ভবিষ্যতে ভারতের রাজধানী দিল্লির হয়তো নতুন শিরোপা জুটবে— ‘গরমের রাজধানী’। একই ভাবে মুম্বই ‘অর্থনৈতিক রাজধানী’র বদলে হয়তো হয়ে যাবে ‘বৃষ্টির রাজধানী’ আর কলকাতা ‘সাইক্লোন’-এর। এই নয়া তকমাগুলি কোনও কল্পবিজ্ঞানের স্ক্রিপ্ট নয়, মাস দুয়েক আগে প্রকাশিত রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনস্থ ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ দ্বারা প্রকাশিত রিপোর্টের অন্তর্নিহিত ভবিষ্যদ্বাণী। প্রায় চার হাজার পাতার এই রিপোর্ট স্পষ্ট জানিয়েছে যে, এখনই কার্বনের লাগামছাড়া নিঃসরণ কমাতে না পারলে বিশ্ব জুড়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেলাগাম হতে চলেছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সামনের সারির আধিকারিক এই রিপোর্টকে ‘কোড রেড’ আখ্যা দিয়েছেন, অর্থাৎ রিপোর্টটি যেন গোটা মানবজাতির ক্ষেত্রে এক লাল সঙ্কেত। এতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যেমন চলছে তেমন চললে এই শতাব্দীর শেষ ভাগে পৃথিবী হয়তো ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। বাড়বে অল্প সময়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত, সমুদ্রের জলস্তর ও সাইক্লোনের মতো সমস্যাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্টোবরের শেষে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গ্লাসগোয় যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতে চলেছে, সেখানে সার্বিক ভাবে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পৃথিবী বাঁচানোর প্রেসক্রিপশন তৈরি করতে না পারলে আক্ষরিক অর্থেই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে পৃথিবী।
আশ্চর্য সমাপতন! দেশ জুড়ে প্রকৃতি যেন বিজ্ঞানীদের সদ্য করা অঙ্ক মেলানোর খেলায় মেতেছে। উত্তরবঙ্গ থেকে উত্তরাখণ্ড ভাসছে আকাশভাঙা বৃষ্টিতে, সঙ্কটের মুখোমুখি রাজ্য তথা দেশের একটা বড় অংশের মানুষের জীবন ও জীবিকা। কিন্তু রিপোর্টটি নিয়ে বিশ্ব জুড়ে হইচই হলেও ভারতের রাজনীতিবিদদের বিশেষ হেলদোল নেই; যদিও রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে ছোট থেকে বড়, বিভিন্ন সরকারি ব্যবস্থার মাথায় বসা রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকদের কথা ভেবেই। কেন্দ্রীয় সরকার রুটিনমাফিক বিবৃতি দিলেও দেশের বা রাজ্যের সার্বিক নীতিতে এখনও অবধি এর কোনও প্রতিফলন হয়েছে বা অদূর ভবিষ্যতে হবে, এমন দাবি কোনও পক্ষই করবে না।
বস্তুত পরিবেশের প্রশ্নে, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বাঁচার প্রশ্নে মোদী, মমতা থেকে শুরু করে দেশের তাবড় রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিশেষ কোনও প্রভেদ নেই। অথচ আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে যে, ভারত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সর্বাধিক আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে; শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মৃত্যু বা আহতের পরিসংখ্যানেই নয়, আর্থিক ক্ষতির প্রশ্নেও। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গও দেশের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় আক্রান্ত রাজ্যগুলির মধ্যে সামনের সারিতে। ২০১৯ থেকে ২০২১-এর মধ্যে বুলবুল থেকে আমপান হয়ে ইয়াস— একের পর এক প্রবল ঝড় আছড়ে পড়েছে এ রাজ্যের সুন্দরবনের উপর। আবহাওয়া দফতরের ভবিষ্যদ্বাণী আগের তুলনায় উন্নত হওয়ার কারণে মানুষের মৃত্যু আটকানো গেলেও জীবিকার সঙ্কট আটকানো যায়নি। ভেঙে পড়েছে অজস্র মাটির বাড়ি, নষ্ট হয়েছে পুকুর। মারা গিয়েছে প্রচুর গৃহপালিত পশু। এত কিছু সত্ত্বেও দীর্ঘমেয়াদি ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা থেকে রক্ষা পেতে রাজ্য সরকার কোনও দাবিদাওয়া তুলেছে, এমনটা বিশেষ দেখা যায় না। বিপর্যয়ের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়েছে; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী দিনে যে বিপর্যয় হতে চলেছে, তার থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার জন্য নয়। বেশ কয়েক বছর আগে রাজ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মেটাতে ৩৫০০০ কোটি টাকার এক প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠায়। পরবর্তী কালে টাকাও আসেনি, কোনও পক্ষ বিশেষ সরবও হয়নি।
রাজ্যের রাজনীতিবিদরা রিপোর্টটি দেখলে বুঝতেন যে, কলকাতার গড় তাপমাত্রা এই শতাব্দীর শেষে প্রায় ৪.৫ ডিগ্রি বাড়তে চলেছে। শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হতে পারে ৪৯.৬ ডিগ্রি এবং এক দিনে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে পারে প্রায় ৫৫ শতাংশ। আসানসোল, কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছাড়াতে পারে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস; সুন্দরবনে সমুদ্রের জল বৃদ্ধি পেতে পারে প্রায় ৬০ সেন্টিমিটার। এই রিপোর্টকে হাতিয়ার করে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে স্বচ্ছন্দে আর্থিক দাবি তুলতে পারে, বিশেষ করে সুন্দরবনের কথা সামনে রেখে, যেখানকার প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ তেমন কার্বন নিঃসরণ না করেও বার বার প্রাকৃতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হচ্ছেন।
মনে পড়ে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তৈরি কলকাতা ২০৭০ নামক এক তথ্যচিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কথা, “জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে বাঁচতে আমি এই বয়সেও নিজেকে পরিবর্তন করতে প্রস্তুত, কিন্তু তোমরা কি প্রস্তুত?” এই প্রশ্ন যদি ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের করা যায়, তা হলে উত্তর যে ‘না’ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। আইপিসিসি-র করা রিপোর্ট বলছে, গত সত্তর বছরে পৃথিবীর মধ্যে উষ্ণায়ন সবচেয়ে বেড়েছে কলকাতা শহরে; পিছনে তেহরান ও মস্কো। রিপোর্ট আরও বলছে, কলকাতা শহরে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটেছে তার প্রায় ৮৫ শতাংশ জন্ম নেয় শহরের মধ্যেই, তা সে গাড়ির ধোঁয়ার কারণেই হোক, বা নির্মাণ দূষণ। কিন্তু যে কাজগুলি করলে তাপমান কমানো যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা ঠিক উল্টোটা করছি। গাছ কাটছি, এমন বাড়ি তৈরির অনুমোদন দিচ্ছি যাতে শহরের তাপমান বাড়ে। স্পষ্টতই কলকাতার উষ্ণায়ন কমাতে শহর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক নেতানেত্রী থেকে শুরু করে আধিকারিকদের আয়নার দিকে তাকানো প্রয়োজন। প্রশ্ন হল, তাঁদের সামনে আয়নাটা কে ঝোলাবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy