গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
উদ্ধব ঠাকরে কি ছিলেন সেই জটলায়? মনে করতে পারছি না। থেকে থাকলেও নজরে পড়েননি। পড়ার কথাও ছিল না। বালাসাহেব ঠাকরে ফ্রেমে থাকলে কে আর নজরে পড়েন!
‘মাতশ্রী’র ড্রয়িংরুমে বিনবিন করে চলছে এয়ার কন্ডিশনার। সেই যন্ত্র থেকে বেরিয়ে-আসা শীতল বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ধূপের কড়া গন্ধ। বাতানুকূল যন্ত্রের সেই মিহি স্বরের চেয়েও নিচুগ্রামে, খানিকটা সামনে ঝুঁকে পড়ে মহার্ঘ সোফায় আসীন বালাসাহেবের কানে কানে প্রায় শ্বাসবায়ুর শব্দে কী যেন বলছেন অভিনেতা-রাজনীতিক সুনীল দত্ত।
অতিকায় বসার ঘরের প্রায় অর্ধেকটা দখল করে ফেলেছে সর্বভারতীয় মিডিয়াকুল। তাদের মধ্যে কষ্টে জায়গা করে নিচ্ছেন রাজেন্দ্র কুমার আর শত্রুঘ্ন সিংহ। সেই সোফাতেই অতিশয় বাধ্য ছেলের মতো বসেছিলেন সঞ্জয় দত্ত। তখনও তাঁর চেহারা হিলহিলে। তখনও ছমছমে। তখনও তাঁকে যুবক বলা যায়। শুধু নিছক যুবক নয়, অতীব হ্যান্ডসাম এক যুবক। ফেডেড জিন্সের ট্রাউজার্স আর সাদা ফুলস্লিভ, হাতা গোটানো হাঁটুঝুল কটন কুর্তা। বুকপকেটে একটা বলপয়েন্ট পেন। বেরোনোর আগে নিশ্চয়ই নথিপত্রে সইসাবুদ করতে হয়ে থাকবে। গলায় একাধিক রুদ্রাক্ষের মালা। ঘাড় ছাপিয়ে নেমে এসেছে ঈষৎ বাদামি চুল। চওড়া কপালে লাল সিঁদুরের লম্বা টিকা। মিনিট পঁয়তাল্লিশ আগে বেরিয়েছেন মধ্য মুম্বইয়ের জেল থেকে। জামিন পেয়ে।
জেলফেরত ‘সঞ্জুবাবা’কে নিতে গিয়েছে পুরো পরিবার। যে-সে যাওয়া নয়। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে পেল্লাই এক ভলভো বাস। গাড়ি-টাড়ি নয়, জেলের প্রধান ফটক পেরিয়ে এসে সেই বাসেই সেঁধিয়ে গেলেন সঞ্জয়। তবে বসলেন না। সিটের উপর দাঁড়িয়ে সিলিংয়ের সানরুফ খুলে কোমর থেকে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ বার করে দিলেন। তার সঙ্গে পাগলের মতো হাত-নাড়া (হাজার হোক, অত দিন পর মুক্ত পৃথিবীর বাতাসে শ্বাস নেওয়া)। ভলভো চলল দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীর রাজপথ বেয়ে। পিছু পিছু ছুট লাগাল মুম্বই শহরের নেই-আঁকড়া টাপোরির দল— ‘সঞ্জুবাবা! সঞ্জুবাবা!’ কিন্তু বান্দ্রার পালি হিলে বাংলোয় যাওয়ার আগে ভলভো যে আচমকা ‘মাতশ্রী’র দিকে ঘুরে যাবে কে জানত! বান্দ্রার কলানগরের নিবাস ছেড়ে তত দিনে সেখানে চলে এসেছেন শিবসেনা প্রধান। সকাল-বিকেল সেখানে বসেই তাঁর বিধান দেন মহারাষ্ট্রের দন্ডমুন্ডের কর্তা।
সে দিন অবশ্য বালাসাহেবের পরনে রক্তাম্বর নেই। হাতে রুদ্রাক্ষের মালা নেই। বদলে পরনে সোনালি সিল্কের কুর্তা। বাঁ-হাতের কব্জিতে উল্টো করে পরা চামড়ার স্ট্র্যাপের, গোল ডায়ালের ঘড়ি। চোখে টিপিক্যাল মোটা কালো চতুষ্কোণ ফ্রেমের চশমা। তখনও তিনি দাড়ি রাখতে শুরু করেননি। চকচকে কামানো গাল। তবে গলায় নির্ভুল এবং পরিচিত খরখরে আওয়াজ। সেই কম্বুকণ্ঠ আরও কয়েক পর্দা নামিয়ে বালাসাহেব কী যেন বললেন সঞ্জয়কে। তার পর তাঁর মাথায় রাখলেন বরাভয়হস্ত। যেমন বাড়ির বখাটে ছেলেটিকে আশ্বস্ত করেন পরিবারের প্রবীণ হিতৈষী।
যত দূর মনে করতে পারি, বালাসাহেবের পুত্র উদ্ধবের নামগন্ধহীন ছিল সেই ‘মাতশ্রী’। শুধু কি বসতবাড়ি? রাজনৈতিক উত্তরাধিকারও তো! বালাসাহেবের পর শিবসেনার ‘দখল’ নেবেন তাঁর ভাইপো রাজ ঠাকরে— শিবসৈনিকদের কাছে তেমনই ছিল দেওয়ালের লিখন। চলনে-বলনে, ঠাটে-বাটে, হুমকি-হুঁশিয়ারিতে কাকার কার্বন প্রতিলিপি ছিলেন রাজ। দৃশ্যতও। বালাসাহেবের সঙ্গে চেহারাগত সাযুজ্যের কথা তোলায় একবার বলেছিলেন, ‘‘লোকে এটা বলে জানি। কিন্তু কী করব! আমি তো আর পার্লারে গিয়ে ভোল পাল্টে আসিনি!’’
বাক্যটা শুনে মনে হয়েছিল, হুবহু বালাসাহেব। খানিক উন্নাসিক, খানিক উদ্ধত, খানিক মদমত্ত। আর অনেকটা নিজের আইন নিজে তৈরি করার ভাবনাসম্পন্ন। কাকার মতোই ‘ঠোকশাহি’র বিজ্ঞাপন। ‘ঠোকশাহি’। অর্থাৎ, বেচাল দেখলেই ডান্ডা! অধুনা ৬১ বছরের উদ্ধব সেই ভাবনার ধারপাশ দিয়েও হাঁটেননি কোনও দিন। জে জে ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লায়ে়ড আর্টসের প্রাক্তন ছাত্র। তাঁর পাঠক্রমের মূল বিষয় ছিল ফোটোগ্রাফি। সচেতন ভাবেই তিনি বালাসাহেবের ‘ক্যারিশমা’ অনুকরণ বা অনুসরণ করতে যাননি। বস্তুত, বালাসাহেব সক্রিয় থাকতে থাকতে তাঁকে কেউ সে ভাবে দেখতেও পায়নি। শিবসেনার মুখপত্রের প্রধান সম্পাদকের পদে বৃত হয়েই বেশ ছিলেন তিনি। মিতভাষী। শহুরে। এবং সবচেয়ে বড় কথা— কট্টর নন। উগ্র নন। ফলে শিবসেনার মূলগত চরিত্রের সঙ্গে তাঁর মস্ত ফারাক। উদ্ধবের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারা এবং দর্শন বালাসাহেবের প্রতিষ্ঠিত শিবসেনার উগ্র হিন্দুত্বের অনুপান মিশ্রিত ডিএনএ-র কঠোর পরিপন্থী।
২০০৪ সালে মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটের সময় উদ্ধবের পিতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, জিতলে তিনি কি তাঁর পুত্রকে মুখ্যমন্ত্রী করবেন? জীবনে কখনও ভোটে না-লড়া কিন্তু তর্কাতীত ভাবে মহারাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী নেতা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘‘মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী যিনিই হোন, রিমোট কন্ট্রোলটা কিন্তু আমার হাতেই থাকবে!’’ ছিলও। বরাবর বালাসাহেবের অঙ্গুলিহেলনেই চলেছে শিবসেনা। চলেছে মহারাষ্ট্র।
শিবসেনা বরাবরই একটি ক্যাডারভিত্তিক (এবং পারিবারিক) দল। সেই ক্যাডারকুলের এক এবং অবিসংবাদী ধারক (এবং বাহক) ছিলেন বালাসাহেব। রিমোটে তাঁর অঙ্গুলি সঞ্চালনে শিবসৈনিকরা ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে ঢুকে ক্রিকেটের পিচ খুঁড়ে দিয়েছে। পাকিস্তানি শিল্পীর অনুষ্ঠান বন্ধ করিয়ে দিয়েছে। একটু উচ্চকিত হলেও ‘সরকার’ ছবির সুভাষ নাগরের মতো নিজেদের আইন নিজেরাই বানিয়ে নিজেরাই বিচার করে চটজলদি শাস্তি দিয়েছে।
বিরোধীরা গলার শির ফুলিয়ে বলে গিয়েছে, বালাসাহেব খুল্লমখুল্লা ‘ঠোকশাহি’র রাজনীতি করছেন। তারা শিবসৈনিকদের ‘লুম্পেন’ বলেছে। ‘দুষ্কৃতী’ বলেছে। বলেছে, বালাসাহেব তাঁর দল তো বটেই, মুম্বইয়ের মতো একটি আপাদমস্তক কসমোপলিটান শহরের বুকেও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং জাতীয়তাবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার সওয়ার হতে গিয়ে প্রবল ভীতি এবং আনুগত্যের মিশেলে এক ‘মাফিয়া সংস্কৃতি’ চালু করেছেন। হতে পারে। বালাসাহেব নিজেও তা অস্বীকার করতেন না। তিনি জানতেন, তাঁর সেই জোলাপে কাজ হয়। যেমন জানতেন প্রতিটি মুম্বইকর। প্রত্যেক মরাঠি।
উদ্ধব, বালাসাহেবের উত্তরাধিকারী উদ্ধব ঠাকরে সেই কড়া জোলাপটাকেই অস্বীকার করে বসলেন! পাশাপাশি অস্বীকার করে বসলেন শিবসেনার প্রবল সমালোচিত কিন্তু তৎসত্ত্বেও শিবসৈনিকদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা মূলগত দর্শনকে। তিনি কি ভুলে গিয়েছিলেন যে, সাধারণ শিবসৈনিকেরা ধর্ম, বর্ণ, জাতিগত পরিচয় নিয়ে অনেক বেশি অবহিত। অনেক বেশি উত্তেজিত। তাই যখন উদ্ধবের পুত্র হালফিলের যুবক আদিত্য ঠাকরে পরিবেশ দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন (আদিত্য মহারাষ্ট্রের পর্যটন এবং পরিবেশ দফতরের মন্ত্রী। শিবসেনার যুব শাখা ‘যুবসেনা’র প্রধানও বটে) , তখন সেটা তাদের কাছে অলীক এবং দূরের বস্তু বলে মনে হয়। ‘জলবায়ু’ কী, সেটা খায় না মাথায় মাখে— শিবসৈনিকেরা তা জেনে করবেনটা কী!
‘অ্যাক্সিডেন্টাল চিফ মিনিস্টার’। দুর্ঘটনাজনিত মুখ্যমন্ত্রী। বলেন অনেকে উদ্ধব সম্পর্কে। সত্যিই। ২০১৯ সালের আগে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কখনও কোনও সাংবিধানিক পদে বসেননি উদ্ধব। বরং তিনি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন আকাশ থেকে তাঁর তোলা মরাঠা দুর্গসমূহের ছবির প্রদর্শনী নিয়ে। যে প্রদর্শনী হয়েছিল মুম্বই তথা দেশের ‘এলিট’ প্রতিষ্ঠান জহাঙ্গির আর্ট গ্যালারিতে।
উদ্ধবের তথাকথিত রাজনীতির কেরিয়ার শুরু ২০০২ সালে। বৃহন্মুম্বই পুরসভার ভোটে শিবসেনার ‘প্রচার প্রমুখ’ হিসেবে। সেই ভোটে ভাল ফল করেছিল শিবসেনা। সম্ভবত তার পুরস্কার হিসেবেই ২০০৩ সালে তাঁকে শিবসেনার কার্যনির্বাহী সভাপতি করেছিলেন বালাসাহেব। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ২০০৬ সাল থেকে দলীয় মুখপত্রের প্রধান সম্পাদক হিসেবেই কাজ করেছেন উদ্ধব। এবং আপাতদৃষ্টিতে তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছেন।
ঘটনাচক্রে, সেই ২০০৬ সালেই শিবসেনা ভেঙে বেরিয়ে গেলেন রাজ। গড়লেন তাঁর নিজস্ব দল ‘মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা’। কিন্তু তাঁর সেনা দাগ কাটতে পারল না। কারণ, তখনও ‘সেনা’ মানে মহারাষ্ট্রে ‘শিবসেনা’। আর সেই শিবসেনার রিমোট তখনও ধরা সেনা-শার্দূল বালাসাহেবের হাতে। ততদিনে বাঘের বয়স হয়েছে ঠিকই। তিনি ঈষৎ জবুথবু। গলায় সেই দার্ঢ্যও প্রায় নেই। কিন্তু গায়ের ডোরা যাবে কোথায়!
২০১২ সালের নভেম্বরে ইহলোক ছাড়লেন বালাসাহেব। গোটা মুম্বই নগরী কার্যত স্তব্ধ। সেই স্তব্ধতার পাশাপাশিই শিবসেনার অন্দরেও বদল ঘটছিল। বালাসাহেবের রিমোট হাতে নিচ্ছিলেন উদ্ধব। রিমোট তো নিচ্ছিলেন। কিন্তু ‘কন্ট্রোল’? নিয়ন্ত্রণ?
২০১৯ সালে মহারাষ্ট্রে রাজনৈতিক ডামাডোলের পর সেই উদ্ধবই হয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী! অ্যাক্সিডেন্টাল চিফ মিনিস্টার। দুর্ঘটনাজনিত মুখ্যমন্ত্রী। তা-ও দীর্ঘ দিনের সহযোগী বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে। বললেন, ‘‘আমরা সবসময় সর্বান্তঃকরণে বিজেপিকে সমর্থন করে গিয়েছি। যাতে ওরা কেন্দ্রে সরকার গড়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। ঠিক ছিল— ওরা কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করবে। আমরা মহারাষ্ট্রে। কিন্তু ওরা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! আমাদের ঘরে ঢুকে আমাদেরই শেষ করতে চেয়েছে! ফলে আমাদের প্রত্যাঘাত করা ছাড়া উপায় ছিল না।’’ আরও বললেন, ‘‘বিজেপি মানে হিন্দুত্ব নয়। আবার বলছি, বিজেপির সঙ্গে থেকে শিবসেনা ২৫টা বছর স্রেফ নষ্ট করেছে।’’
সেখানেই কি বালাসাহেবের রিমোটটা হাত থেকে ফেলে দিলেন উদ্ধব? আর বিজেপির প্রত্যক্ষ ইন্ধনে সেটা কুড়িয়ে নিলেন একনাথ শিন্ডে?
বিরোধীরা বলছেন বটে, বিজেপি ‘খিড়কি’ দিয়ে ক্ষমতায় এল মহারাষ্ট্রে। কিন্তু বিজেপি বলছে, ২০১৯ সালে উদ্ধবই তো দীর্ঘদিনের ‘চুক্তি’ ভেঙে এনডিএ ছেড়ে ইউপিএ-র হাত ধরেছিলেন। অন্যায় কোনটা? এখন তাদের অন্যায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে বিরোধীরা। কিন্তু তিন বছর আগে উদ্ধব এনডিএ ভেঙে বেরিয়ে ইউপিএ-র হাত ধরে কি অন্যায় করেননি!
ঘটনাচক্রই যে, এই উত্তর সম্পাদকীয় লিখতে লিখতে চোখে পড়ল শিন্ডেকে দল থেকে বহিষ্কার করার নির্দেশ দিয়ে শিবসেনার লেটারহেডে উদ্ধবের চিঠি। প্যাডের মাথায় একদিকে বাঘের মুখ। অন্যদিকে তির-ধনুক। দেখতে দেখতে মনে হল, শিবসেনার বাঘের পিঠেই চড়েছিলেন জে জে কলেজের মিতভাষী, শহুরে প্রাক্তনী।শিবসেনার সেই বাঘই কি তাঁকে গিলে খেল? বাঘ তার গায়ের ডোরার কথা কখনও ভোলে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy