গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাজ্যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদলায়। কিন্তু সেই বদলের সঙ্গে তাল রেখে সে সব রাজ্যের অর্থনীতি বদলায় না। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, রাজনৈতিকতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনীতির থেকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। উদাহরণ হিসেবে অমরেন্দ্র সিংহের বিষয়টিকেই দেখা যাক। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র অপমানিত হওয়ার প্রেক্ষিতে যথার্থ ক্ষোভ থেকেই পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এমতাবস্থায় যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন, অমরেন্দ্র কয়েক মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিতব্য বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ক্ষমতার অধিকারী কি না, তা হলে সেই প্রশ্নকর্তাকে অমরেন্দ্র-সরকারের কর্মক্ষমতা ও কর্মপন্থাকে বিচার করতে হবে। এবং যদি রাজ্যের মাথা পিছু গৃহজ উৎপাদনের নিরিখে বিষয়টি দেখা যায়, তবে বোঝা যাবে পঞ্জাবের এক জন সাধারণ বাসিন্দা রাজ্যের সামগ্রিক উৎপাদনের ৩.৮ শতাংশের দাবিদার। এই হিসেব গত মার্চ থেকে তার পূর্ববর্তী চার বছরের। এই হিসেব মোতাবেক বাৎসরিক উন্নতির হারটি ১ শতাংশেরও কম।
আরও নিশ্চিত হতে গেলে বলা যায়, এই পরিসংখ্যানের মধ্যে অতিমারি পরিস্থিতির প্রভাব রয়েছে এবং সার্বিক অর্থে ভারতের গৃহজ উৎপাদনের হারও (জিডিপি) তেমন ভাল নয়। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেছে। এখানে উন্নতির হার ১৯.১ শতাংশ। যদি উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে তুলনা করা যায়, দেখা যাবে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দিনের পর দিন সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর সরকারের অভাবিত সব গুণপনা জাহির করে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তাঁর শাসিত রাজ্যের জন্য ‘উত্তমপ্রদেশ’ অভিধাটি আদায় করেছেন। তা সত্ত্বেও যোগীর চার বছরের শাসনে উত্তরপ্রদেশের মাথাপিছু গৃহজ উৎপাদনের হার মাত্র ০.৪ শতাংশ। কিন্তু সেখানে যে পরিমাণ শৌচালয় আর সড়কপথ নির্মাণের ঢক্কানিনাদ প্রচারিত হয়েছে, অর্থনীতির ছবিটি তার চেয়ে একেবারেই আলাদা।
দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, উত্তরপ্রদেশের এই স্থবির আর্থিক অবস্থা সত্ত্বেও যোগীর ভাবমূর্তি সে রাজ্যে উজ্জ্বল। আশা করা হচ্ছে আগামী বছর নির্বাচনে তিনিই জিতে আসবেন। ঠিক যেমনটি ভাবা হচ্ছে পঞ্জাবে কংগ্রেসের অবস্থানের ক্ষেত্রে। শিখদের ধর্মগ্রন্থের প্রতি অমরেন্দ্রের অবমাননা নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা সত্ত্বেও সে আশা টিকে রয়েছে। তাঁর আমলে বিদ্যুৎ সঙ্কটে রাজ্যের বৃহৎ শিল্পগুলিতে ঝাঁপ পড়ে গেলেও একটি ঘটনা বজ্রঝলকের মতো সব কিছুকে নিস্তরঙ্গ করে দিয়েছিল (কংগ্রেসের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের আগে)। সেটি হল— কৃষিপণ্যের বিপণন নিয়ে বিজেপি-র সঙ্গে অকালিদের ঘোরতর মতপার্থক্য ও বিচ্ছেদ।
সুতরাং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অকৃতকার্যতায় কি আদৌ কিছু এসে যায়? এমন প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে। নির্বাচনী ফলাফল অতিক্রম করে যদি বৃহত্তর দিগন্তের দিকে, দেশের অন্যান্য অংশের দিকে তাকানো যায়, তবে মনে হবে সত্যি কিছু যায় এবং আসে। দক্ষিণ ভারতের পাঁচটি বৃহৎ রাজ্যের মধ্যে তেলঙ্গানায় মাথা পিছু গৃহজ উৎপাদনের হারে বৃদ্ধি গত চার বছরে ২৬.২ শতাংশ, তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রে তা ২২.২ শতাংশ। বাকি তিনটি রাজ্যে এই পরিসংখ্যান গড়ে ১৫ শতাংশের আশেপাশে। পশ্চিম ভারতের দুই বড় রাজ্য মহারাষ্ট্র এবং গুজরাতের ক্ষেত্রে তিন বছরে এই বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১৪.১ শতাংশ এবং ২৬.৭ শতাংশ। এই দুই রাজ্যের (এবং কেরলেরও) পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে ২০২০-র মার্চ মাস পর্যন্ত। ২০২০-’২১-এ কোভিড পরিস্থিতিতে এই পরিসংখ্যান অবধারিত ভাবে কমেছে বলেই ধরে নিতে হবে।
কিন্তু মনে রাখা দরকার, পূর্ব ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলিও গৃহজ উৎপাদনের এই পরিসংখ্যানে বেশ উজ্জ্বল ছবিই দেখাতে পেরেছে। পশ্চিমবঙ্গের ১৯.১ শতাংশের কথা আগেই উল্লেখিত। বিহারে এই সংখ্যাটি আশাব্যঞ্জক রূপে ২১.৮ শতাংশ এবং ওড়িশায় ১৬.৭ শতাংশ। কেবল মধ্যভারত ও রাজস্থানের ছবি বেশ খারাপ। রাজস্থানের মাথা পিছু গৃহজ উৎপাদনে গত চার বছরে বৃদ্ধির হার মাত্র ১.৩ শতাংশ। সন্নিহিত বাকি রাজ্যগুলিতে এই হিসেব ১০ শতাংশের আশেপাশে।
এই পরিসংখ্যানগুলি থেকে কোনও স্থিরনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা দুরূহ। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল এবং ‘ওয়ালেট অর্থনীতি’ বিশ্বে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে অনেক বেশি সমাপাতনিক। বেশ ভাল কর্মক্ষমতা দেখিয়েও তামিলনাড়ুর শাসক দল সে রাজ্যে টিকতে পারেনি। আবার তুলনায় কম কর্মক্ষমতার প্রমাণ রেখেও কেরলে বামফ্রন্ট পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে। এর বিপরীতে যদি দেশব্যাপী নির্বাচনের দিকে তাকানো যায়, দেখা যাবে ২০০৪-এ বিজেপি-র জিতে আসার জন্য যতখানি ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’-র প্রয়োজন ছিল, বাস্তবে কিন্তু ছবিটি ছিল ততটাই ম্লান। পরবর্তী বছরগুলিতে দারিদ্রের সঙ্গে দ্রুতগতির মোকাবিলাই কংগ্রেসকে ২০০৯-এ ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তার পরের পাঁচ বছরে সেই গতিছন্দে শৈথিল্য দেখা দেয়। আলো গিয়ে পড়ে নরেন্দ্র মোদীর উপর। চার বছর ধরে মাথা পিছু গৃহজ উৎপাদন স্থবির হয়ে থাকলেও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। সম্ভবত তাঁর বিকল্প প্রদর্শনের (কঠোর পরিশ্রম, পরিকাঠামো, কল্যাণমুখী পদক্ষেপ এবং আত্মপরিচয় ঘটিত রাজনীতি) বিষয়টিই তলায় তলায় কাজ করেছে। সেই কারণেই জনগণ এই প্রশ্ন করেনি যে, তারা বিগত চার বা পাঁচ বছরে আগের থেকে ভাল আছে কি না। তাদের স্বাচ্ছল্য বেড়েছে কি না। আসলে অনেক সময়েই নেতৃত্বের চমকে-ঠমকে বাকি সব কিছু ঢাকা পড়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy