বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ছাড়তে হয়। পাঁচটার মধ্যে দোকান খুলতে হবে। সব জায়গায় কম্পিটিশন। এই রাস্তার উপরেই দেখুন গোটা দশেক চায়ের দোকান। লোকে জেনে গেছে, আমার দোকান ভোরে খোলে। তাই সকালে বেশ খানিক বিক্রিবাট্টা হয়। তার পর ধরুন, একটা খবর রটে গেছে, দিতির দোকানে চা ভাল। তাই বেলার দিকেও লোকে এখানে চা খায়। সঙ্গে বিস্কুট, সিগারেট, বিড়ি। ক’দিন হল ঘুগনি বানাচ্ছি। সঙ্গে পাউরুটি। ভালই চলছে জেঠু। শুধু, রোদে বড় কষ্ট, আপনাদের নিউ টাউনে ছায়া নেই।
দশটা বাজার আগেই বাড়ি চলে যাই, আমাকে যে ইউনিভার্সিটি যেতে হয়। তখন মা এসে কিছু ক্ষণ বসে, এই এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত। কোনও দিন বোন এসে বসে, যে দিন ওর স্কুলের ছুটি থাকে। আমার বোন আসছে বছর উচ্চমাধ্যমিক দেবে। তাই ওকে বেশি বসতে দিই না। তা ছাড়াও সমস্যা আছে। ও তো ছোট। সব ব্যাপারস্যাপার ভাল বোঝে না। একটা মেয়ে চায়ের দোকান চালাচ্ছে। বুঝতেই পারেন ছেলেরা দোকানের পাশে মোটর সাইকেল লাগিয়ে আড্ডা জুড়ে দেয়। কত রকম যে ঝামেলা জেঠু— এ দিকে গরিব, তার উপরে আবার মেয়ে!
ইউনিভার্সিটি না থাকলে আমিই সকাল-সন্ধে বসি। মা-র শরীর দুর্বল, পেরে ওঠে না। নানা অসুখবিসুখ আছে। ইউনিভার্সিটি না গেলেও চলে না, এমএ সেকেন্ড ইয়ার চলছে। অনেকটা রাস্তা। তার উপরে দিনে দিনে বাস কমছে। অটোয় অনেক খরচ, বাসভাড়ার দ্বিগুণেরও বেশি। কোত্থেকে দেব? মিছিমিছি কত সময় নষ্ট হয়। তার পর ইউনিভার্সিটি গিয়ে সময় নষ্ট। হাঁপাতে হাঁপাতে গেলাম, শুনলাম আজ স্যর নেই। বা ম্যাডাম বলে দিলেন, আজ ক্লাস হবে না। হয়তো সারা দিনে একটা ক্লাস হল। খুব মনখারাপ হয়ে যায়। আমাদেরই এত হয়রানি কেন? তোমরা স্যর ম্যাডাম হয়ে গেছ বলে আমাদের সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে? যা-ই হোক, বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে। আবার দোকানে আসি।
দোকান না করলে যে আমার পড়া হবে না। বোনেরও হবে না। বাবার ছোট একটা মুদিখানা। তার রোজগারে সংসারই চলে না, লেখাপড়ার খরচ কোত্থেকে জোগাবে? আমাদের সংসারের যা খরচ, তার চেয়ে ঢের বেশি খরচ হয় লেখাপড়ার জন্য। বোনের টিউশন খরচ মাসে তিন হাজার টাকা। তার পর যাতায়াতের খরচ। খাতা-বই, প্রোজেক্টের খরচ, এটা ওটা। আমারও টিউশন দরকার ছিল, কিন্তু উপায় নেই। নিজে নিজে যা পারি পড়ি। যারা টিউশন পড়ে, তাদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নোট জোগাড় করি। আমার বড় খরচ হচ্ছে যাতায়াতে— কোনও কোনও দিন অটো নিতেই হয়। আর, নোটের ফোটোকপি। তাও ধরুন মাসে হাজার দেড় হাজার লেগে যায়। স্কুলে পড়ার সময় পর্যন্ত টিউশন ছিল। বাবা-মা যে কী কষ্টে টাকা জোগাড় করত! মা এ বাড়ি-ও বাড়ি কাজ করত। আমি জোর করে ছাড়িয়েছি। শরীর দুর্বল, কী করে অত খাটবে? এই সব ভেবে দোকান দিয়েছি। কোভিডের সময় সর্বস্বান্ত হয়ে গেছিলাম, অনেক ধার হয়ে গিয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কন্যাশ্রীর টাকা পেয়েছিলাম, সেইটা দিয়ে ধার শোধ করি। কিন্তু, টানাটানি যায় না। তাই ভাবলাম, নিজেই একটা কিছু করি। তা হয়ে গেল, বছরখানেক। এখন তো মোটামুটি চালু হয়ে গেছে। দিনে দেড়-দু’শো টাকা বাঁচে। পড়ার খরচ চলে যায়। মা-র ওষুধপত্র কেনার খরচও উঠে আসে।
এমএ পাশ করলে যে চাকরি পাব, তার ঠিক নেই। যদি কিছু না পাই, তা হলে দোকানই চালাব। তবু পাশ করতে হবে। বাবা প্রাইমারি পাশ। মা ইস্কুলে যায়নি। তাই আমার জেদ— যে ভাবে হোক, পড়তে হবে। মাঝে মাঝে দুঃখ লাগে। সরকার ইস্কুল দিল, কলেজ-ইউনিভার্সিটি দিল। তা হলে একটু ভাল পড়ানোর ব্যবস্থা কেন করল না? এই যে এত টাকা টিউশনে দিতে হচ্ছে, সেটা কি চাইলে সরকার আটকাতে পারত না? কন্যাশ্রীর টাকা আমার খুব কাজে লেগেছে। কিন্তু আরও বেশি উপকার হত যদি ইস্কুলে-কলেজে লেখাপড়া ভাল করে হত। তা হলে আমাদের অনেক টাকা বাঁচত, আবার যোগ্যতাও বাড়ত।
সরকারের মতিগতি বুঝতে পারি না। গরিব মানুষকে নগদ টাকা দিচ্ছে, সে ভাল কথা। অনেক উপকার। কিন্তু তাতে গরিব মানুষের কি গরিব থাকাটা বন্ধ হবে? এক দিকে টাকা দিচ্ছে, অন্য দিকে তার অনেক বেশি খরচ করিয়ে নিচ্ছে। এই যে বললাম, টিউশন খরচ, সে তো একটা মস্ত ব্যাপার। তার সঙ্গে যাতায়াতের দুরবস্থা। অটোভাড়া-টোটোভাড়া দিতে অস্থির হয়ে যেতে হয়। সরকার কি কয়েকটা বাস বাড়াতে পারে না? তা হলেই তো কত সুরাহা হয়। তার পর দেখুন, এই যে দোকান দিয়েছি। আশেপাশে কোনও বাথরুম নেই। ওই ও-পারে একটা আছে, কিন্তু তাতে প্রতি বারে পাঁচ টাকা করে লাগে। এটা কি সরকার ফ্রি করে দিতে পারে না? এর উপরে আছে জুলুম। অমুক দাদা এসে বলবে, টাকা দে, না হলে তুলে দেব। সারা দিনে ক’টাকাই বা রোজগার? সেখান থেকে যদি জুলুমের দাবি মেটাতে হয়, তা হলে কী করে চলে?
অথচ, চালাতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইতে আছে, দেশ গড়ে উঠেছে সব মানুষের সম্মতিতে। তাই সরকারের কাজ হচ্ছে সবাইকে সমান অধিকার দেওয়া। আমাদের সংবিধানের একেবারে গোড়ায় লেখা আছে সকলের জন্য সমান মর্যাদা ও সুযোগ। কিন্তু সে তো বইতে লেখা। বাস্তবে তার উল্টোটাই হয়। আমার কি মনে হয় জানেন জেঠু, এই যে বইতে যা লেখা আছে কাজে কর্মে ঠিক তার উল্টোটাই তো হয়, এই জন্যই বোধ হয় আমাদের স্যররা ম্যামরা ক্লাস নেন না, পড়ান না। হয়তো ভাবেন, এ-সব তো মিথ্যা। কী দরকার পড়িয়ে? অথবা ভাবেন, ছেলেমেয়েরা যদি বইতে যা আছে, তেমনটাই চাইতে শুরু করে? তা হলে তো বিপদ। সব উল্টেপাল্টে যাবে— দোকানির মেয়েও প্রফেসরি করার সুযোগ চাইবে; কাজের দিদির ছেলেও বলবে, আমাদেরও নিউ টাউনে ফ্ল্যাট হোক। কিছু মনে করবেন না জেঠু, এই যে আপনারা নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে থাকেন— চায়ের দোকান চালাতে চালাতেই লোকেদের আড্ডার কথাগুলো কানে আসে— এ-সব ফ্ল্যাট তো জলের দরে পাওয়া। তা সরকার কাকে সাহায্য করল? যাঁদের ভাল চাকরি, বা ব্যবসা আছে, তাঁদের। মাঝে মাঝে খবরে শুনি, ভারত সরকার বড় বড় শিল্পপতির হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ মকুব করে দিয়েছে। কিন্তু, আমাদের জন্য কী করেছে? কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো কিছু প্রকল্পের সামান্য টাকা, অতি সামান্য, তাতেও পয়সাওয়ালাদের গায়ে কত জ্বালা! ওগুলো নাকি দানখয়রাত। আর তাঁরা যা পান, সে-সব নাকি হকের পাওনা!
এই সব দেখে খেপে যাই জেঠু। গরিব বলে, মেয়ে বলে, গরিবের মেয়ে বলে, আমাদের কি কিছুতেই কিছু অধিকার নেই? দেখা যাক, আছে কি নেই। আমরা নিজেরাই নিজেদের পাশে দাঁড়াব। নিজেকে তো পর হয়ে যেতে দিতে পারি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy