স্মরণ: ঢাকার রায়েরবাজারে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। উইকিমিডিয়া কমন্স
বাংলাদেশ দু’টি দিন এমন ভাবে পালিত হয় যা অনন্য। ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস, আর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এই নামকরণেরও বিশেষ তাৎপর্য আছে। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস নামে কোনও দিবস পৃথিবীর আর কোথাও পালিত হয় না। ঠিক বিজয়ের আগে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস কেন? এর কারণ, ডিসেম্বরের ৩ তারিখ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সুনির্দিষ্ট ভাবে ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পৃথিবীতে এ রকম নৃশংস ঘটনা খুব কম ঘটেছে। বাংলাদেশ আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বস্তুত, ১৯৪৮ থেকে এখন পর্যন্ত এ দেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের শুরুটা হয়েছে তাঁদের প্রতিবাদ দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। বুদ্ধিজীবীদের এই অবদানের কথা স্মরণ করতেই ১৪ ডিসেম্বর পালিত হয় বুদ্ধিজীবী দিবস।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর পরই মানুষ বেরিয়ে পড়েন খোঁজ না পাওয়া স্বজনদের খোঁজে। আবিষ্কৃত হয় রায়েরবাজার বধ্যভূমি। মিরপুর বধ্যভূমি— “আর একটু এগিয়ে যেতেই সামনে বড় বড় দুটো মস্ত মানুষ, নাক কাটা, কান কাটা, মুখের কাছ থেকে কে যেন খামচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে হাত-পা বাঁধা...”
“আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই। কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা।... মেয়েটি সেলিনা পারভীন। শিলালিপির এডিটর।...”
ঢাকার রায়েরবাজারের বধ্যভূমি দেখে এসে এই প্রতিবেদন লিখেছিলেন অধ্যাপিকা হামিদা রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী এক বছর খবরের কাগজের পাতা ওল্টালে এ ধরনের প্রচুর বধ্যভূমির খবর জানা যাবে। এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল স্বাধীনতার বিরোধীরা যাদের প্রধান অংশ ছিল জামাতে ইসলামের কর্মীরা। এদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল রাজাকার বাহিনী, ডেথ-স্কোয়াড নামে খ্যাত আলবদর ও আলশামস বাহিনী।
কিন্তু ভুলে যাওয়ার এক অসম্ভব ক্ষমতা আছে বাঙালির। আমার সামনে ১৯৭১-৭২’এর পত্রিকার বিবর্ণ কিছু সংখ্যা। প্রতিটি পাতায় পাতায় হারিয়ে যাওয়া, খুন হওয়া মানুষের খবর, খুনিদের তালিকা, বিচারের দাবি আর সরকারি প্রতিশ্রুতি। তৃতীয় বছর থেকে এ সব খবর কমতে থাকে এবং এক সময় তা সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠে ২৫ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর সংখ্যায়। মনে হতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খুনিদের বিচার না-হওয়া, সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠা করা, তাদের মিত্র করা কি সত্যই স্বাভাবিক হতে পারে?
পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করেছিল কেন? এর একটি কারণ, পাকিস্তানি শাসকচক্র বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ও প্রভাবকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের ধারণা ছিল, এই শ্রেণির প্রেরণাদাতা হচ্ছেন বুদ্ধিজীবীরা। জেনারেল ফজ়ল মুকিম খান ১৯৭৩ সালে লিখেছিলেন, বাঙালিদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ষাটের দশকে সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে মানুষকে প্রভাবিত করে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১, এমনকি ১৯৭১ থেকে এখন পর্যন্ত সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংস্কৃতিসেবীরা সত্যই অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকরা তা ঠিকই লক্ষ্য করেছে। ফলে, তাদের বিশেষ ক্রোধ ছিল বুদ্ধিজীবীদের উপর।
আর একটি কারণ হল, যদি বাঙালিরা জিতেই যায়, তারা যেন নেতৃত্বহীন থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে প্রদত্ত যুক্তিটি লক্ষণীয়: “এটা অবধারিত হয়, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাঁদের রচনাবলির মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়গুলোতে পাঠদানে, চিকিৎসা প্রকৌশল রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে। একটি জাতিকে নির্বীর্য করে দেওয়ার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেওয়া। ২৫ মার্চ রাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে, তার পর ধীরে ধীরে, শেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বর ১০ তারিখ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুতগতিতে।”
কত জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল? সঠিক হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নে আমরা ব্যস্ত থেকেছি, কিন্তু কারা শহিদ হলেন, খুনি কারা, সেই তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যে কাজ হয়েছে তা হয়েছে বেসরকারি ভাবেই। প্রথম উদ্যোগ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত রশীদ হায়দার সম্পাদিত শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষ। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের উপর বাংলা একাডেমিই প্রথম ছোট একটি প্রদর্শনী করেছিল। কিন্তু এই বিষয়ে বড় কোনও কাজের উদ্যোগ হয়নি।
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচয় নিয়ে যে সব সঙ্কলন হয়েছে তাতে শহিদদের সংখ্যা পাঁচশোর বেশি হবে না। বছরখানেক হল বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এখানে প্রথমেই বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা ঠিক করা হয়। বাংলাদেশ সরকার দু’দশক আগে বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ডাকটিকিট প্রকাশ শুরু করে। কিন্তু স্মৃতি তর্পণের এই উদ্যোগ আচমকা বন্ধ হয়ে গেল, কেন, তা জানি না। এবং, ডাকটিকিটের উদ্যোগটি চমৎকার হলেও এর পিছনে সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা ছিল না। মন্ত্রণালয়ের কাজের গতিও শ্লথ; এ পর্যন্ত দু’দফায় কমিটি ৩৯৩ জনের নামের তালিকা প্রণয়ন করেছে যা গেজেটভুক্ত হয়েছে।
‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সংজ্ঞা মেনে। কিন্তু প্রধান বাধা হচ্ছে তথ্যের অভাব। গ্রামের গড়ন বদলে গেছে। ১৯৭১-এ যাঁরা গ্রামে ছিলেন, হত্যাযজ্ঞ দেখেছেন তাঁদের বড় একটি অংশ এখন আর গ্রামে নেই। তার পরও খোঁজখবর নিয়ে নাম পাওয়া যাচ্ছে অনেকের। এ গবেষণা যদি আমরা অব্যাহত রাখতে পারি, অনেক নাম তালিকাভুক্ত করা যাবে। অনুমান করতে পারি, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদররা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়েছিল। ৫২ বছর আগে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ছিল কম। এঁদের বড় একটি অংশ শহিদ হয়েছিলেন, যার ফলে সত্যিই শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায়। এ দুই পর্যায়ে শিক্ষায় এমন শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল যে, কয়েকটি প্রজন্মের শিক্ষার মানের অবনতি হয়েছিল, যার প্রভাব পড়ে জাতীয় জীবনে। উচ্চতর পর্যায়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। বাংলাদেশে শিক্ষার পরিধি বেড়েছে বটে, শিক্ষার মান গড়পড়তা খুব বেড়েছে এমন বলা যাবে না।
অনেকে বলেন, এত বছর পর আজ কেন আমরা হত্যার বিচার দাবি করি। যাঁরা এ কথা বলেন, ধরে নিতে হবে তাঁরা স্বজনহারা হননি। বাংলাদেশের অগণিত শহিদের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধাবোধ নেই এবং তাঁরা পরোক্ষ ভাবে যুদ্ধাপরাধী ও বর্তমানে সারা বিশ্ব জুড়ে যে উগ্র মৌলবাদী আন্দোলন চলছে তার সমর্থক। যুদ্ধাপরাধী তো বটেই, এঁদের প্রতিরোধও বাঞ্ছনীয়। এক ব্রিটিশ মন্ত্রী বলেছেন, যে জাতি তার অতীত ভুলে যায় তার কোনও ভবিষ্যৎ নেই, কারণ সে তার আত্মপরিচয় হারায়।
শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যা নয়, সামগ্রিক গণহত্যার বিচারের দাবি এগিয়ে নিয়ে গেছে নির্মূল কমিটি। শেখ হাসিনা সরকার বিচার শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের ৪৯টি রায়ে মোট ১২৭ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ফাঁসি হয়েছে ৬ জনের। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত ও কিছু ধর্মীয় দল এ বিচার সমর্থন করেনি। তারা শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন ও বিচারে কতটা আগ্রহী হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অন্য দিকে, সরকারও যে ভাবে হত্যার বিচার শুরু করেছিল, এখন তাতে শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। আবার, রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হলেও মামলা করছে তাদের উত্তরাধিকারীরা। এ ক্ষেত্রেও আইন প্রণয়নের ব্যাপার আছে। তবে ঘটনাপরম্পরা প্রমাণ করে, বাংলাদেশে কোনও রাজাকার আলবদর পরিবারের কেউ ক্ষমতাশালীও অর্থবান হলেও সমাজ তাকে সম্মান দেয় না। শহিদ পরিবার নিঃস্ব হলেও সম্মান দিতে সমাজ কার্পণ্য করে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy