বার্ধক্যের আর্থ-সামাজিক অবস্থান দেখতে নানান অনুপাত ব্যবহার করা হয়। তার মধ্যে একটি হল নির্ভরশীলতার অনুপাত। প্রতীকী ছবি।
আমরা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক শক্তি হতে চাই। কিন্তু তা কিসের জন্য? এবং কাদের স্বার্থে? এ ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই যে সাধারণ নাগরিকের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি করতে অন্যতম প্রাথমিক শর্ত হল দেশের আয় বৃদ্ধি করা। তবে সেটাই কিন্তু একমাত্র শর্ত নয়। এরই সঙ্গে প্রয়োজন দেশের সেই আয়ের সুষম বণ্টনের জন্য দক্ষ আর্থিক ব্যবস্থাও। আর দ্বিতীয় শর্তে এসেই যে আমরা মুখ থুবড়ে পড়েছি তা কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানান তথ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। তবুও আমরা সেই তথ্য ঝেঁটিয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চাইছি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এই বৃদ্ধির ফল তো কেউ না কেউ ভোগ করবে। তাহলে তারা কারা? দেশের সাধারণ মানুষ যে খুব সহজেই তার ফল ভোগ করতে পারবে না তা কিন্তু বলে দিচ্ছে পরিসংখ্যানই।
যেমন ধরা যাক দেশের প্রবীণ নাগরিকদের অবস্থা। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে ২০২১ সালে দেশে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের একটু বেশি। এই সংখ্যা ২০৩১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ১৯ কোটি ৪০ লক্ষতে। যা ভারতের সেই সময়কার জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের একটু বেশি হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রক্ষেপ অবশ্য একটু কম, ১২.৫ শতাংশের মতো। আর তার কয়েক বছর আগেই ভারত আর্থিক প্রক্ষেপ অনুযায়ী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম আর্থিক শক্তি হয়ে যাবে!
কিন্তু জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের মতো এই প্রবীণদের কী হবে? বর্তমান প্রবণতা চালু থাকলে এর উত্তর একটাই। অসহায়তা বাড়বে।
বার্ধক্যের আর্থ-সামাজিক অবস্থান দেখতে নানান অনুপাত ব্যবহার করা হয়। তার মধ্যে একটি হল নির্ভরশীলতার অনুপাত। এই অনুপাতকে দেখা যেতে পারে দেশের কর্মরত নাগরিকের প্রবীণদের নির্ভরতা দেওয়ার ক্ষমতার সূচক হিসাবে। এই অনুপাত যত কম থাকে তত ভাল। আর এটা বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে প্রবীণদের আর্থিক অসহায়তা বৃদ্ধি পাওয়া। অন্যভাবে বললে, নবীনদের বাবা-মাকে সাহায্য করার আর্থিক ক্ষমতা কমতে থাকা। যে ভাবেই দেখা যাক এই অনুপাত বৃদ্ধি কিন্তু দেশের আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধিরই আর এক ইঙ্গিত।
আর আমরা যদি ভারতের এই অনুপাতকে ১৯৬১ সাল থেকে দেখতে থাকি, তাহলে দেখব যে এই অনুপাত বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক কালে বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত গতিতে। অর্থাৎ দেশের সমবৃদ্ধির লাভ এড়িয়ে যাচ্ছে সাধারণ নাগরিকের পকেট। দেখে আরও এগোনোর আগে দেখে নেওয়া যাক ১৯৬১ সাল থেকে এই নির্ভরতার অনুপাতের চল।
নির্ভরতা অনুপাত (শতাংশে):
১৯৬১– ১০.৯
২০১১– ১৪.২
২০২১– ১৫.৭
২০৩১ (প্রক্ষেপ)– ২০.১
অর্থাৎ দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে বার্ধক্যের অসহায়তা। ১৯৬১ সাল থেকে এই অনুপাত ২০১১ সাল পর্যন্ত যে হারে বেড়েছে তা ছাড়িয়ে যাবে আগামী আট বছরেই! তাহলে উন্নয়ন বলতে কী বুঝব? এতদিন তো জেনে এসেছিলাম উন্নয়ন মানে সাধারণ নাগরিকের সুখ এবং স্বাচ্ছন্দের বৃদ্ধি। কিন্তু দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে যদি সাধারণের অবস্থার উন্নতি না হয় তাহলে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে কি? এর মানে তো এই বৃদ্ধির সুফল ভোগ করবে মুষ্টিমেয় কয়েক জন!শুধু তাই নয়,তা হবে সাধারণের আর্থিক অসহায়তার মূল্যে।
তার মানে এই নয় যে আমরা চাইব দেশের বৃদ্ধির হার কমুক। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও চাইব যে প্রবীণ নাগরিক যাঁরা কোনও না কোনও পেনশন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের সময়ের সঙ্গে আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থার কথা ভাবা শুরু হোক। মাথায় রাখতে হবে যাঁরা বিভিন্ন পেনশন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের এখন গড় আয় মাসে মাত্র ১০ হাজার টাকা। আর তাই প্রবীণদের হাতে যে টাকাই মাসের শেষে আসুক না কেন, তাঁদের নির্ভর করতে হয় অন্যের সাহায্যের উপর। তথ্য বলছে দেশের প্রবীণদের ৬৫ শতাংশ তাঁদের দৈনন্দিন দিন যাপনের জন্য অন্যের আর্থিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল! আর প্রবীণদের এক তৃতীয়াংশ মাত্র আর্থিক ভাবে পরনির্ভর নন! তাই কর বণ্টন নিয়ে ভাবতে হবে।
আমরা যে সব দেশকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাই, সেই সব দেশেও কিন্ত প্রবীণ নাগরিকদের পেনশন ব্যবস্থা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে।
এই দুর্দশার পিছনে অনেকটাই রয়েছে আমাদের অসংগঠিক শিল্পের উপর নির্ভরতা। কেন্দ্রীয় শ্রম দফতরের তথ্য বলছে কৃষি-সহ অন্যান্য সব শিল্প ক্ষেত্র মিলিয়ে ভারতের শ্রমশক্তির ৫২ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত। তাঁদের আয় এতই কম যে সঞ্চয়ের জন্য উদ্বৃত্তের কথা ভাবতেই পারেন না তাঁরা। একই সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত থাকার জন্য কর্মক্ষেত্রে যে ভবিষ্যনিধির মতো সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ সংগঠিত ক্ষেত্রে রয়েছে সেই সব সুযোগ থেকেও এঁরা বঞ্চিত।
‘আর্থিক বিকাশ’ এই শব্দবন্ধ এখন নানান মঞ্চ থেকেই উঠে আসছে। কিন্তু বিকাশ বলতে কী বুঝছি তা কিন্তু কোথাও স্পষ্ট করে কেউ বলছেন না। রাস্তা, উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা, হাসপাতাল, আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ, সবই জরুরি। কিন্তু পাশাপাশি, সেই সুযোগ নেওয়ার সক্ষমতাও তো তৈরি হওয়ার দরকার। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়াই এক ঝকমারি। কারণ চাহিদার তুলনায় পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা।
আমাদের দৈনন্দিন মধ্যবিত্ত জীবনেও তো এই সমস্যা তাড়া করে ফেরে। হাসপাতালে ভর্তি বৃদ্ধ পিতা। কিন্তু বিমার টাকায় চিকিৎসার খরচ মিটছে না। কারণ, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রিমিয়াম বাড়ে। এবং তা সাধ্যের বাইরে চলে যায়। তাই বিমার অঙ্ক কমাতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচের যা কণামাত্র। তাই হাসপাতাল থেকে ছাড়ানোর সময় সঞ্চয় ভাঙিয়ে, ঋণ করে আর্থিক ভাবে আরও অসহায় হয়ে পড়তে হয়।
মোদ্দা কথাটা কিন্তু সোজা। দেশের বৃদ্ধি না হলে সাধারণেরও আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। কিন্তু সেই পরিবর্তনের পিছনে যে কোনও দেশেই সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ জরুরি। বাজার ব্যবস্থা এর সুষ্ঠু সমাধান করতে পারে না তা কিন্তু বাজারি অর্থনীতির তত্ত্বও মানে। কিন্তু আমরা শুনছি না কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy