Advertisement
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Gender Identity

‘কী করবা? এমনই থাকবা?’

আসলে, ‘সবাই’ একটা বিষয়ে খুব কম জানে। এবং কম মানে। সেটা হল— মানসিক লিঙ্গবোধ জন্মগত লিঙ্গচিহ্ন থেকে ভিন্ন। এই মনের গড়নটাও শারীরবৃত্তীয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জন্মগত।

সুমনা ঘোষদস্তিদার
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২৪ ০৬:০০
Share: Save:

বর্ষার জলভারে কদমের ডাল নুয়ে পড়েছে ক্লাসের জানলায়, পাতা গড়িয়ে জল চুইয়ে পড়ছে ছাত্রটির ডেস্কে রাখা হাতে। বার বার বাইরে চলে যাচ্ছে তার দৃষ্টি, ঝাপসা হয়ে আসছে চার ধার। আলতো হাতে কপালে পড়ে থাকা চুল সরিয়ে গালে হাত রেখে একটু বেঁকে বসেছে। ওর বসা, হাঁটা, কথা বলার ভঙ্গি, আচরণ অন্য বন্ধুদের মতো নয়। সবাই বলে, সে ‘মেয়েদের মতো’। তার প্রতি দিনের হাসি-কান্নাও সে মেয়েদের সঙ্গে ভাগ করতেই স্বচ্ছন্দ। স্কুলের যে কোনও অনুষ্ঠানে মেয়েদের চুলে বিনুনি বাঁধা থেকে নিখুঁত ভাবে কাজল, লিপস্টিক পরানোর ভারটুকু নিতে ভালবাসে সে। নিজেও ভালবাসে কাজল পরতে, ঠোঁট রাঙাতে, ওড়না নিয়ে সাজতে। অন্য ছেলেমেয়েরা ব্যঙ্গ করে, মুখ টিপে হাসে। তার নামকে স্ত্রীলিঙ্গে পরিবর্তন করে সম্বোধন করে। আজকাল ছেলেবেলার খেলাঘরের বন্ধু সেই ছেলেটি এসে তাকে বুকে টেনে নিলে, তার শিহরন জাগে।

একই অবস্থা ছোট শহরের ওই মেয়েটির, যে ছেলেদের কাঁধে হাত রেখে চলতে, বলতে স্বচ্ছন্দ, যে শিক্ষকের কাছে বার বার অনুমতি চায় স্কার্ট-টপ নয়, প্যান্ট-শার্ট পরে আসার জন্য, ক্লাসে ছেলেদের মাঝে বসতে চায়। বিজয়ী হলে ছেলেদের মতো তারও ইচ্ছে হয় শার্ট খুলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের মতো অকারণ লজ্জা নেই শরীর জুড়ে। কোনও বান্ধবী যখন মেঘরঙা শাড়ি পরে গজদাঁতে হাসি তুলে তার গায়ে এলিয়ে পড়ে, তার ঝিম ধরে। সে হাসির রেণু উড়তে থাকে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। কিন্তু শুধু ক্লাসে নয়, রাস্তাঘাটে, চলতে-ফিরতে, সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে। সে দেখাটা তাকে বিব্রত করে, ভাল লাগায় না।

আসলে, ‘সবাই’ একটা বিষয়ে খুব কম জানে। এবং কম মানে। সেটা হল— মানসিক লিঙ্গবোধ জন্মগত লিঙ্গচিহ্ন থেকে ভিন্ন। এই মনের গড়নটাও শারীরবৃত্তীয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জন্মগত। জানা এবং মানার অভাবে, হাসি ব্যঙ্গবিদ্রুপে ক্ষতবিক্ষত আমরা করে চলি তাদের মন, শরীরও।

বাংলাদেশের পারভীন সুলতানা, চারুকলায় স্নাতক। সে বলেছিল, “আমি মেয়ে হলেও হাবে ভাবে এবং মনে ছেলের মতো ছিলাম। স্কুলের স্যররা পর্যন্ত টিজ় করতেন, আমি কিছুই বলতাম না, চুপ করে শুনতাম। ভাবতাম, আমি ভুল? না যারা এ ভাবে দেখছে, তারা ভুল? কত সময় রাস্তার লোকেরা গা-ঘিনঘিনে ইঙ্গিত দিত। বাড়ির লোকেরা বলত, ‘এখন বড় হইছো, কী করবা? এমনই থাকবা?’”

দশম শ্রেণির ছাত্র তমাল জানায়, “ক্লাসে আমার ছেলেদের পাশে বসতে লজ্জা করে, কিন্তু ভালও লাগে, ভালবাসতে ইচ্ছে করে। এ কথা কাউকে জানাতে পারি না। বাবা-মাকেও না!” রোজ রাতে চোখের জলে বালিশ ভেজে ওর। ওড়িশি নৃত্য-গবেষক সৌগত মুখোপাধ্যায় বলেন, “যারা মনে নারী, শরীরে পুরুষ, তারা প্রথমেই পাশে চায় পরিবারকে। সাপোর্ট চায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। মর্যাদা আর সম্মান চায়।” কিন্তু আমাদের সমাজে এদের নিয়ে বিব্রত পরিবার। স্কুলেও বুঝতে পারেন না শিক্ষকরা, এদের নিয়ে কী করা উচিত।।

মন-চিকিৎসক অরুণিমা ঘোষ বলছিলেন, “শরীরে পুরুষ কিন্তু অন্তরে নারী, বা উল্টোটা, এই বিষয়টা যখন ছেলেমেয়েরা বুঝতে শুরু করে তখন অত্যন্ত দ্বিধা, মন খারাপ তাকে বহন করতে হয়... মূলত আমাদের সমাজের ‘স্টিগমা’র জন্য। বাবা-মায়েরাও এটা মেনে নিতেই পারেন না। অনেকেই মনে করেন, এটা মানসিক বিকৃতি, হয়তো মারধর বা শাসন করে ঠিক করা যাবে। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধবের থেকেও টিটকিরি শুনতে হয়। ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যেতে পারে। স্কুল সচেতন হলে এই ছেলেমেয়েদের একটা নিরাপত্তাবোধ দিতে পারে। সহানুভূতিশীল হওয়া, তাদের অনুভূতিগুলো শোনা, মান্যতা দেওয়া, মা-বাবাকে বোঝানো এবং নির্দিষ্ট ডাক্তারের কাছে রেফার করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্কুল নিতে পারে।”

আর এক মন-চিকিৎসক স্বস্তিশোভন বললেন, “এরাও কিন্তু কমিউনিটির অংশ, যাকে এখন এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি বলা হয়। ফলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভিন্নধর্মী প্রবণতা লক্ষ করলে, প্রাথমিক ভাবে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা দরকার, এই প্রবণতা যাতে জোর করে পাল্টানোর চেষ্টা না হয়। অভিভাবকেরা মানতে না চাইলে, বা ঘাবড়ে গেলে, হাসপাতালে কাউন্সেলিং-এর জন্য যোগাযোগ করার কথা বলা উচিত। বিভিন্ন হাসপাতাল বয়ঃসন্ধির সময়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করে। এদের সঙ্গে কোনও বিশেষ ব্যবহারের দরকার নেই, কেবল সতর্ক হতে হবে, শিক্ষকদের, অভিভাবকদের, যাতে এদের প্রতি কেউ কোনও বক্রোক্তি করে না ফেলেন। ক্লাসমেটরা বিরক্ত করলে সেটা থেকেও রক্ষা করতে হবে। এটা কোনও ভাবেই মানসিক অসুস্থতা নয়, এক ধরনের মানসিক বৈশিষ্ট্য বা প্রবণতা, সেটা অন্যদের মানতে হবে।”

এটাই আসল সমস্যা। মেনে নেওয়া। আমাদের সমাজ কি সেখানেই বহু বহু যোজন পিছিয়ে নেই? যে যেমন, তাকে তেমন করে গ্রহণ করতে কি আমাদের সমাজ প্রস্তুত হবে, কোনও দিনও?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gender Identity LGBTQ Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE