Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রবেশিকা পরীক্ষা বিপ্লব: এর পর স্কুলের বদলে কোচিং ক্লাস

Examination: এক দেশ এক পরীক্ষা?

বিভিন্ন রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও ইউজিসি বলছে এই অভিন্ন পরীক্ষার নম্বরের সাহায্যে ভর্তি করতে।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২২ ০৪:২৩
Share: Save:

নতুন শিক্ষানীতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দিতে চলেছে অনেকটাই। এখন আবার স্কুলের গণ্ডির ঠিক পরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়টাতে একটা সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করা হচ্ছে ‘এক দেশ, এক পরীক্ষা’র মাধ্যমে।

‘শিক্ষাবিধি’ শীর্ষক প্রবন্ধে একশো দশ বছর আগের পরাধীন দেশের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “যে শিক্ষা স্বজাতির নানা লোকের নানা চেষ্টার দ্বারা নানা ভাবে চালিত হইতেছে তাহাকেই জাতীয় বলিতে পারি।” আসলে দেশটা অভিন্ন হলেও তার সব কিছু, জীবনযাপনের প্রতিটা হৃৎস্পন্দনকে এক সুরে বাঁধা যায় কি না, সে বড় কঠিন প্রশ্ন। তার চাইতেও জটিল বিতর্কের বিষয় হল, বৈচিত্রে ভরা এত বড় দেশের সব কিছুকে এক সমতলে আনা উচিত কি না। এত আঞ্চলিক বিশিষ্টতা থাকার দরুন বিবিধের মাঝেই এ দেশের মহান মিলন জড়িয়ে আছে বলে ভাবেন অনেকে।

এটাও ঠিক, এই ‘নানা ভাবে চালিত’ হতে গিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে আজ তৈরি হচ্ছে অন্য সমস্যা। যেমন, বিভিন্ন বোর্ডের বারো ক্লাসের পরীক্ষার নম্বরে সামঞ্জস্য থাকছে না একেবারে। কোনও বোর্ডে এত নম্বর উঠছে যে, নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক স্তরে ভর্তির যোগ্যতামান হিসাবে বারো ক্লাসের নম্বরকে প্রায় একশো শতাংশ করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। যে বোর্ডে নম্বর কম ওঠে, তার ছাত্ররা তাই এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই পারবে না। আবার কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ভর্তির পরীক্ষা নিয়েও চাপ বাড়ায় ছাত্রদের। যা-ই হোক, বিভিন্ন বোর্ডের নম্বরের মধ্যে সামঞ্জস্য আনার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে বেশ কিছু দিন ধরেই। আপাত ভাবে অভিন্ন পরীক্ষার আয়োজন সে কারণেই।

অবশ্য বিভিন্ন বোর্ডের অসামঞ্জস্যপূর্ণ নম্বরের মধ্যে সমতা আনতে যে একটা অভিন্ন পরীক্ষার আয়োজনই করতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। বৈচিত্রকে জিইয়ে রেখেও সমতা আনা সম্ভব ছিল বইকি, রাশিবিজ্ঞানের পুরনো এক কৌশল ব্যবহার করে। এর নাম ‘কোয়ান্টাইল নর্মালাইজ়েশন’। যে কোনও একটা বোর্ডের নম্বরকে মাপকাঠি ধরে নিয়ে তার প্রতিটা নম্বরের নীচে কত শতাংশ ছাত্র রয়েছে, দেখে নিতে হবে। অন্য যে কোনও বোর্ডের নম্বরকে এনে টেনেটুনে বা ঠেলেঠুলে সেই ছাঁচে ফেলতে হবে, যাতে যে কোনও নম্বরের নীচে ছাত্রের শতাংশ এই ‘মাপকাঠি’র সঙ্গে মিলে যায়, অভিশ্রুতির মধ্যে দিয়ে। ফলে কোনও বোর্ডে পঁচানব্বই শতাংশ পাওয়া ছাত্রের পরিবর্তিত নম্বর হয়ে যেতে পারে নব্বই শতাংশ। ও দিকে অন্য কোনও বোর্ডে অষ্টআশি শতাংশ পাওয়া ছাত্র এই পদ্ধতিতে পরিবর্তিত স্কেলে বিরানব্বই শতাংশ পেয়ে যেতে পারে! আর এই পুরো ব্যাপারটার প্রয়োগ করা যেতে পারে একটা ছোট্ট কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখে, খুব সহজে, অতি দ্রুত। এই ধরনের প্রচেষ্টার মধ্যে না গিয়ে অবশ্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তির জন্য আয়োজন করা হচ্ছে এক অভিন্ন পরীক্ষার, বছরে দু’বার করে। আপাত ভাবে তাতেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, সামঞ্জস্য-সাধনটাই আসল কথা।

বিভিন্ন রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও ইউজিসি বলছে এই অভিন্ন পরীক্ষার নম্বরের সাহায্যে ভর্তি করতে। কিছু রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়— প্রধানত হয়তো বিজেপি বা তার শরিক-শাসিত রাজ্যে— তা মেনে নেবে সানন্দে। কিন্তু সব বিরোধী রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় সেটা মানবে না। যুক্তি-প্রতিযুক্তির জাল বোনা হবে বিভিন্ন মহলে। মূল কারণটা যদিও রাজনৈতিক। এমনকি কোনও রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এই অভিন্ন পরীক্ষাকে গ্রহণ বা বর্জনের নীতিও বদলে যেতে পারে। এমনি ভাবেই শিক্ষায় রাজনীতির দুর্ভাগ্যজনক ছোঁয়া আসার সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়।

কলেজে ভর্তির জন্য ‘এক পরীক্ষা’ হলে, তা অবশ্যই হবে এনসিইআরটি-র সিলেবাসে। ছাত্রদের যদি অভিন্ন পরীক্ষার উপযোগী করতে হয়, তা হলে প্রতিটা বোর্ডের সিলেবাসকে করতেই হবে এনসিইআরটি-র মতো। এক দেশ, এক সিলেবাস?

আচ্ছা, সে ক্ষেত্রে এই অভিন্ন পরীক্ষার জমানায় বোর্ডের পরীক্ষার গুরুত্ব কোথায়? ইউজিসি নিদান দিয়েছে, কলেজে ভর্তিতে বোর্ডের পরীক্ষার নম্বর দিয়ে ঠিক করা যেতে পারে ন্যূনতম যোগ্যতামান। তবে অভিজ্ঞতা বলে, এই ধরনের ন্যূনতম যোগ্যতামান পার করা বেশির ভাগ ছাত্রের পক্ষেই সাধারণত কঠিন হয় না। তাই কলেজে ভর্তির জন্য ‘এক পরীক্ষা’ হলে এবং ভর্তিতে বোর্ডের পরীক্ষার গুরুত্ব না থাকলে, স্কুলের পঠনপাঠন এবং বোর্ডগুলির পরীক্ষাও তার গুরুত্ব হারাবে। অনেকেই ভাবছেন, ছাত্ররা যেটুকু গুরুত্ব দেবে, তা ওই প্রবেশিকা পরীক্ষাতেই। ঠিক যে ভাবে মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আগ্রহী ছাত্রদের একটা বড় অংশ আদৌ মাথা ঘামায় না বোর্ডের পরীক্ষায়।

তাই এক বিপুল সংখ্যক ছাত্র যখন নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে দামি বিষয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য এই অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভাল, আরও ভাল ক্রম অর্জনের জন্য ছুটবে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই গড়ে উঠবে এক কোচিং ক্লাসের পদ্ধতি। অভিন্ন পরীক্ষায় বসবে লক্ষ লক্ষ ছাত্র। তাই এই ধরনের কোচিং ক্লাসও ব্যাপ্ত হবে শহরে শহরে। এমনকি গড়ে উঠতে পারে ‘কোটা’র মতো অনেকগুলি কোচিং জনপদও। এ সব আটকানো কঠিন, কারণ বছরে দুটো করে অভিন্ন পরীক্ষা হলে সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের মধ্যে একটা প্যাটার্ন থাকবেই। কোচিংয়ের চিচিং-ফাঁক মন্ত্রের ছোঁয়া খুলে দেবে এক স্বপ্নের দুনিয়ার সিংহদ্বার— এমন একটা বিশ্বাস তৈরি হবেই সমাজ-পরিসরে। আর এখানেই ‘এক দেশ’ দেখবে ভিন্ন চালচিত্র। শহর-গ্রাম, ধনী-দরিদ্রের চিরন্তন পার্থক্য এই অভিন্ন পরীক্ষার সূত্র ধরেই হয়তো আরও চওড়া হবে, যা প্রতিবিম্বিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্রদের তালিকায়। এমনকি এক শ্রেণির ছাত্রের কম্পিউটার ব্যবহারে অনভিজ্ঞতাও বাড়িয়ে দেবে এই অসাম্য। এই অভিন্ন পরীক্ষা সম্ভবত হবে কম্পিউটারের সাহায্যেই।

সমস্যা থাকবে আরও। যে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মেনে নেবে এই ‘এক পরীক্ষা’, সেখানকার ছাত্ররা একটা পরীক্ষার মধ্যে দিয়েই পার হবে কলেজে ভর্তির বৈতরণি। কিন্তু বাকি রাজ্যের ছাত্রদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অভিন্ন পরীক্ষার সঙ্গে ভাল ফল করতে হবে বোর্ডের পরীক্ষাতেও, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা মাথায় রেখে। তাই চাপ বেশি থাকবে এই সব ছাত্রদের। এক দেশে দুই ব্যবস্থার ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে যাবে না তো ছাত্ররা?

আইআইটি-র প্রবেশিকার মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আনুমানিক আঠারো হাজার আসনের জন্য পরীক্ষা দেয় প্রায় দশ লক্ষ ছাত্র। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিস্তৃত এক কোচিং শিল্প। কেবলমাত্র ‘কোটা’র কোচিং অর্থনীতিই আজ চার হাজার কোটি টাকার বেশি। ও দিকে স্নাতক স্তরে পঁয়তাল্লিশটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই আসন রয়েছে কয়েক লক্ষ, এখনই যার জন্য আবেদন করে প্রায় দশ লক্ষ শিক্ষার্থী। অভিন্ন পরীক্ষা হলে হয়তো পরীক্ষায় বসবে আরও অনেক বেশি ছাত্র। আর রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এর সঙ্গে জুড়ে গেলে ফুলেফেঁপে এর আয়তন হবে আরও অনেক বড়। কোচিং শিল্প এর মধ্যে কতটা থাবা বিস্তার করতে পারবে, তা এখনই বলা কঠিন। ইউজিসি-র চেয়ারম্যান এম জগদেশ কুমার অবশ্য দাবি করেছেন যে, এই ব্যবস্থায় কোচিং সেন্টারের রমরমা মোটেই বাড়বে না। কী জানি, না হলেই ভাল!

দুনিয়া জুড়ে ছকে-বাঁধা শিক্ষার পটভূমিতে আজ শিক্ষা-পদ্ধতি আমাদের ‘সত্য’র চেয়ে বেশি জোগান দেয় ‘তথ্য’, ‘অগ্নি’র চাইতে বেশি জোগায় ‘ইন্ধন’— রবি ঠাকুর এর উল্টোটাকে আদর্শ মনে করলেও, এই প্রেক্ষাপটে অভিন্ন পরীক্ষার পরিকল্পনাটা তাই যুগের প্রয়োজনে বৈচিত্রপূর্ণ এক দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই। এবং নিঃসন্দেহে তা ছাত্রদের কথা ভেবেই। তবে সম্ভাব্য ফলাফলকে চোখ বুজে এড়িয়ে গেলে হবে সর্বনাশ। এ সব মাথায় রেখেই নেওয়া উচিত প্রস্তুতি। এখন মেডিক্যাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা স্কুলশিক্ষার শেষ লগ্নে দুটো নাভির মতো কাজ করে, যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় এক শ্রেণির ছাত্র, তাদের শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজের ধ্যান-ধারণা। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষাকে মেনে নিলে এই আবর্তন পথ কিন্তু বদলে যাবে অনেকটাই। মেডিক্যাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আকর্ষণ তো থেকে যাবেই, কিন্তু তার সঙ্গে তৈরি হবে আর এক প্রবল শক্তিশালী নাভিবিন্দু। অভিন্ন প্রবেশিকাকে মাথায় রেখে পুনর্সংজ্ঞায়িত হবে এক বিপুল-সংখ্যক ছাত্রের প্রস্তুতি, তাদের পড়াশোনার গতিপথ আর অভিমুখ। ‘রেভলিউশন ২০২০’র দেশে এই ‘এক পরীক্ষা’ তাই যেন ‘রেভলিউশন ২০২২’!

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy