি কী লেগ্যাসি রেখে যাচ্ছেন ভবিষ্যতের ফ্র্যাঞ্চাইজি সদস্যদের জন্য? তিনি টসকাননি। উল্টে রেখে গিয়েছেন ক্রিকেট-হেঁয়ালি। কর্ডলেস মাইক্রোফোনটা টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘‘আমি কিন্তু এখনও চলে যাইনি।’’
ওই চলেছেন এক শিক্ষক। যাঁকে দেখে এক দূরবর্তী ছাত্র তাকায় তার ডেস্কটপের ওয়ালপেপারের দিকে। ওকলে রোদচশমাটা ঠিক করতে করতে তিনি বলছেন, ‘‘টিল দ্য ফুলস্টপ ডাজন্ট কাম, দ্য সেনটেন্স ইজ নট কমপ্লিট।’’ পূর্ণচ্ছেদ না-পড়া পর্যন্ত বাক্য শেষ হয় না।
ওই চলেছেন তিনি। চলমান রূপকথা।
যে রূপকথাকে বলতে ইচ্ছে করে, একটাই তো হৃদয়! আর কতবার জিতবেন, মাহি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy