এবারের পশ্চিমবঙ্গের ভোট প্রচারে ধারাবাহিক ভাবে একটা ঘটনা ঘটে চলেছে, যা নিয়ে এত দিন তেমন কথাবার্তা শুনছিলাম না। ঘটনার নাম— নারীবিদ্বেষ। সে দিন টিভি চ্যানেলে দিলীপ ঘোষের ওই কথাগুলোর সূত্র ধরে অন্তত কথা বলা এবং বার্তা দেওয়াটা শুরু হয়েছে, এ একটা ভাল খবর। গত কয়েক মাস ধরেই সমানে শুনছি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারের একটা সুর— এক অসুস্থ বোধ করানো সুর। ওঁর ওই ‘দিদি দি-দি-ই-ই’ ডাক— ঠিক সাধারণ ডাক তো নয়, কী যেন আছে ওর মধ্যে! এমন কিছু যেটা কিছুতেই মানতে পারি না! নিজেই মনে মনে তলিয়ে ভাবছিলাম, কেন হঠাৎ একটা ডাক নিয়ে এতটা অসুবিধে হচ্ছে, এ কি আমারই সমস্যা? প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি আমার অপছন্দ বলেই কি এমন লাগছে? কিন্তু ওঁদের দলের সকলের কথায় তো এই প্রতিক্রিয়া হয় না। না, তা হলে নিশ্চয়ই এটা রাজনীতির ব্যাপার নয়, অন্য কিছু। তবে কী সেটা? সতেরো সেকেন্ড-এর রেকর্ডেড ক্লিপে ওই ডাক অন্তত তিন বার, কেমন একটা হিসহিসে স্বর, যাকে বলে ‘হিসিং সাউন্ড’, তার সঙ্গে কী এক ইঙ্গিতময় হাসি: এই হল দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি সম্বোধন?
‘দিদি’ তো দেশে এখন এক জনই। আচ্ছা, অন্য কোনও রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী বা নেতাকে ঠিক এই ভাবে এই ‘টিজ়িং’ সুরে ‘হিসিং’ স্বরে ‘দাদা দা-দা-আ-আ-আ’ বলেন কি নরেন্দ্র মোদী? কানে আসেনি তো!
কী যে ব্যাপারটা— সকলের সামনে তা স্পষ্টাস্পষ্টি এনে ফেলে মাননীয় দিলীপ ঘোষ একটা জরুরি কাজ করলেন। এই নেতাটি অনেক দিন ধরেই ঠিক করে নিয়েছেন, আমরা যাকে সভ্যতা-ভব্যতা বলি, তার ধার তিনি ধারবেন না, নিয়ম করে এমন কথা বলবেন যাতে এই আচরণ-সংস্কৃতির ধারণা একটা জোরালো ধাক্কা খায়, যাতে এক দল সেই ধাক্কার চোটে আনন্দে ফেটে পড়ে, আর এক দল আপত্তি করে, আর আপত্তিতে কাজ না হলে অসহায় বোধ করে। যে দল উৎফুল্ল হয়, তাদের দিকে তাকিয়েই তো দিলীপ ঘোষেরা এই ঘরানাটাকে আত্মস্থ করেছেন, নিজেদের ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ করে তুলেছেন। তাই দিলীপ ঘোষ যে কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শাড়ি তোলা’ ‘ঠ্যাং দেখানো’র কথা বলেন, বারমুডা পরার উপদেশ দেন (না, ‘উপদেশ’ নয়, ‘ব্যঙ্গ’— কেননা তাঁর সুর ও স্বরই বলে দেয়, মেয়েদের বারমুডা পরাকে কতটা অশ্লীলতা ভাবেন তিনি), সেই একই উদ্দেশ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের পদের মানমর্যাদার ‘জঞ্জাল’ সরিয়ে রেখে এক জন মুখ্যমন্ত্রীর নাম বলার সময় সরাসরি ‘হিসিং সাউন্ড’ বার করতে পারেন— করতেই পারেন, কেননা যাঁকে বলা হচ্ছে, তিনি তো এক জন মহিলা!
আমাদের অসুবিধে হচ্ছে? হোক না। আমাদের অসুবিধে হবে বলেই তো এটা করা। আমাদের এই অসুবিধেতে— দিলীপ ঘোষ বলেছেন— ওঁদের ‘কিচ্ছু এসে যায় না।’ মহিলা প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করলেন, দিলীপবাবু যে ‘অভদ্র’ ভাবে কথা বলছেন, তেমন কি বলা উচিত। উত্তর এল— “ন্যাকামি করবেন না।” প্রশ্ন: সাধারণ নাগরিক হিসেবে কি তিনি আর একটু সম্মান পেতে পারেন না। উত্তর এল— না, তিনি ‘সাধারণ’ নন, দিলীপবাবুই সাধারণ, তাই তিনি মেয়েটিকে চুপ করাতে পারেন। তাঁর বা তাঁদের কোনও কথায় দিলীপবাবুদের কিছু এসে যায় না, কারণ দিলীপবাবুরা ‘সমাজ’-এর সঙ্গে আছেন। ওই প্রশ্নকারী মহিলা, আমি, আমরা যারা ‘অসুবিধে’ বোধ করছি, তারা মোটেই ‘সমাজ’ নই।
আমরা অবশ্য জানি যে, অসভ্য-অভব্য ব্যবহার-কথাবার্তায় যাঁরা দিলখুশ হন, মেয়েদের প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিতে যাঁদের চিত্ত অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়, ‘আহ কী জমে গেল’ গোছের সন্তোষ হয়— সমাজের এই ধর্ষকামী অংশটা চিরকালই ছিল। তবে দিলীপবাবুদের মতো প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা চিরকাল ছিলেন না, যাঁরা ঘোষিত ভাবে কেবল এঁদেরই ‘সমাজ’ বলে দাবি করেন, বাকিদের বলে-কয়ে পাত্তা দেন না, যাঁরা এঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এঁরা সংখ্যায় বেশি বলে অন্যদের ন্যাকা (কিংবা বুদ্ধিজীবী, কিংবা বুদ্ধিজীবী ন্যাকা— এবং অ্যান্টি-ন্যাশনাল) বলে মার্কা দিয়ে দেন। এই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের প্রধান নেতা, যিনি নাকি নিজে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, গোটা রাজ্যের সামনে তিনি ঘোষণা করে দিলেন— ‘আমাদের মতো’ যে বাঙালিরা মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা আর দুর্ভাষা বলাকে খারাপ কাজ ভাবি, প্রকাশ্য সভায় মেয়েদের দূরস্থান, ছেলেদেরও মুখের উপর “ন্যাকামি করবেন না”-র মতো মন্তব্য করি না— সেই ভদ্রতাবোধ-ওয়ালা বাঙালিরা তাঁদের চোখে আর ‘সমাজ’ নই। তাই আমাদের তোয়াক্কা করারও দরকার নেই। দিলীপ ঘোষদের সঙ্গে ‘সাধারণ মানুষ’ আছেন, মোদীর সঙ্গেও, বাকিরা যেন চুপ করে থাকেন।
সোজা কথা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির জন্য তাঁর প্রতি এই কুকথা নয়, তিনি মেয়ে বলেই তিনি টার্গেট। তাই প্রিয়ঙ্কা গাঁধীকে বলা যায় ‘স্কার্টওয়ালি বাই’। মায়াবতীকে বলা যায় ‘হিজড়া’। স্মৃতি ইরানিকে নিয়ে ওঁদেরই সামনে বলা যায়, “শি শুড রিমেমবার দ্যাট চেঞ্জিং দ্য কনস্টিটিউশন ইজ় নট অ্যাজ় ইজ়ি অ্যাজ় চেঞ্জিং হাজ়ব্যান্ড।”
বিজেপি একা নয়। বামফ্রন্ট আমলে বিনয় কোঙার বা অনিল বসু কী বলেছিলেন, তা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে কদর্যতার দৃষ্টান্ত হিসেবে লেখা আছে। তৃণমূলের অনুব্রত মণ্ডলের নামও লেখা আছে। তবে লক্ষণীয়, অন্য দলে এই সব যাঁরা বলেন, তাঁরা সাধারণত প্রধান নেতাদের মধ্যে পড়েন না, এবং কমল নাথের মতো দলের প্রধান নেতা মেয়েদের প্রতি বিদ্বেষমূলক কথা বললে সেটা নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়, দলের বাইরে তো বটেই, দলের ভিতরেও। বিজেপি কিন্তু এ দিক দিয়ে সত্যিই আলাদা। তাদের প্রধান নেতারা প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরি করতে পারেন— দলের ভিতরে, দলের বাইরেও। এই ভদ্রতাবিরোধী কদর্য সমাজটাকেই তাঁরা মূলস্রোত করে দিতে পারেন। তাই একের পর এক এই সব বাক্য বলে যান নরেন্দ্র মোদীরা—প্রচারমাধ্যম চুপ করে থাকে, নাগরিক সমাজ রব তোলে না। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভাবে কোনও কোনও ব্যক্তি নিভৃত ব্যক্তিপরিসরে গাঁইগুঁই করেন, বিরক্তি প্রকাশ করেন, এইটুকুই। উপরে, বাইরে, সব নিস্তব্ধ।
যেন এমনটাই হওয়ার কথা। যেন প্রধানমন্ত্রীর বলারই কথা যে— সনিয়া গাঁধী ‘জার্সি কাউ’, প্রিয়ঙ্কা গাঁধী ‘হাইব্রিড কাফ’, কিংবা সুনন্দা পুষ্কর শশী তারুরের ৫০-কোটির গার্লফ্রেন্ড, কিংবা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেমন “মহিলা হয়েও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেন”। বাবুল সুপ্রিয়র মতো অতীত সাংসদ, ভবিষ্যৎ বিধায়ক, হয়তো-বা রাজ্যের ভবিষ্যৎ মন্ত্রী, বলেন, বাংলা নিজের মেয়েকে চাইবে কী করে, মেয়ে তো অন্যের সম্পদ। (নিজের মেয়ে থাকলেই যদি নারীর সম্মান হৃদয়ঙ্গম হত, এ দেশে কন্যাশিশু হত্যা, কন্যা পাচার, বধূনির্যাতন, রেকর্ড সংখ্যক ধর্ষণ ঘটত কি?) শুভেন্দু অধিকারী বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বেগম, তিনি মিনি পাকিস্তান বানাচ্ছেন। এই নেতারা এবং তাঁদের সমর্থকরা অনবরত মুখ্যমন্ত্রীর শাড়ির দাম, চটির দাম নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেন। উঁহু, এ কেবল তৃণমূল রাজনীতির বিরোধিতা নয়, সেটা হলে ‘ভাইপো’-র পাঞ্জাবির দামও উঠত। এ হল ‘শাড়ি’র— এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ‘শাড়ি’র— প্রতি দুর্নিবার বেগে ছুটে-আসা ভারতীয় পুরুষের ঘৃণা-অপমান-লাঞ্ছনার তির। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সংস্কৃতির মতো এই ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’র সংস্কৃতি কেবল ‘পুরুষতান্ত্রিক’ বললে সবটা বলা হয় না, এ হল নির্লজ্জ পুরুষ-আধিপত্যবাদী, দুর্দমনীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি বিরোধিতা: বিনয়-ভদ্রতা, বিবেচনা-বিবেক ইত্যাদি সবই যার কাছে ন্যাকামি, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা যাদের কাছে দ্রৌপদীরই চরিত্রহীনতা, মেয়েদের ধর্ষিত হওয়া মেয়েদেরই অপরাধ।
সংক্ষেপে, এ হল ক্ষমতার গল্প, ঘিনঘিনে হাসি মুখে নিয়ে চোখে চোখ রেখে ক্ষমতার পৌরুষদাপট দেখানোর গল্প। একটা রাজনীতির গল্প।
যা বলে লেখাটা শুরু করেছিলাম, দেখছি তার উল্টো কথাতেই শেষ পর্যন্ত ফিরতে হল— হ্যাঁ, অন্য কিছু নয়, এটা রাজনীতিরই গল্প। দিলীপবাবু যা-ই বলুন না কেন, সমাজ আসলে ‘একটা’ নয়, ‘অনেকগুলো’। তাঁর চোখের সামনেই। তিনি এবং তাঁরা দেখতে না চাইলেও। তাঁদের ‘কিছু এসে যায় না’ বলে সেই অন্য সমাজগুলো মিথ্যে হয়ে যায় না। এবং একটা অর্বাচীন নির্লজ্জ অভদ্রতা-নিমজ্জিত সমাজের ‘সংখ্যা’র জোর বেশি হয়ে গেলেও বাকি সমাজগুলো হাওয়া হয়ে যায় না। সবাই থাকে। মহিলারা থাকেন, দলিতরা থাকেন, সংখ্যালঘুরা থাকেন। দিলীপবাবু, শুনছেন তো? আপনি যখন ‘সমাজের সঙ্গে’ আছেন বলে বড়াই করছেন, মহিলাদের অপমান করছেন, শিক্ষিত বাঙালির ভদ্রতাকে ন্যাকামি বলছেন, যখন বলছেন সুযোগ পেলেই আমরা নাকি ‘মহিলা হয়ে যাই, দলিত হয়ে যাই, সংখ্যালঘু হয়ে যাই’— তখনও কিন্তু এই ‘অন্য সমাজ’গুলো আপনাদের দেখছে, আপনাদের বিচার চলছে। এটাও একটা ‘সত্য’।
আর হিসেব বলছে, ভারতের মতো দেশে সেই অন্য সমাজটার কাছে কিন্তু আরও বড় সংখ্যার জোর আছে! এখন না থাকলেও পরে। বর্তমানে না হলেও ভবিষ্যতে। সত্যটাকে না দেখে যাঁরা নির্বোধ আস্ফালন করেন, সমাজের একটা বিরাট অংশকে সমাজ বলেই মানেন না, শেষ পর্যন্ত তাঁদের কী হয়— ইতিহাস দেখিয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy