Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
India

ভারতকল্পনা এবং এই দেশ

১৯৪৭-এর পর ভারতের জনগণের যে সাংবিধানিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হল, তার ভিত্তি কিন্তু এ দেশের ইতিহাসে নিহিত ছিল না।

রচয়িতা: স্বাধীন দেশের সীমান্ত-নির্ধারণ বৈঠকে (বাঁ দিক থেকে) আবদুর রাব নিশতার, বলদেব সিংহ, জে বি কৃপালনী, বল্লভভাই পটেল, এরিক মেলভিল, জওহরলাল নেহরু, লর্ড মাউন্টব্যাটেন, লিয়াকত আলি খান, দিল্লি, ৭ জুন ১৯৪৭।

রচয়িতা: স্বাধীন দেশের সীমান্ত-নির্ধারণ বৈঠকে (বাঁ দিক থেকে) আবদুর রাব নিশতার, বলদেব সিংহ, জে বি কৃপালনী, বল্লভভাই পটেল, এরিক মেলভিল, জওহরলাল নেহরু, লর্ড মাউন্টব্যাটেন, লিয়াকত আলি খান, দিল্লি, ৭ জুন ১৯৪৭।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২২ ০৪:২৮
Share: Save:

প্রশ্ন: আপনার সাম্প্রতিক বই দ্য ট্রুথস অ্যান্ড লাইজ অব ন্যাশনালিজম: অ্যাজ ন্যারেটেড বাই চার্বাক আক্ষরিক অর্থে অ-সাধারণ। আপনি বলেছেন এখানে আপনি ‘লেখক’ নন, ‘সম্পাদক’। লেখক বা কথক হলেন প্রাচীন ভারতের দার্শনিক চার্বাক। যেন চার্বাকের একটি পাণ্ডুলিপি এটি। চরম যুক্তিবাদী চার্বাক প্রাচীন কাল থেকে এ কালে এসে দেখছেন, আজকের ভারতে জাতিত্ব নিয়ে মিথ্যা প্রচারের শেষ নেই। সেই প্রচারের কোনগুলি বিকৃত, কোনগুলি ‘মিথ্যা’, ‘সত্যি’গুলিই বা কী রকম— এ সবই বইয়ের আলোচ্য। স্বাধীন ভারতের ৭৫তম জন্মদিনে পৌঁছে আমাদের জানতে ইচ্ছে করে যে, কী বলেন চার্বাক, এর মধ্যে কোন মিথ্যাগুলি ৭৫ বছর বয়সি ভারতকে আজ সর্বাধিক বিপন্ন করতে বসেছে?

পার্থ চট্টোপাধ্যায়: আধুনিক পণ্ডিতরা বলেন, প্রাচীনকালে চার্বাক নামে এক জন কোনও দার্শনিক ছিলেন না, ছিল চার্বাক নামধারী নাস্তিক মতাবলম্বী এক সম্প্রদায়। তাদের কোনও রচনাই আজ আর পাওয়া যায় না। নানা বিষয়ে তাদের মতগুলো আমরা জানতে পারি তাদের প্রতিপক্ষের রচনা থেকে। ভারতের জাতীয়তাবাদ নিয়ে এই বইটি লেখা (অথবা বলা) হয়েছে চার্বাক নামে অবিশ্বাস্য রকমের দীর্ঘজীবী কোনও এক ব্যক্তির বয়ানে, যিনি নাকি নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্টের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন, ১৯৩০-এ মাদ্রাজে পেরিয়ারের সঙ্গে বসে আলাপ করেছিলেন, ১৯৪৭-এ জুনাগড়ে বল্লভভাই পটেলের সভায় উপস্থিত ছিলেন, ১৯৭০-এর দশকে নাগাল্যান্ডে সেখানকার জনজাতির মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা নিয়ে খোঁজখবর করেছিলেন, আবার সাম্প্রতিক কোভিড অতিমারির মোকাবিলা নিয়েও চিন্তিত হয়েছেন। সুতরাং, তাঁর মতো যুক্তিবাদীর জবানিতে যদি আজকের ভারতের অধিবাসীদের বিপন্নতার কথা শোনা যায়, তাতে ঐতিহাসিক গভীরতা থাকবে, ভৌগোলিক ব্যাপ্তি থাকবে, সর্বোপরি থাকবে কল্পকাহিনি-বর্জিত যুক্তির বাঁধুনি।

কোন মিথ্যাগুলো আজ ভারতকে সবচেয়ে বিপন্ন করছে? এক, এই ধারণা যে ভারতবর্ষের ইতিহাস হল একের পর এক রাজবংশের সারি, যার মধ্যে দ্বাদশ শতাব্দীর আগের রাজারা ছিলেন স্বদেশি, তার পরের রাজারা বিদেশি। এই ধারণা মিথ্যা। দুই, আমাদের জাতিগত পরিচয় চলে গেছে সেই সুদূর অতীতে সিন্ধুতীরের বৈদিক যুগে, কিংবা হয়তো আরও আগে হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোতে, সেই যুগের মানুষ আর আমরা একই জাতি। এই ধারণাও মিথ্যা। তিন, আমাদের জাতিগত বন্ধনের প্রমাণ হল রাষ্ট্রশক্তির পরাক্রম: যখন রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়, জাতিও শক্তিশালী হয়, আর যখন রাষ্ট্রশক্তি ভঙ্গুর কিংবা অপরের হাতে, তখন জাতি দুর্বল। মিথ্যা। চার, দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে জাতির ভৌগোলিক সীমা হল আসমুদ্রহিমাচল, অথচ আজ ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সীমানা সেটাই, যা ব্রিটিশ শাসক ও ভারতের নেতারা ১৯৪৭ সাল থেকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, এই দুই ধারণা একই সঙ্গে সত্যি হতে পারে না। পাঁচ, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ভাষাভিত্তিক রাজ্যের মানুষের দাবি জোরদার হলে জাতি-রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে, এই ধারণাও মিথ্যা। দেশের জনগণের একত্রে বাস করার ইচ্ছাটাই প্রধান; রাষ্ট্রযন্ত্রের দাবি কখনও জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে না।

প্র: চার্বাক বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, প্রাচীন কাল থেকেই ভারতের জীবন যাপিত হয়ে এসেছে মানুষ ও সমাজকে ঘিরে, রাষ্ট্রকে ঘিরে নয়। এখানেই আধুনিক ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রের সঙ্গে আগেকার ভারতীয় সাম্রাজ্যের প্রধান অমিল। আমরা এখন জানি যে, নেশন-স্টেট বস্তুটা পশ্চিমের আমদানি। ১৯৪৭ সালে ভারত রাষ্ট্র অবশ্য তৈরি হল সেই পশ্চিমি রাষ্ট্রের অনুকরণেই। ‘ভারত রাষ্ট্র’ কি তবে মানুষ(পিপল)-কেন্দ্রিক পুরনো ‘ভারত’কে ধ্বংস করে দিল? অতিরিক্ত রাষ্ট্রনির্ভরতা কি গত পঁচাত্তর বছরে ভারতের সমাজ ও রাজনীতির বড় ক্ষতি করল?

উ: ১৯৪৭ সালে ঠিক কী ঘটল, সেটা ভাল ভাবে বোঝা দরকার। ব্রিটিশ ভারতের যা ভৌগোলিক আয়তন ছিল, বোঝাপড়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসক আর ভারতীয় রাজনীতিকরা তা দ্বিখণ্ডিত করে ভারত আর পাকিস্তান, এই দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিলেন। পরবর্তী দু’-তিন বছরে প্রায় ৫৫০টি দেশীয় রাজ্য যারা ব্রিটিশ ভারতের বাইরে ছিল, তাদের স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হল। তার পর জোড়া হল ফরাসি আর পর্তুগিজ উপনিবেশ, অর্থাৎ পুদুচেরি, গোয়া ইত্যাদি। সবশেষে যুক্ত হয়েছে সিকিম, ১৯৭৫ সালে। আজ ভারতীয় রাষ্ট্রের যা ভৌগোলিক সীমা, তার সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষের মিল কোথায়?

সদ্যপ্রয়াত ইতিহাসবিদ ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় সমগ্র প্রাচীন সাহিত্য ঘেঁটে প্রমাণ করে গেছেন, ভারতবর্ষ ধারণাটি কখনওই কোনও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমা বোঝাত না। মধ্যদেশ বা আর্যাবর্তকে কেন্দ্র করে চারটি দিশায় ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন জনপদকে (দক্ষিণে নাড়ু) বোঝাত। সেই জনপদের তালিকা এক-এক যুগে এক-এক রকম। জনজীবন যাপিত হত জনপদগুলিতে, যেমন মগধ, কোশল, দ্রাবিড়, অবন্তী, গান্ধার, বঙ্গ ইত্যাদি। কেউ নিজেকে ভারতবর্ষীয় বলে পরিচয় দিচ্ছেন, এমন ঘটনা ভাবাই যেত না। এক-একটি জনপদের উপর শাসন এবং রাজস্ব আদায়ের দাবি করতেন এক বা একাধিক রাজা। কোনও কোনও রাজা দিগ্বিজয়ী হয়ে একাধিক জনপদ অধিকার করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতেন। কিন্তু এই প্রাচীন সাম্রাজ্যের মধ্যে যেগুলি সবচেয়ে বড়, যেমন মৌর্য বা গুপ্ত সাম্রাজ্য, সেগুলির ব্যাপ্তি আজকের ভারতীয় রাষ্ট্রের সীমানার সঙ্গে আদৌ মেলে না। দক্ষিণের প্রাচীন সাম্রাজ্য, যেমন চোলা অথবা বিজয়নগর, সেগুলি আবার উত্তর ভারতে পৌঁছয়নি।

ভারতবর্ষের প্রাচীন ধারণাকে ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার কাজটি করেছিলেন ইংরেজ শাসক-ইতিহাসবিদরা। তাঁরাই আবার ইন্ডিয়ার ইতিহাসকে হিন্দু, মুসলিম আর ব্রিটিশ, এই তিন পর্বে ভাগ করলেন। মৌর্য-গুপ্ত আর সুলতানি-মোগল সাম্রাজ্যের ন্যায্য ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার যে ইংরেজদের উপর এসে বর্তেছে, এই ছিল সেই ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য। অদ্ভুত ব্যাপার, এই ত্রিধাবিভক্ত বিন্যাস কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসবিদদের একটা বড় অংশ মেনে নিলেন। ১৯৬০-এর দশকে আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখনও আমরা এই ইতিহাসই পড়তাম। জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ শাসকদের বহু বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করতেন বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের মূল শর্তগুলি নিয়ে তাদের চিন্তায় বিশেষ মিল ছিল।

স্বাধীনতার পর ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষকে যে মিলিয়ে দেওয়া গেছে, তার কারণ দু’টি ধারণারই কেন্দ্রস্থলে রয়েছে আর্যাবর্ত। আজকে যে দু’টি প্রধান জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ প্রচলিত আছে, অর্থাৎ বহুত্ববাদী এবং হিন্দুত্ববাদী, দু’টিতেই আর্যাবর্তের প্রাধান্য স্বীকৃত। হিন্দুত্ববাদীদের মতে, প্রাচীন আর্যসভ্যতা সিন্ধু উপত্যকা থেকে শুরু করে আর্যাবর্তে এসে তার পরিপূর্ণ সাংস্কৃতিক রূপ ধারণ করে এবং মান্য হিন্দু সংস্কৃতির আকারে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। বহুত্ববাদীরা বলে, জাতির পরিচয় কোনও একটি ধর্মে আবদ্ধ নয়, বরং গাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিত একের পর এক সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় তা এক বহুমাত্রিক মিশ্র সংস্কৃতি হিসেবে পরিপুষ্ট হয়েছে। দু’টি মতাদর্শেই কিন্তু জাতীয়তার মান্য রূপ পাওয়া যাচ্ছে মধ্যদেশ বা আর্যাবর্তে। সেখানকার অভিজাত উচ্চবর্ণের মানুষেরাই (আসলে পুরুষেরা) যেন আদি এবং খাঁটি ভারতীয়। দেশের অন্যত্র যারা বাস করে, তাদের ভারতীয়ত্ব অর্বাচীন, অতএব প্রমাণসাপেক্ষ। দু’টি ধারণার কোনওটাতেই মিজোরাম কিংবা নিকোবর, এমনকি গোয়া বা তামিলনাড়ুর মানুষকে ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আর্যাবর্তবাসীর সমকক্ষ ভারতীয় বলে মনে করা যায় না।

অথচ, ১৯৫০ সালে যে সংবিধান লেখা হল, তাতে ভারতের ভূখণ্ডের প্রত্যেক অধিবাসীকে সমমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হল। তা হলে জাতি-রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক আর সাংবিধানিক সংজ্ঞার মধ্যে সাযুজ্য রইল কোথায়? এই দ্বন্দ্ব আজ দেশের রাজনীতিকে বিষাক্ত করে দিয়েছে।

প্র: “জাতির একত্ব তো একটা কল্পিত বিষয়। কিন্তু যখন লক্ষ লক্ষ লোকে এমন কিছু কল্পনা করে, সেই কল্পিত ধারণাও সত্য হয়ে দাঁড়ায়”— পড়েছি এই বইটিতে। তা হলে কল্পনা, কিংবা মিথ্যা কল্পনা— একে ঠেকানোর উপায়টা কী? ‘এলিট’ বা উচ্চ সমাজ আর ‘মাসেস’ বা নিম্ন সমাজের মধ্যে ব্যবধান ঘোচানো অত্যন্ত জরুরি কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু কী হবে, যদি দুই সমাজেই মিথ্যা কল্পনার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটতে থাকে?

উ: আধুনিক অর্থে জাতি-কল্পনা এ দেশে শুরু হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। তাতে যে ধারাটি পেশাদার ইতিহাসবিদ মহলে স্বীকৃত এবং যা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, তা লেখা হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। এই ইতিহাসের একটি জনপ্রিয় রূপ দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু তাঁর ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইতে। কিন্তু দেশের কোটি কোটি মানুষ যে জাতি-কল্পনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, তা মোটেই ইংরেজি ভাষায় কল্পিত হয়নি। সেই কল্পনা গড়ে উঠেছিল ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রকর আর বক্তাদের মাধ্যমে। জাতির প্রতি ভালবাসার যে আবেগ, যাতে অনুপ্রাণিত হয়ে এত মানুষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, জেল খেটেছিল, কেউ কেউ এমনকি ফাঁসিতে দণ্ডিত হয়েছিল, সেই আবেগ উচ্চারিত হয়েছিল বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায়। সেই কারণেই ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার সময় কংগ্রেস তার প্রাদেশিক সংগঠন সাজিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রাদেশিক সীমানাকে অস্বীকার করে ভাষাভিত্তিক অঞ্চল অনুযায়ী। তাই কংগ্রেসের গুজরাত বা অন্ধ্র বা কেরল প্রাদেশিক কমিটি ছিল, যদিও ওই নামে কোনও প্রদেশ ছিল না। স্বাধীনতার পর ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল, কারণ সেটাই ছিল গণতান্ত্রিক জনসমাবেশের প্রধান শর্ত।

কিন্তু এক-একটি ভাষা-অঞ্চলে যে জাতি-কল্পনা গড়ে ওঠে, তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। মরাঠি ভাষায় জাতি-কল্পনা গড়ে উঠেছে শিবাজির মরাঠা সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে। সেই জাতির প্রতীক অশ্বারোহী অস্ত্রধারী রাজপুরুষ। আবার বাংলা বা হিন্দিতে স্বদেশকল্পনার প্রতিমা ভারতমাতা। তামিলনাড়ুতে তামিল ভাষাকেই দেবী বলে পূজা করা হয়েছে, যে দেবীকে উত্তর ভারতের সংস্কৃত-ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এ রকম প্রতিটি ভাষা-অঞ্চলেরই নিজস্ব জাতি-কল্পনা আছে, যাতে সেই অঞ্চলের মানুষের সমষ্টিগত পরিচয় বর্ণিত হয়েছে, আবার সেই পরিচয়ের সঙ্গে বৃহত্তর ভারতের সম্পর্ক নির্দিষ্ট হয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, প্রতিটি ভাষা-অঞ্চলেরই তার নিজস্ব ভারত-কল্পনা আছে, কিন্তু পঞ্জাবের ভারত-কল্পনা, ওড়িশার ভারত-কল্পনা, মণিপুরের ভারত-কল্পনা, কেরলের ভারত-কল্পনা, এক নয়।

সুতরাং ১৯৪৭-এর পরে ভারতের জনগণের যে সাংবিধানিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হল, তার প্রাথমিক ভিত্তি কিন্তু ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ইতিহাসে নিহিত ছিল না। সেই ঐক্য সম্ভব হয়েছিল কারণ স্বাধীন ভারত-রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে যারা বাস করতে লাগল, তারা ভারতের নাগরিক হতে সম্মত হল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্মতির কারণ ছিল প্রতিটি ভাষা-অঞ্চলের নিজস্ব জাতি-কল্পনা, যা আঞ্চলিক পরিচয়ের সঙ্গে ভারতীয় জাতিসত্তার এক-একটি বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিল। সব ক্ষেত্রে তা হয়নি। তাই তামিল অঞ্চল বেশ কিছু দিন দ্রাবিড়স্থানের দাবিতে মুখর ছিল। উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ কখনওই ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অংশীদার ছিল না। আর্যসভ্যতা কিংবা মৌর্য বা মোগল সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা তাদের কাছে কেবল অর্থহীন নয়— ভীতিপ্রদ। তাদের কাছে ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্থপূর্ণ হয়, যদি তারা বিশ্বাস করতে পারে যে, ভারত-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে তারাও সমান অংশীদার। সে জন্য তথাকথিত খাঁটি ভারতীয়দের কাছে তাদের জাতীয়তার পরীক্ষা দিতে হবে না। সেই বিশ্বাস এখনও তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না।

পুরাকালে যেমন বিভিন্ন জাতি, বংশ, মহাপুরুষের অলৌকিক উদ্ভবের পৌরাণিক কাহিনি কল্পনা করা হত, আধুনিক কালে জাতি-রাষ্ট্র কিংবা অঙ্গরাজ্যের উৎপত্তি নিয়েও তেমনই ইতিহাস আর কল্পকাহিনি মেশানো মিথ সৃষ্টি হয়েছে। পেশাদার ইতিহাসবিদের লেখা পড়ে আবেগমথিত হওয়া কঠিন। জনসমষ্টিকে সামূহিক বন্ধনের আবেগে একত্র করার ক্ষেত্রে মিথের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

প্র: আপনার ‘সম্পাদিত’ বইটির শেষে চার্বাক তরুণদের কাছে নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করার আবেদন জানিয়েছেন, বৃহত্তর ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নির্মাণ হবে যে আন্দোলনের লক্ষ্য। এমন আন্দোলনের সম্ভাবনা কতটা বলে মনে করেন? দেশের কোন অঞ্চলে বা পরিসরে তার কী লক্ষণ আপনি দেখছেন?

উ: এখানেও ভাষার প্রশ্নটা সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে। আজ ভারতে ইংরেজি-মাধ্যম আর প্রাদেশিক ভাষা-মাধ্যমে দু’টি স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থা শৈশব থেকে শুরু করে দু’টি পৃথক জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়ে চলেছে যা প্রায় দু’টি আলাদা দেশের মতো। প্রথমটিতে আছে সামাজিক মর্যাদা আর প্রাচুর্যের অঢেল সুযোগ, দ্বিতীয়টিতে কেবল হীনম্মন্যতা আর হতাশা। চার্বাক প্রথম বর্গের তরুণতরুণীদের কাছে আবেদন করেছেন, ভাষার ব্যবধান ভেঙে ইংরেজি-মাধ্যম জগতের জ্ঞানবিজ্ঞান, ইতিহাসচেতনা আর শিল্পসাহিত্যের ভান্ডারকে প্রাদেশিক-ভাষার জগতে পৌঁছে দিতে, আবার সেই সঙ্গে প্রাদেশিক সংস্কৃতির বিশাল ঐশ্বর্যকে আপন করে নিতে। চার্বাকের দাবি, ভারতের সমস্ত সরকারি স্কুলে প্রাথমিক স্তর থেকে সকলকে ইংরেজি শেখানো হোক। তা হলে গ্রামে-গ্রামান্তরে আজ যে ইংরেজি স্কুলের ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে, তা কিছুটা কমবে। সেই সঙ্গে ইংরেজির অহেতুক কৌলীন্যের অবসান হবে।

এই দিকে যদি কিছুটাও অন্তত এগোনো যায়, তা হবে এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শামিল। দীর্ঘজীবী চার্বাক ওঠাপড়া দেখেছেন। তাই তিনি যখন আশাবাদী, আমাদেরও ভরসা হারানোর কোনও কারণ নেই।

(কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা এবং সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা)

সাক্ষাৎকার: সেমন্তী ঘোষ

অন্য বিষয়গুলি:

India Book Interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy