আবার একটি নদীকে ‘সুবিধেমতো’ চালানোর ইচ্ছা। আর তার পরিণাম। ইতিমধ্যে প্রায় সবাই জানেন, জলপাইগুড়ি জেলায় ডুয়ার্সের অন্যতম বড় নদী মাল-এর গতিধারার মাঝখানে মাটি পাথর ইত্যাদি দিয়ে আড়াআড়ি বাধা নির্মাণ করে পাশে খুঁড়ে দেওয়া নতুন ধারাতে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা হয়েছিল। ৫ অক্টোবর বিকেলে লোকজন, ট্রাক, সুসজ্জিত প্রতিমা জড়ো হওয়া শুরু হয়। উপরে পাহাড়ি এলাকায় আগে থেকে বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। তার সরকারি পূর্বাভাসও ছিল। প্রায় ওই সময়েই নদী বেয়ে ঝড়ের গতিতে বিপুল জল নেমে আসে। কয়েক মিনিটের মধ্যে, কোনও প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই, প্রচণ্ড ধারার মুখে সব ভাসান আয়োজন ভেসে যায়। উৎসবে যোগ দিতে আসা বহু মানুষ মারা যান। অনেকে নিখোঁজ।
একে এক প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ধরে নিয়ে শোকগ্রস্ত হওয়া যেত যদি, তা হলে জনসমক্ষে কথা বলার দরকার ছিল না। কিন্তু এই দুর্ভাগ্য আরও কতকগুলো ভীতিজনক ঘটনা সামনে নিয়ে এল। স্থানীয় ভাবে জানা গেল, এই ব্যবস্থাটি নাকি ‘অনেক দিন ধরেই’ ওখানে প্রচলিত। কী উপায়ে, কোন নীতিতে, কোন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমন ব্যবস্থা ‘প্রচলিত’ থাকে, সেটা জানার দাবি থাকেই। নদীর ধারে বসবাস করা মানুষদের কোনও ভয় বা আপত্তিকে কখনও গ্রাহ্য করা হয়েছিল কি না, সেটাও জানার বিষয়। ডুয়ার্সের নদীগুলি সম্পর্কে যাঁদের সাধারণ ধারণাও আছে তাঁরা জানেন, আচমকা তীব্র স্রোতে জলস্ফীতি অর্থাৎ ‘হড়পা বান’ এদের স্বভাব। মধ্য বা নিম্ন হিমালয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতের জল এরা তীব্রধারায় নীচে অপেক্ষাকৃত সমতলে পৌঁছে দেয়। ঢাল কমে আসার দরুন সমতলে জলস্রোতের তীব্রতা হ্রাস পায়, তা অনেকটা জায়গা ধরে ছড়িয়ে স্বাভাবিক বন্যার কারণ হয়। হিমালয় মাটির পাহাড়, বনাচ্ছাদন বেশি হওয়ার কারণে এই পর্বতে বৃষ্টিজনিত ভূমিক্ষয় কিছু বাধা পায়। পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে নেমে আসা জল ছোট-বড় নদীখাত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমতলে নামে। পাহাড়ের পাদদেশের ক্ষতি অনেক কম হয়। পাদদেশের ঘন বনে বর্ষার জল গচ্ছিত থেকে এলাকার ছোট-মাঝারি নদীগুলির মাধ্যমে সমভূমিরও প্রধান হিমালয়জাত নদীদের প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। উত্তর বিহারের কোশী অববাহিকা থেকে পূর্বের জয়ন্তীয়া পর্যন্ত হিমালয়ের পায়ের কাছে যে বিস্তৃত ঘন বনাঞ্চল ছিল, সাধারণ ভাবে তার নাম ‘চারকোশি ঝাড়ি’। চার ক্রোশ বিস্তৃত জঙ্গল। ডুয়ার্স সেই সুরক্ষা বলয়েরই অংশ। প্রকৃতির এই সূক্ষ্ম শৃঙ্খলাকে বোঝার চেষ্টামাত্র না করে প্রযুক্তিদম্ভী কিছু মানুষ সেখানে হস্তক্ষেপ করলে কী হতে পারে, তারই এক মর্মান্তিক উদাহরণ স্পষ্ট হল।
নদীর অস্তিত্বের প্রথম নিয়ম হল, তা একটি চলন্ত সজীব জলধারা। এক জায়গায় পতিত অনেকখানি জলকে সে অপেক্ষাকৃত নীচের দিকে বইয়ে দেয়। এই কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ভূমির নিম্নতম জায়গাটি দিয়েই জল প্রবাহিত হয় এবং চলতে চলতে নীচের ভূমি ক্ষয় করার মাধ্যমে সে ওই নিচু জায়গার গভীরতা ক্রমশ বাড়িয়ে তোলে। ব্যাপারটা এক-দুই বছরের নয়, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলতে থাকে। সেই দীর্ঘ কাল ধরে কোনও নির্দিষ্ট স্থানের জল-মাটির সংস্থান হয়।
কয়েক মিনিট স্থায়ী এক প্রলয়কাণ্ডের সঙ্কটকালে দাঁড়িয়ে আজ এই পুরনো কথাগুলো বলতে হচ্ছে, কারণ অনেক জানার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে এই প্রাথমিক জ্ঞানের প্রতি আমাদের বিশ্বাস থাকে না। একটি জীবন্ত নদীর ধারার উপরে একটা আড়াআড়ি পাঁচিল বা কেটে দেওয়া খাতের যে কোনও অর্থ নেই, এ কথা মনে রাখলে লিস, ঘিস, মালের মতো ডুয়ার্সের এই নদীগুলিকে হয়তো আমরা আর একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখতাম। কিন্তু তার বদলে শোনা গেল অন্তত মালবাজারে নাকি এ ভাবে কয়েক বছর ধরেই ভাসান চলছে। প্রশাসনিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা বাদ দিলেও, এই ‘অনেক দিন’-এর মধ্যেও কি কারও মনে আসেনি ওই বিচিত্র নিয়ম প্রবর্তনের বিপদ, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার কথা? প্রবাদে আছে ‘সোঁত মরলেও রেখ মরে না’— কোনও নির্দিষ্ট খাতে নদীর ধারা যদি শুকিয়েও যায়, তবু লক্ষ বছরের জল চলাচলের রেখাটি রয়ে যায়। ধারা যে কোনও সময়েই সেখান দিয়ে পুনঃপ্রবাহিত হতে পারে। এটি নদীধারার নিয়ম। নদীর এ পথ বন্ধ করে ওই দিক দিয়ে তাকে বইয়ে দিলাম, তাতে সুবিধা হল— এই স্পর্ধাপূর্ণ ভাবনার মূল কারণ প্রাকৃতিক নিয়মগুলির মূল জায়গাকে অগ্রাহ্য করা। ‘অনেক দিন ধরে’ এই কাজ করা ও তা দেখা অবৈজ্ঞানিক, চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক।
এ কাজ যে এমন অনায়াসে হতে পারে, তার একটা বড় কারণ কি এই নয় যে শুধু মাল নয়, তরাই-ডুয়ার্সের প্রায় প্রতিটি নদীর প্রাকৃতিক সংস্থান অগ্রাহ্য করে যথেচ্ছ বালি ও বোল্ডার তুলে নেওয়া একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে? নদীগুলি নেমে আসার পথে পাথরে পাথরে ধাক্কা খায় বলে এরা পাশের পাহাড়ের গায়ে ধস ঘটায় কম। মূর্তি থেকে বালাসন, রঙ্গিত, লিস, ঘিস, ছোট-বড় প্রতিটি নদী থেকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বোল্ডার তুলে বিক্রি করা, যথেচ্ছ জঙ্গল ছেদন, নদীর কিনার ঘেঁষে নির্মাণ— কোনও নিষিদ্ধ ভয়ঙ্কর কাজের উপরেই কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। হয়তো দেখা যাবে তেমন কোনও ধসই সাম্প্রতিক ‘বান’কে আরও বিধ্বংসী করেছে। একটা বিপদের ঘটনা ঘটলে কয়েকদিন আলোচনা হয়, পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজের কিছু লাভের কথা ভাবা হয়, তার পর যা চলছিল তা-ই চলে, যত ক্ষণ না আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটে। এগুলোকে দুর্ঘটনা অর্থাৎ আকস্মিক অনিবার্য বিপদ বলা যায় কি না, আমি নিশ্চিত নই। প্রাকৃতিক সংস্থান ব্যবহারের নিয়মাবলি মেনে চললে এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই অনেক বিরল হবে, কিন্তু আমরা চলেছি যেন তেন প্রকারেণ ‘লাভ’ করার উন্নয়নপথে। তাতে কী কী হারাল, দাঁড়িয়ে দেখার বা ভাবার অবসরের বড় অভাব। নিজে ছিটকে যাওয়ার মুহূর্তেও থামা যায় না, পিছিয়ে পড়ার ভয়ে।
সবচেয়ে বীভৎস, এ রকম সময়েও কোনও রাজনৈতিক দলের মুখে সহানুভূতিসূচক শোকবাক্য শোনা গেল না। ‘যা ঘটেছে তা মর্মান্তিক দুঃখের, আমরা শোকার্ত পরিবারগুলিকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি’ এই ভদ্রবাক্যটুকু শাসক দল কি বিরোধী, কারও মুখে শোনা গেল না। আমরা যে বিভিন্ন দলের উপর দেশের বা রাজ্যের পরিচালন ব্যবস্থার দায়িত্ব দিই, তারা কি মানবিকতার বোধ এতটাই হারিয়েছে? সঙ্কটের তিন ঘণ্টার মধ্যেই দেখলাম তারা পরস্পরকে দোষ দিতে এমন উগ্র উৎসাহী যে, কী করলে ভবিষ্যতে এমন ভয়াবহ ঘটনা আর ঘটবে না, সে সম্পর্কে একটা কথাও কেউ বলল না। ‘যারা দায়ী তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না কেন?’ এক দিকে এই দাবি, অন্য দিকে অতি দ্রুত ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক ঘোষণা— আতঙ্কিত, আহত, মৃত মানুষদের কি এর চেয়ে বেশি কিছু হয় না? যাঁরা আজ শাস্তি দাবি করছেন, কোনও সামাজিক দায়িত্বের একটিও শব্দ উচ্চারণ ব্যতিরেকে এই মর্মান্তিক ঘটনাকে শুধু নিজেদের সুযোগের পাদপীঠ হিসেবে ভাবছেন, তাঁদের মধ্যে কারা কারা ঘোষণা করবেন যে, তাঁরা ক্ষমতায় এলে এ ধরনের প্রকৃতিবিরুদ্ধ বিপজ্জনক কাজ বন্ধ করবেন? হিমালয় থেকে পশ্চিমঘাট, মাল নদী থেকে গঙ্গা-যমুনা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র নদীজননীরা যেন এ দেশ থেকে বিসর্জনে না যান, দেশের সেই নিরাপত্তাটুকুর প্রতিশ্রুতি দেবে কোন শাসক দল? পৃথিবী স্বয়ং তাদের অপেক্ষায়। অসহ্য দুঃখের মূল্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy