জননেতা? একনাথ শিন্ডে ও বিক্ষুব্ধ শিবসেনা বিধায়করা বিধানসভায় প্রবেশ করছেন, মুম্বই, ৪ জুলাই। ছবি: পিটিআই
অধিকাংশ বাবা-মা’ই তাঁদের ছেলেমেয়েকে পাড়ার বখাটে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে বারণ করেন। ভয় থাকে, খারাপ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশলে সন্তান বখে যাবে। বখাটেদের দলে মিশে যাওয়া আটকাতে বাবা-মায়েরা অনেক সময় নিজের ছেলেমেয়েকে ঘরে বন্দি করেও রাখেন।
ছোট ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে ভয়টা অমূলক নয়। কারণ তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ, উচিত-অনুচিত, তা বোঝার বয়স হয়নি। অপরিণত বয়সে উচ্ছন্নে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
এ দেশে যাঁরা সাংসদ বা বিধায়ক হন, তাঁরা অপ্রাপ্তবয়স্ক নন। কারণ, লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে লড়তে গেলে অন্তত ২৫ বছর বয়স হওয়া প্রয়োজন। এক-একটি বিধানসভা কেন্দ্র বা লোকসভা কেন্দ্রে লক্ষ লক্ষ ভোটার থাকেন। সেই লক্ষ লক্ষ ভোট ঝোলায় পুরে যাঁরা নির্বাচনে জিতে আসছেন, তাঁদের অপরিণত বলা যায় না। সাংসদ বা বিধায়কদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারও পক্ষে কিছু করিয়ে নেওয়া সম্ভব, এমনটাও মেনে নেওয়া কঠিন।
যদি তা-ই হয়, তা হলে অন্য দল কৌশলে নিয়ে যাবে, এই ভয়ে আমাদের দেশের সাংসদ বা বিধায়কদের হোটেলে বা রিসর্টে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে কেন? তা-ও আবার নিজের রাজ্যে নয়। একেবারে অন্য রাজ্যের হোটেলে। কিসের ভয়? অন্য দল থেকে কেউ এসে তাঁদের ইডি-সিবিআইয়ের জুজু দেখিয়ে বা টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে টেনে নিয়ে যাবে! যাঁরা মানুষের জন্য কাজ করবেন, এলাকার সমস্যার কথা তুলে ধরবেন বলে মানুষ বিশ্বাস করেন, তাঁদেরই ভোট দিয়ে জেতান। তাঁরা কি এতটাই ভিতু ও লোভী? অন্য দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব এলে ‘না’ বলার মেরুদণ্ড তাঁদের নেই?
মহারাষ্ট্রের রাজনীতির মহাপর্বের পরে কংগ্রেস, শিবসেনা, এনসিপি থেকে তৃণমূল, সিপিএমের মতো বিরোধী দল ফের বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলছে। অভিযোগ, বিজেপি গণতন্ত্রকে হত্যা করছে। অন্য দলের বিধায়কদের অর্থের লোভ দেখিয়ে বা সিবিআই-ইডির ভয় দেখিয়ে ভাঙিয়ে আনছে। তার পর অগণতান্ত্রিক পথে বিরোধী শাসিত সরকার ফেলে নিজেরা সরকার গড়ছে। ২০১৯-এ কর্নাটক, ২০২০-তে মধ্যপ্রদেশ, তার আগে উত্তরাখণ্ড, গোয়া, মণিপুর, এ বার মহারাষ্ট্র— তারই উদাহরণ।
বিরোধী শিবিরের নেতারা একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে চান না। তা হল, বিজেপির ডাক এলেই সাংসদ, বিধায়করা সে দলে চলে যান কেন! ক্ষমতার লোভটাই কি শেষ কথা? মতাদর্শ বা নৈতিকতা বলে কিছু নেই? বিজেপি নিজেও এই রোগমুক্ত নয়। সাংসদ-বিধায়করা বিজেপি ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিতে দ্বিধা করেন না প্রয়োজন পড়লে।
মহারাষ্ট্রে সরকার পতনের আগেই রাজ্যসভার নির্বাচন ছিল। শিবসেনা, এনসিপি, কংগ্রেস বিধায়কদের মুম্বইয়ের হোটেলে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বিজেপিও নিজের বিধায়কদের মুম্বইয়ের একটি হোটেলে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল। অর্থাৎ, বিজেপিরও ভয় ছিল তার বিধায়কদের অন্য শিবির ফুসলিয়ে নিয়ে যেতে পারে! গত বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের নেতানেত্রীরা দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় আসতে চলেছে। কিন্তু পরে হাওয়া ঘুরে যেতেই তাঁদের অনেকেই আবার তৃণমূলে ফিরেছেন। বিজেপির এক নেতা যেমন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ে গিয়ে তৃণমূলে গিয়ে যোগ দিয়েছেন। তৃণমূলের টিকিটে বিধায়কও হয়েছেন।
এখানেই প্রশ্ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক দল থেকে অন্য দলে গিয়েও দলবদলু নেতাদের ভোটে জিততে অসুবিধা হচ্ছে না। মধ্যপ্রদেশে যেমন। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার সঙ্গে একাধিক কংগ্রেস বিধায়ক দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন। উপনির্বাচনে জিতে এলেন। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে শুভেন্দু অধিকারীর নন্দীগ্রাম থেকে জিতে আসা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বাবুল সুপ্রিয় মোদী সরকারের মন্ত্রী, বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে টালিগঞ্জে প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়ে হেরে গেলেন। এক বছরের মধ্যে তৃণমূলের টিকিটে বালিগঞ্জ থেকে জিতে বিধায়ক হলেন।
তিনটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। প্রথম, সাংসদ-বিধায়কদের নিজেদের এলাকায় ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে তাঁরা যে দলেই থাকুন, ভোটে জিততে অসুবিধা হয় না। শুভেন্দু অধিকারীর ক্ষেত্রে নন্দীগ্রামে এই যুক্তি খাটতে পারে। বাবুল সুপ্রিয়ের টালিগঞ্জে হেরে বালিগঞ্জে জেতার পিছনে এই যুক্তি খাটে না। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ হল, মানুষ প্রার্থী দেখে ভোট দেন না। রাজনৈতিক দল দেখে ভোট দেন। কে প্রার্থী, সেটা অনেক সময়ই গৌণ হয়ে যায়। বিভিন্ন বুথ ফেরত সমীক্ষাতেও দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যন্ত, পিছিয়ে পড়া এলাকায় মানুষ কোন দলের কে প্রার্থী, তা জানেনই না। তাঁরা শুধু দলের প্রতীক দেখে ভোট দেন।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হল, রাজনৈতিক নেতাদের এই ক্ষমতার লোভে, ইডি-সিবিআইয়ের ভয়ে বা টাকার লোভে দলবদল মানুষের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। এটাই যেন স্বাভাবিক। ভোটাররা মেনে নিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতারা এমনই হয়ে থাকেন। তাই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে, আবার তৃণমূলে ফিরে এসেও নেতাদের ভোটে জিততে অসুবিধা হচ্ছে না।
শিবসেনার বিক্ষুব্ধ বিধায়করা উদ্ধব ঠাকরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে একনাথ শিন্ডের ছাতার তলায় জড়ো হলেন। প্রথমে তাঁদের গুজরাতের সুরাতে নিয়ে যাওয়া হল। তখনই বোঝা যাচ্ছিল, শিবসেনার বিদ্রোহের পিছনে বিজেপির মদত রয়েছে। গুজরাতেও শিবসেনার বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের লুকিয়ে রেখে বিজেপি স্বস্তি পেল না। পশ্চিম ভারত থেকে তাঁদের একেবারে উত্তর-পূর্বের অসমে নিয়ে যাওয়া হল। উদ্ধব ঠাকরে বা শরদ পওয়ার যদি তাঁদের কানে ‘কুমন্ত্র’ দিয়ে ঘরে ফিরতে বলেন, এই ভয়ে বিধায়করা মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিলেন। একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন।
আর ভোটাররা? মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে বা শিবসেনা নেতৃত্বই যদি বিধায়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন, তা হলে এলাকার মানুষ তাঁদের সঙ্গে কী ভাবে যোগাযোগ করবেন? সমস্যায় পড়লে কার কাছে যাবেন? যদি বিপদে পড়ে বিধায়কের সুপারিশ করা চিঠি প্রয়োজন হয়, তা হলে কার কাছে ছুটবেন? এলাকার বিধায়ক অন্য রাজ্যের হোটেলে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন, অতএব তাঁকে জোর করে কেউ কিছু করাতে পারবে না, এই ভেবেই কি আমজনতা খুশি হবেন? তার পরে নির্বাচন এলে আবার তাঁকে ভোট দিয়ে জেতাবেন। যাতে তিনি আবার নিজেকে দাঁড়িপাল্লায় তুলতে পারেন।
আইনত দেশের গণতন্ত্রে দল বদলে কোনও বাধা নেই। দলত্যাগ বিরোধী আইন মেনে তিন ভাগের দুই ভাগের বেশি সাংসদ-বিধায়ক অন্য দলে যোগ দিলে, পদ যাওয়ারও চিন্তা নেই। কিন্তু এখন সেই দলত্যাগ বিরোধী আইনকেও বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। স্পিকাররা চোখ বুজে বসে রয়েছেন। নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে বলে স্পিকাররা একমত হলেও ক্ষমতা কাটছাঁট করছেন না।
এক সময় এই দলবদলু নেতাদের ‘আয়ারাম গয়ারাম’ বলা হত। ১৯৬৭ সালে হরিয়ানার রাজনীতিক গয়ালাল নির্দল প্রার্থী হিসেবে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন। জেতার পরই গয়ালাল কংগ্রেসে যোগ দেন। তার পরে দু’সপ্তাহের মধ্যে গয়ালাল তিন বার দল বদল করেন। কংগ্রেস ছেড়ে নির্দল প্রার্থীদের জোট ইউনাইটেড ফ্রন্ট, ফ্রন্ট ছেড়ে আবার কংগ্রেসে, তার পরে ফের ফ্রন্টে প্রত্যাবর্তন। পাঁচ বছর পর গয়ালাল আর্যসভায় যোগ দেন। পরে লোকদলে যোগ দেন। জনতা পার্টির টিকিটেও ভোটে লড়েন, জিততেও অসুবিধা হয়নি। সে সময় এই আয়ারাম গয়ারাম-রা অবশ্য ব্যতিক্রম ছিলেন। পাঁচ দশক পর ব্যতিক্রমটাই নিয়ম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy