অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সব পড়ুয়াকে ফেরানো চাই’ (৯-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে সকল স্তরে ঐকান্তিক প্রচেষ্টার আবেদন করেছেন। প্রসঙ্গত, ওই প্রবন্ধটি প্রকাশের দিন একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্টের বিচারপতি মন্তব্য করেছেন, পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়ছে। স্কুলছুটের পরিসংখ্যান রাজ্য সরকার যথাযথ দিতে না পারায় হাই কোর্টের তিরস্কারের মুখে পড়েছে। অভিজিৎবাবু সরকারের ভূমিকা এড়িয়ে গিয়েছেন। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতার ফলে আজ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যথেষ্ট শিক্ষকের অভাব। তাই স্কুলছুটদের ফিরিয়ে আনার কাজটা সহজ হবে না। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী পুজোর ছুটির পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা বলেছেন। আড়াই মাস পরের পরিস্থিতি এখনকার হিসেবে বিচার করা যায় না। তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়লে আরও বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা। যে হেতু এখন সংক্রমণের হার ২ শতাংশের নীচে, তাই পরীক্ষামূলক ভাবে এখনই ক্লাস শুরু করা যেত। আড়াই মাস পর যে আরও স্কুলছুট বাড়বে, সন্দেহ নেই।
তৃতীয়ত, স্কুলগুলিতে নজরদারির অভাব এবং শিক্ষক সংগঠনগুলোর শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। কিন্তু এ দু’টি কী ভাবে সম্পর্কিত, তা ব্যাখ্যা করেননি। শিক্ষক সংগঠনগুলি নিজেদের পেশাগত দাবির সঙ্গে শিক্ষার সার্বিক পরিকাঠামো বৃদ্ধির জন্যও সরব হয়েছে। পরিদর্শকের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কি নজরদারি বৃদ্ধি পায়? গত কয়েক বছরে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধির বদলে মনোনীত প্রার্থী দিয়ে স্কুল পরিচালন সমিতি গড়া হয়েছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা দফতরকে রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
রাজেশ মুখোপাধ্যায়
বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
সমস্যার খতিয়ান
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটি পড়ে উপলব্ধি হল, শিক্ষা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। সে জন্য একগুচ্ছ প্রস্তাব করেছেন। কয়েকটা পর্যবেক্ষণ রাখছি। ১) অতিমারিতে ছাত্রছাত্রীদের সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব পালন করতে সরকার কেবল বিদ্যালয়ে দৈনিক আসা-যাওয়া বন্ধ করেছে। আর কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। বহু জায়গায় মিড-ডে মিল, টাস্ক দিতে-নিতে পড়ুয়ারা নিজেরাই এসেছে। ২) কী ভাবে ‘সতর্কতা’ মেনে চলা হবে? বেশির ভাগ স্কুলে ঝাড়ুদার নেই। প্রতিনিয়ত শ্রেণিকক্ষগুলি জীবাণুমুক্ত করার লোক এবং অর্থ দরকার। ৩) ‘সিলেবাস’ সম্পর্কে লেখকের ধারণা উদার। কিন্তু সিলেবাস শেষ করতে না পারলে, শিক্ষকের সমালোচনা সামাল দেওয়ার উপায় কোথায়? ৪) যে পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, তাতে শিক্ষানীতি অনুযায়ী ‘রিমেডিয়াল’ ক্লাস করিয়ে শিক্ষার্থীকে বয়স অনুযায়ী ক্লাসে তোলার বার্তা আছে। এর প্রয়োগ খুব কমই দেখা গিয়েছে। ৫) স্কুলছুটদের ফেরানোর কাজ এখন প্যারাটিচাররা করেন। তাঁদের সাম্মানিক দেওয়া বন্ধ। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা বেশির ভাগই প্রশিক্ষিত নয়। ৬) স্কুল পরিদর্শন খুব কমই হয়। প্রতিনিয়ত কাজের চাপ স্কুলের উপর পড়ছে। ডিআই অফিসে লোকাভাব। সমস্যার ফাইলের পাহাড়। ৭) দেখা গিয়েছে, ক্ষমতায় থাকা শিক্ষক সংগঠনই শক্তিশালী। শিক্ষার স্বার্থে তাদের কণ্ঠের জোর থাকে কম।
শংকর কর্মকার
হালিশহর, উত্তর ২৪ পরগনা
দুয়ারে শিক্ষক
ছত্রিশ বছর স্কুলে-কলেজে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমার কিছু প্রস্তাব আছে। ঘোষণা অনুযায়ী, স্কুল খুলতে এখনও তিন মাস বাকি। ইতিমধ্যে প্রতিটি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীর বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিন। তাদের বর্তমান শিক্ষার মান যাচাই করুন, ও উন্নতির ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন। শিক্ষক-শিক্ষিকা বাড়িতে পৌঁছলে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হবে, অভিভাবক সচেতন হবেন। ছাত্রের বাড়িতে শিক্ষকের উপস্থিতি কতখানি প্রেরণাদায়ক, তা ছাত্রজীবনে অনুভব করেছি। কাজটা কঠিন নয়। অতিমারির সময়ে আশাদিদি ও নার্সরা গ্ৰামে-গঞ্জে এক দিনে বহু বাড়ি ঘুরেছেন। স্কুল বন্ধের প্রথম দিন থেকে এই পরিকল্পনা নিলে আজ শিক্ষাজগতের বিরাট বিপর্যয় অনেকটাই রুখে দেওয়া যেত।
গৌতম পতি
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
ভিন্ন মাপকাঠি
অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিটি উপদেশ সরকারের যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। স্কুল শুধু খুললেই তো হবে না, গত দেড় বছরে পড়াশোনা থেকে সম্পর্কহীন থাকার জন্য অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর যে ক্ষতি হয়েছে, তা সহজে মেটার নয়। শিক্ষার্থীদের শুধু পাশ করানোর কথা না ভেবে যদি প্রকৃত অর্থে কিছু শেখানোর ইচ্ছে থাকে, তবে এ বার ক্লাস অনুযায়ী শিক্ষাদানের থেকে অধিক প্রয়োজন কে কতটা জানে বা মনে রেখেছে, সেই মাপকাঠি অনুযায়ী শিক্ষাদান করা। সিলেবাস-ভিত্তিক না পড়িয়ে অক্ষর পরিচয়, বাক্যগঠন, রিডিং পড়তে পারা বা অঙ্কের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ কষতে পারা, এ সব মাপকাঠির উপর ভিত্তি করে আমরা যদি তাদের পৃথক শ্রেণিতে ভাগ করে শেখাতে শুরু করি, অন্তত কয়েকটা মাস, তা হলে হয়তো তারা কিছু শিখতে পারবে। এই মাপকাঠি অনুযায়ী পড়ুয়াদের আলাদা করাটা সমস্যার হয়ে দাঁড়াবে সেই সব স্কুলে, যেখানে ছাত্রসংখ্যা বেশি। কিন্তু এত দিন বন্ধ থাকার পর পড়ুয়াদের শেখানোর স্বার্থে, সামগ্রিক শিক্ষার স্বার্থে এই চ্যালেঞ্জটুকু তো আমরা শিক্ষকরা নিতেই পারি। প্রাথমিক এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদেরও উচিত এই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করা।
অনামিকা সরকার
বেলঘরিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা
চাই নির্দেশ
প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন, স্কুলে অনলাইন ক্লাস ও অ্যাক্টিভিটি টাস্কের সুফল পাচ্ছে খুব কম ছেলেমেয়ে। শিক্ষকতার সুবাদে দেখেছি, সিংহভাগ ছেলেমেয়েরা টুকে হুবহু এক খাতা জমা দিচ্ছে। অথচ, স্মার্টফোন, ডেটা প্যাক, নেট স্পিড প্রভৃতির অপ্রতুলতার সমস্যা সরিয়ে রেখেও, ৯৯ শতাংশ অভিভাবকের হাতে-থাকা সাধারণ মোবাইল ফোনে ‘কল কনফারেন্স’-এ সকাল ১১টা থেকে বেলা ৪টে পর্যন্ত রুটিন বানিয়ে ‘রোটেশন’-এ অল্প অল্প ছাত্রছাত্রী নিয়ে পড়াশোনা চালানো যায়। কিন্তু উপযুক্ত বিভাগীয় নির্দেশিকা ও নজরদারির অভাবে তা হচ্ছে না। স্কুলছুটদের ফেরানোটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সব শিক্ষক-শিক্ষিকাকে নিবিড় ভাবে কাজে লাগানো দরকার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে সক্রিয় করার ভাবনা ভাল। তার সঙ্গে গ্রামে পঞ্চায়েত গঠিত পাড়াওয়াড়ি কমিটি, শহরে পুরসভা গঠিত বরোওয়াড়ি কমিটি ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে কাজে লাগাতে হবে।
প্রণব মাটিয়া
পাথরপ্রতিমা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
পাড়ায় শিক্ষা
প্রতিটি শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য লেখক যে প্রস্তাবগুলি দিয়েছেন, সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ এবং যথাযথ। এই পরিস্থিতিতে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলির কথা বিশেষ ভাবে ভাবা দরকার। বাবা-মায়েরা সকালবেলায় শিশুকে একা বাড়িতে রেখে কাজে বার হন। ফলে শিশুটি সারা দিন একা, বা ছোট ভাইবোনের সঙ্গে বাড়িতে থাকে। এদের জন্য প্রতিটি এলাকায় একটি করে ‘স্পেশাল স্কুল’ খোলা দরকার, যেখানে তারা সারা দিন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা, শারীরচর্চা, খেলাধুলা, নাচ-গান, আবৃত্তি শিখে সন্ধ্যায় বাবা-মায়ের হাত ধরে বাড়িতে ফিরবে। তা হলে বাচ্চারা মনের আনন্দে শিখবে, এবং তাদের নির্দিষ্ট ক্লাসে, বিদ্যালয়ে আবার ফিরে যাবে।
অরুণ কুমার মণ্ডল
হেলান, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy