Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
College professor

লালন ১, লালন ২, লালন ৯৬৮, সব দেবতারই খড়ের পা থাকে

দেখলাম বাস্তব, মায়া, বিভ্রম, আশাবাদ— সব ভোঁ-ভাঁ! সব গুলিয়ে লাট খেয়ে একাকার। দেখলাম, তিনি লালন হতে পারেন। কিন্তু যথার্থই কলির লালন।

বিহারের মুজফ্ফরপুরের নীতীশ্বর কলেজের সহকারী অধ্যাপক লালন কুমার। ।

বিহারের মুজফ্ফরপুরের নীতীশ্বর কলেজের সহকারী অধ্যাপক লালন কুমার। । গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২২ ০৯:০০
Share: Save:

লালন কুমার-১

সক্কাল সক্কাল মনটা তর হয়ে গিয়েছিল। এমনও ঘটে এই পোড়া দেশে! এখনও! ছাত্রছাত্রীদের না-পড়িয়ে বেতন নিয়েছিলেন বলে বিবেকের দংশন হচ্ছিল। তাই ৩৩ মাসে পাওয়া বেতনের ২৪ লক্ষ টাকা চেক কেটে কলেজ কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এক সহকারী অধ্যাপক!

এ কি বাস্তব? না মায়া? না বিভ্রম? এ কি অমানিশার শেষে আশার আলোয় উজ্জ্বল দিন? চারদিকে এত আলো, এত আকাশ? তা হলে সবকিছু এখনও ফুরিয়ে যায়নি? তা হলে এখনও, এই ২০২২ সালেও লোকের বিবেক দংশন হয়! মনের পেশিতে আরও জোর এল।

মন দিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনে খবরটা পড়তে পড়তে বিবেকও সজুত হল। মনে হল, এই লোকের জন্য আরও কয়েকটা দিন বেশি কাটানো যায় এই স্বার্থলোলুপ, অর্থগৃধ্নু মানুষে গিজগিজ-করা গ্রহে। করোনার জন্য দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থেকেছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রায় তিন বছর পড়ুয়াদের না পড়িয়েই শিক্ষকেরা মাসের পর মাস বেতন নিয়ে গিয়েছেন। ঠিক তখনই সেই নিয়মের কঠোর ব্যতিক্রম হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন বিহারের বাসিন্দা লালন কুমার (আহা, নামটিও ভারী যথাযথ। ‘লালন’। শুনলেই লালন ফকিরের কথা মনে পড়ে)।

কলিকালের লালনের ছবি দেখলাম খুঁটিয়ে। গোলপানা মুখ। একটু গাবলু-গুবলু। কাঁধে ফেলা তোয়ালে। চোখে রিমলেস চশমা। ছোট করে ছাঁটা মাথার চুল। গালে ক’দিনের না-কামানো দাড়ি (নিশ্চয়ই বিবেকের দংশনে। মনে ছটফটানি থাকলে কি আর পরিপাটি দাড়ি কামানো যায়)। বিহারের মুজফ্ফরপুরের নীতীশ্বর কলেজের সহকারী অধ্যাপক। হিন্দি পড়ান। রাষ্ট্রভাষা। বাহ্।

পড়লাম, লালন বলেছেন, অন্য অনেক শিক্ষকের মতো তিনিও করোনা অতিমারির সময়ে না-পড়িয়ে মাসের পর মাস কলেজ থেকে বেতন নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ৩৩ মাস পরে বিবেক কুটকুট করে কামড়েছে তাঁকে। সেই কামড় খেয়েই তিনি দু’বছর ন’মাসের বেতনের অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষকে। যার মোট পরিমাণ ২৩ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা! সেই টাকার অঙ্ক লেখা চেক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের হাতে তুলে দিয়েছেন লালন। বলেছেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের না-পড়িয়ে এত দিন ধরে বেতন নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু কোথাও যেন সেই বেতন নিতে বিবেকে বাধছিল। আমি তো জানি, অনলাইন ক্লাস হলেও খুব সামান্য সংখ্যক পড়ুয়া হাজির থাকত। সে অর্থে কাউকে আমি পড়াইনি। যদি আমি না-পড়িয়ে শুধু মাসের পর মাস বেতন নিয়ে যাই আগামী পাঁচ বছর, তা হলে তা আমার নিজের শিক্ষাকে গলা টিপে মারার শামিল হবে!’’

এ কি বাস্তব? না মায়া? নাকি বিভ্রম? এমন মানুষ আছেন এখনও! আরও পড়তে থাকি। আরও বিস্মিত হতে থাকি। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি, লালন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিন্দিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। পিএইচডি এবং এমফিল করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০০৯ সালে নীতীশ্বর কলেজে সহকারী অধ্যাপকের পদে যোগ দিয়েছিলেন।

পড়ে মনে হল, এই তো! জেএনইউয়ের পটভূমিকা। সঙ্গে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ। এই মানুষ এমন হবেন না তো, হবেনটা কে! এই মানুষ বেতনের ২৪ লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দেবেন না তো দেবেনটা কে! চ-ব্বি-শ লা-খ! এ তো কোনওদিন চোখেই দেখিনি। ফেরত দেওয়া তো অনেক দূরের কথা। অত মহান হতে পারব না বাবা কোনওদিন।

লালন অবশ্য আমার মতো, আমাদের মতো নন। তিনি মহতী মানসিকতার মানুষ। তিনি বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন, তিনি যখন কলেজ কর্তৃপক্ষকে বেতন ফেরানোর প্রস্তাব দেন, তাঁরা খুব অবাক হয়েছিলেন (স্বাভাবিক)। শুধু তাই-ই নয়, তাঁরা ওই টাকা ফিরিয়ে নিতে দ্বিধাবোধও করছিলেন (এ-ও খুব স্বাভাবিক)। কিন্তু লালন তাঁদের ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে বলেন, কেন তিনি বেতনের অর্থ ফিরিয়ে দিতে চাইছেন। কারণ ব্যাখ্যা করার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ রাজি হন। তবে লালনের অভিযোগ, ওই কলেজে আসার পর থেকেই পড়াশোনার পরিবেশ তাঁর নজরে পড়েনি। হিন্দি বিভাগে ১,১০০ পড়ুয়া থাকলেও তাঁদের উপস্থিতির হার নগণ্য। অনলাইন ক্লাস চালু হলেও পড়ুয়ারা তাতে অংশ নেননি। তাই তাঁদের না-পড়িয়ে বেতনের টাকা নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

লালনের পদক্ষেপে বিহারের শিক্ষামহলে শোরগোল পড়েছিল (স্বাভাবিক)। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল কলেজে শিক্ষার মান নিয়েও। যদিও লালনের কর্মস্থল নীতীশ্বর কলেজের অধ্যক্ষ পাল্টা বলেছিলেন, ‘‘লালন আসলে অন্যত্র বদলি চাইছেন। তাই বেতন ফিরিয়ে দিয়ে একটা চাপের পরিবেশ তৈরি করেছেন। পড়ুয়াদের অনুপস্থিতি নয়, স্নাতকোত্তর স্তরে বদলি পাওয়াই তাঁর ওই কাজের আসল উদ্দেশ্য।’’

শুনে গা জ্বলে গেল! মনে হল, এই লোকগুলোর জন্যই সমাজটা গোল্লায় যাচ্ছে। কোথায় সিনিয়র হিসেবে একটা ভাল কাজের প্রশংসা করবেন, মদত দেবেন, তা নয়! উল্টে আলতুফালতু বকে স্পিরিটটাই নষ্ট করে দিচ্ছেন!

তবে আবার তেমনই মন ভাল হল বিহার অম্বেডকর ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রারের কথা শুনে। তিনি বলেছেন, ‘‘লালন কুমার যা করেছেন, সেটি সত্যিই একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। আমরা উপাচার্যের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে পড়ুয়াদের অনুপস্থিতি নিয়ে জবাব চাইব।’’

মনে হল, সব আলো এখনও নিভে যায়নি। মনটা ফুরফুরে হল। ৭ জুলাই দিনটা মনে থাকবে।

লালনের অভিযোগ, ওই কলেজে আসার পর থেকেই পড়াশোনার পরিবেশ তাঁর নজরে পড়েনি।

লালনের অভিযোগ, ওই কলেজে আসার পর থেকেই পড়াশোনার পরিবেশ তাঁর নজরে পড়েনি। প্রতীকী চিত্র।

লালন কুমার-২

এই মেরেছে! এ কী খবর ভাসিয়া আসিল! ডিগবাজি খেয়েছেন কলির লালন। তাঁর ভূয়সী প্রশংসাকারী বিহার অম্বেডকর ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রারের কাছে চিঠি লিখে বলেছেন, তিনি ভুল করেছিলেন!

অ্যাঁ! বলে কী! এ তো নাটকীয় ইউ টার্ন!

অম্বেডকর ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিত ভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন লালন। আবার সেটা করেছেন তাঁর কলেজের অধ্যক্ষের মারফত (সেই যে লোকটার কথা শুনে হাড়পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল)। সেই চিঠিতে লালন কী লিখেছেন? লালন লিখেছেন, মুজফ্ফরপুরের ওই কলেজ থেকে তাঁকে বদলি করার জন্য তিনি ছ’বার আবেদন করেছিলেন। প্রতিবারেই তাঁর আবেদন নাকচ হয়ে গিয়েছে। তাই তিনি ‘আবেগতাড়িত’ হয়ে বেতনের টাকা ফেরত দিয়ে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে সিনিয়র সহকর্মী এবং কিছু হিতৈষীর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন, তাঁর ওই কাজটি করা একেবারেই উচিত হয়নি।

লালন লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমার উচিত ছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন এবং নিয়ম মেনে কাজ করা। ভবিষ্যতে আবেগতাড়িত হয়ে আর আমি এই ধরনের কোনও কাজ করব না। ওই বিষয়ে যা যা বলেছিলাম, যা যা লিখেছিলাম, সমস্ত ফিরিয়ে নিচ্ছি।’

অম্বেডকর ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার জানিয়েছেন, তিনি লালনের চিঠি পেয়েছেন। তবে যেহেতু ইতিমধ্যেই কলেজের অধ্যক্ষের কাছে লালনের ‘পড়াশোনার পরিবেশ’-এর অভাবজনিত অভিযোগের জবাব দেওয়া হয়েছে, তাই তাঁরা এখনই লালনের ক্ষমাপ্রার্থনাসূচক চিঠি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করছেন না। লালনের কলেজের অধ্যক্ষের জবাব পাওয়ার পর বিষয়টি আগা থেকে গোড়া খতিয়ে দেখবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

বাঁ দিকে কলেজকে দেওয়া লালনের সেই চেক। ডান দিকে রেজিস্ট্রারকে দেওয়া লালনের চিঠি।

বাঁ দিকে কলেজকে দেওয়া লালনের সেই চেক। ডান দিকে রেজিস্ট্রারকে দেওয়া লালনের চিঠি।

লালন কুমার-৯৬৮

ওহ্, এর মধ্যে আবার আরেক বখেড়া। মুজফ্ফরপুরের কিছু কলেজ শিক্ষক দাবি করে বসেছেন, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার মিঠনপুরা শাখায় লালনের যে সেভিংস অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সেখানে নাকি পড়ে আছে ৯৬৮ টাকা! ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের কাছে জমা-দেওয়া চেক ভাঙাতে গেলে নির্ঘাত বাউন্স করত!

রেজিস্ট্রারের কানেও সে কথা গিয়েছে। রেজিস্ট্রার জানিয়েছেন, ৯৬৮ টাকার বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। কারণ, তিনি লালনের দেওয়া চেকটি গ্রহণই করেননি। ফলে সেটি ভাঙাতেও দেওয়া হয়নি।

বোঝো কাণ্ড! ভাগ্যিস!

দেখলাম বাস্তব, মায়া, বিভ্রম, আশাবাদ— সব ভোঁ-ভাঁ! সব গুলিয়ে লাট খেয়ে একাকার। দেখলাম, তিনি লালন হতে পারেন। কিন্তু যথার্থই ‘কলির লালন’। আর শিখলাম, সব দেবতারই খড়ের পা থাকে। কাছে গেলেই সে পদযুগল চোখে পড়ে। সব আলো নিভে যায়।

মনে মনে লালনের কলেজের অভিজ্ঞ অধ্যক্ষকে একটা সেলাম ঠুকলাম। মনে মনেই বললাম, এই দিনটাও মনে থাকবে। ৮ জুলাই।

অন্য বিষয়গুলি:

College professor Bihar Lalan Kumar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy